somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউ- এক মহিলার ছবি

১০ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছু কিছু বই পড়েছি যেগুলো মনে দাগ কেটে গেছে; কিছু বই দাগ না কাটলেও রেখা রেখে গেছে গমনের; কিছু বই হারিয়ে গেছে। দাগ কেটে যাওয়া বইদের নিয়ে আলাদা একটা- অদ্ভুত একটা মুগ্ধতা থাকে, কেউ সে বই সম্পর্কে জিগ্যেস করলে অনায়েশে বলা যায়- “অসাধারণ বই, পড়ে দেখুন- মনের নতুন দুয়ার খুলে যাবে”। নিজেই তখন বিজ্ঞাপনপ্রণেতা হয়ে যাই। কাল রাতে শেষ করা সৈয়দ হকের “এক মহিলার ছবি” সেরকম একটা- অবশ্যই সেরকম একটা বই।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম উপন্যাস বোধকরি এক মহিলার ছবি। তিনি যে অসাধারণ একজন লিখিয়ে হবেন পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলেন হয়তো তখনকার বিজ্ঞ পাঠকেরা এই বই পড়ে- বুঝতে পারি। আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত- খ্যাতির চুড়োয় বসে নিজের বহুল কর্মজীবনের দিকে তাকিয়ে দেখছেন হাসি মুখে- নিশ্চয়ই এক মহিলার ছবির প্রতি তার আলাদা একটা ভালোলাগা, আলাদা একটা মুগ্ধতা আছে- অন্যরকম একধনের মমতা আছে। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস বলে কথা।
আমার হাতে যে বইটা আছে সেটা একটা সংকলন। নাম ‘কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন”। পিছনের পাতায় লেখা ‘পঞ্চ প্রেমের উপাখ্যান’। বলার দরকার নেই যে এখানে পাঁচটি উপন্যাস আছে। এক মহিলার ছবি তার মধ্যে একটি। বাকিগুলো- ‘কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন’, ‘অনুপম দিন’, ‘জনক ও কালো কফি’ আর সীমানা ছাড়িয়ে’। ‘জনক ও কালো কফি’ ছাড়া বাকি সবগুলোই পড়েছি( এক মহিলার ছবি আজ পড়লাম)। বইয়ের ছাল চামড়া বলতে গেলে কিছুই নেই, কভারটা আছে- প্রচ্ছদটা কোন রকমে বোঝা যায়; আর কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সেটা জানা যায়। অনিন্দ্য প্রকাশন। এমনকি সূচিপত্রও নেই। শুধু এটা জানতে পারলাম যে ‘এক মহিলার ছবি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে যখন তিনি লক্ষ্মীবাজারে থাকতেন। প্রতি উপন্যাসের আলাদা প্রচ্ছদ আছে। এক মহিলার প্রচ্ছদে পেনছিলে আঁকা একটি রমণীকে দেখা যায়- নগ্ন- বসে আছে আয়নার সামনে ভেজা চুলে। আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে তার প্রস্ফুটিত স্তনদ্বয়।
যাই হোক, বইটা পড়া শেষ করলে আমার মনে হোল নতুন একটা কিছুর আস্বাদ পেলাম যেটা এতদিন পাইনি খুঁজে সুনীল কিংবা সমরেশে কিংবা হুমায়ুন আহমেদের সস্তা বানিজ্যিক বইয়ে। সৈয়দ হোক যে বাংলা সাহিত্যের সম্রাট অন্তত পুব বাংলার সেটা মানতে আমার আর কোন বাঁধা নেই।
ওঁকে বেশি পড়িনি আমি- আসলে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল তিনি- এতোই বৃহৎ যে সময় লেগে যাবে নিশ্চিত ১০ বছর- দেড়’শর উপরে বই লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক আর কাব্যনাটক মিলিয়ে- বিশাল না বলে উপায় আছে?
এবার একটু রিভিউয়ের দিকে যাই। আগেই বলেছি প্রথম প্রকাশিত ১৯৫৯ সালে যখন তার বয়স মাত্র ২৪ বছর! এখানে বলে রাখি সৈয়দ হোক হলেন সবচেয়ে কম বয়সে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক- পেয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সে(১৯৬৬)। যাই হোক বইটায় “প্রেমের উপাখ্যান” ট্যাগ মারা। আসলেই কি “এক মহিলার ছবি”- প্রেম নিয়ে? শুধু প্রেমের বই এই ট্যাগ মারা কি ঠিক হয়েছে? হয়তো না? আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে- ঠিক হয়েছে।
হ্যাঁ, প্রেম, প্রেমই এই বইয়ের মূল উপাখ্যান- বইয়ের প্রধান চরিত্র সারাজীবন শুধু ভালোবাসাই খুঁজেছেন- প্রেমই খুঁজেছেন। নাসিমা আক্তার এই বইয়ের প্রধান চরিত্র, যে কিনা ব্যর্থ হয়েছেন বারবার, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, ভালবাসার বদলে পেয়েছেন পাঁক আর থুতু। ভেঙ্গে পড়েছেন সমাজের ঢিলের আঘাতে, কামনা আর লালসার রক্তচক্ষুতে বারবার পালিয়ে গেছে ভালবাসা। তিনি মুক্তি খুঁজেছেন। পালিয়ে এসেছেন- নতুন জায়গায় মানিয়ে যাওয়ার আগেই আবার আঘাত এসেছে- বাহির থেকে মাঝে মাঝে, ভেতর থেকেও; আবার ভেগেছেন তিনি। স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়েছে- কিন্তু থামেননি।
নিজের ভেতরে ডুব দেয়া, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার বাসনা সম্পূর্ণ বইটাতে বারবার পাওয়া যায়। কবি- হ্যাঁ কবিই তো-শামসুল হক লিখেছেন এই ব্যাপারটা নিয়ে এভাবে- “তার অসীম রিক্ততা প্রাচীন জাহাজের পালের মতো ফুলে ফুলে উঠতে থাকে তখন। প্রতীক চিহ্নের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে সেই ধূসর থাবা। আছড়ায়। ফেটে পড়বার শক্তিটুকু যে তার অন্তর্হিত হয়ে যায়। শুকিয়ে গেছে রক্তের নদী। অতলে, আরও অতলে, নাসিনা। ক্লান্তির কালো চোখের আরো পিছনে।”
অদ্ভুত সাহসি লেখক সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা সাহিত্যে অন্তত বাংলাদেশের সাহিত্যে সমকামিতা আর লিভ টুগেদারের মতো ব্যাপার হয়তো তিনিই প্রথম তুলে ধরেছেন- এই উপন্যাসের মাধ্যমে। ভাবুন সালটা ১৯৫৯। সেই তখনই তিনি লিখেছেন সমকামিতা আর লিভ টুগেদার নিয়ে- বিষয় করেছেন গল্পের; এটা কম কথা নয়; হোক তা খুব সল্প পরিসরে। আমার মনে হয় গল্পটা বিশাল পরিসর দাবি করে- কিন্তু সৈয়দ হকের জাদুকরী লেখায় অল্পেই সেটা প্রস্ফুটিত হয়েছে শুদ্ধভাবে, সুন্দরভাবে।
ভাষা- ভাষা এই বইয়ের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক। অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি সৈয়দ হকের আর বাকি সব বইয়ের মতো। বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় হক সাহেবের এই বই পাঠ করে। তিনি বারবার বিভাজিত হয়েছেন, খোলস পালটেছেন বারবার। বাঁকা করেছেন গ্রাম্য নদীর মতো আবার সরলরেখার মতো সোজা চালিয়ে গেছেন কলম।এখনকার লেখার ধরনের থেকে সেই ধরনের আকাশ জমিন তফাৎ। এটা বুঝতে পারলে মজা লাগে। ভালো লাগে এটা ভেবে যে- “আমি একজন সেরা লেখকের বেড়ে ওঠা দেখছি- বিবর্তন দেখছি!” তরুণ লেখা কিন্তু কোথাও মনে হবেনা হোঁচট খাচ্ছি। সুন্দর ভাষা’র গতি আর সচলতায় আপনা থেকেই ভেসে যেতে হয়।
তো, শেষ করি- যারা এখনো বইটা পড়েননি তারা খুব তাড়াতাড়ি পড়ে নিন সময় করে- জানি হতাশ হবেন না। যদি হতাশ হন তবে কমেন্টে এসে গালাগালি করে যাবেন- আমি চুও করে শুনবো শুধু!
সৈয়দ হকের একটা খুব প্রিয় কবিতার লাইন - “এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার”। শামসুর রাহমানের কবিতার এই লাইনটা নাকি তিনি প্রায়ই আবৃতি করে ওঠেন অজানিতে। হ্যাঁ এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন- শুধু দাঁড়িয়ে নয়- শাসন করছেন রীতিমত বাংলাসাম্রাজ্য।
বিদ্রঃ- অনেকদিন আগে লেখা, নতুন করে কয়েকটা লাইন লিখেছি শুধু
২২টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×