সকালে বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম৷ এরকম আটোসাটো জার্নিতে এক ঘন্টা দেরীতে ওঠা মানে অনেক লোকসান৷ তারওপর মেয়েদের রেডী হতে অনেক সময় লাগে৷ তবে দিনটা ছিল চমত্কার, আকাশে কোন মেঘ নেই৷ আগের দুদিন এংকরেজ আর ডেনালীতে বৃষ্টি দেখতে দেখতে হয়রান লাগছিল, আবার ফেয়ারব্যংকসে একটা বড় টার্গেট রাতে অরোরা দেখা৷ মনে মনে খুব চাচ্ছিলাম রাত পর্যন্ত যেমন এরকম আকাশ থাকে৷ ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কার সাথে ওদের মিউজিয়াম ওখানে গেলাম৷ এ্যংকরেজের মিউজিয়ামটার চেয়ে আলাদা৷ কয়েক হাজার বছর আগেকার ফ্রোজেন বাইসন দেখলাম, এছাড়া ম্যামথ, জায়ান্ট স্লথের ফসিল ছিল৷ প্রচুর জাপানি ট্যুরিস্ট মিউজিয়ামে, বয়স্ক, একজন বললো মাত্র পাচশ ডলারে নাকি টোকিও থেকে আলাস্কা এসে ঘুরে যাওয়া যায়৷ সত্যি না মিথ্যা বুঝলাম না৷
হুড়োহুড়ি করে মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে রওনা দিলাম ফেয়ারব্যাংকসের গোল্ড মাইনের উদ্দ্যেশ্যে৷ এক সময় লোকজন আলাস্কা আসতই সোনার খনির উদ্দ্যেশ্যে৷ উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দির শুরুতে গোল্ড রাশের সময় অসংখ্য গোল্ড মাইন তৈরী হয়েছে এখানে৷ তবে গোল্ড মাইনিং এখন আর কোন লাভ জনক ব্যবসা নয়, বেশীর ভাগ গোল্ড মাইনই লাটে উঠেছে৷ কয়েকটা আছে ট্যুরিস্টদের জন্য৷ ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম মাইনিং এর খরচ এখানে এত বেশী এর চেয়ে রিসাইকেল করে বা অন্যান্য উত্স থেকে সস্তায় সোনা জোগাড় করা যায়৷
বিশ ডলার টিকেট কেটে ঢুকলাম ভিতরে৷ পুরোনো ভাঙ্গা গোল্ডমাইন৷ পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা পার্ট টাইম গাইডের কাজ করে৷ একটা ট্যুর দিল কিভাবে মাটি থেকে সোনা আলাদা করা হয়৷ সোনা দেখলাম খুব ছোট ছোট দানা আকারে থাকে৷ কাদা মাটি আর পাথরে থেকে বেশ কষ্ট করে আলাদা করতে হয়৷ ট্যুর শেষ হলে আমাদেরকে এক ব্যাগ করে খনি থেকে তোলা বালি-পাথর দিলো, সোনা সংগ্রহের জন্য৷ গাইড মেয়েটা প্রথমে একটা ডেমো দিলো কিভাবে সোনা আলাদা করতে হবে৷ অনেকটা আমাদের দেশে গ্রামের দিকে চাল থেকে যেভাবে পাথর আলাদা করে৷ বেশ কৌশলে পানিতে আস্তে আস্তে ধুয়ে কাদা থেকে সোনা বেছে ফেলতে হয় (ছবি)৷ গোটা বিশেক দানা পেলাম আমি, মোটামুটি ৪ ডলার দামের৷
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল সোনার খনি থেকে বের হতে হতে৷ একটা প্ল্যান ছিল Manley Hot Springs দেখতে যাবো৷ এখন মনে হচ্ছে স্রেফ ডাল্টন হাইওয়ের মুখ পর্যন্ত যেতে পারলেই হয়৷ ডাল্টন হাইওয়ে ফেয়ারব্যাংকস থেকে প্রাডোহ বে তে চলে গেছে৷ ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা৷ এলিয়ট হাইওয়ে হয়ে জাংশন পর্যন্ত এর মধ্যে ১৩০ কিলোমিটারের মতো৷ আমাদের টার্গেট সন্ধ্যার আগে এই ১৩০ কিলোমিটার গিয়ে আবার ফিরে আসা (টোটাল ২৬০ কিমি)৷ একটানা চালালে ৩ ঘন্টা লাগার কথা৷ কিন্তু রাস্তায় প্রচুর ট্রাক৷ প্রাডো বে তে আলাস্কার তেলের খনি, আর্কটিক অয়েল ফিল্ড৷ পুরো রাস্তা জুড়ে রাস্তার সমান্তরালে ট্রান্স আলাস্কা অয়েল পাইপ লাইন৷ গল্পে গল্পে রওনা হয়ে গেলাম৷
এখানকার ল্যান্ডস্কেপ ডেনালীর চেয়ে আলাদা৷ পাহাড় একটু কম, রঙও কম৷ ফার গাছের সারি অনেকটা ক্যানেডিয়ান রকির মতো৷ Fall এর জন্য হলদেটে ভাব এসেছে৷ কোথাও কোন লোকালয়ের চিহ্ন নেই৷ মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু তৈগা বনভুমি, ভীষন নির্জন৷ জাংশনে পৌছলাম যখন, তখনও সুর্যের আলো আছে৷ ডাল্টন হাইওয়ের এর পরের অংশ আনপেভড, একদম মাটির রাস্তা না, নুড়ি পাথর ঢেলে রাখা৷ রেন্টাল কারের মালিক আগেই বলে রেখেছিল ডাল্টনের এই অংশে গাড়ি নেয়া যাবে না৷ রাস্তা দেখে বুঝলাম কথা ভুল বলেনি ৬৫০ কিলোমিটার যদি এভাবে চালাতে হয় তাহলে গাড়ির যে কয় জোড়া এক্সট্রা টায়ার লাগবে কে জানে৷
টুকটাক কয়েকটা ছবি তুললাম৷ হট স্প্রিং এ আর যাবো না৷ গাড়িতে খুব পরচর্চা হচ্ছিল৷ প্রাডো বে কিংবা আর্কটিক সার্কেলের চেয়ে লোকের দেখি গল্পেই উত্সাহ বেশী৷ তা ঠিক আছে, সহযাত্রীদের আপবিট থাকা খুব জরুরী৷ সূর্য ডুবতে ডুবতে ফেয়ারব্যংকসের কিনারায় ফিরে এলাম৷ একটা চায়নিজ বাফে তে পেটপুরে খেয়ে রওনা দিলাম আরেকটা উষ্ঞ প্রস্রবনের দিকে Chena Hot Springs৷ এটা তুলনামুলক ভাবে কাছে, ঘন্টা দেড়েক লাগা উচিত৷ রাতে যাচ্ছি কারন ওখানে একটা হোটেল আছে, আর অরোরা দেখার টার্গেট তো আছেই৷ সন্ধ্যায় (রাত দশটায়) রওনা দিয়ে বারোটার দিকে পৌছলাম চেনা-তে৷
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০০৭ রাত ১১:০৫