somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রস্থান

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নূর ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তার সামনেই ছিল নূর ভাইদের মেস। দ্বিতীয়তলা বিশিষ্ট ভবনটির নিচের একরুমে নূর ভাই থাকতেন। বিকেল বেলা কিংবা সন্ধ্যার পর নূর ভাইর রুমে যেতাম। নূর ভাই হাসিমুখে সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলতেন। বায়োটেকনোলজি বিভাগের ছাত্র নূর ভাই স্বপ্ন দেখতেন বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিা নিবেন। মাঝে মাঝে এ বিষয়ে কথা বলতেন। অনার্স শেষ করেই বিদেশে যাবার চেষ্টা করবেন। সংসারে বাবা মা আর এক ছোট ভাই আছেন। বাবার ব্যবসা বাণিজ্যে থাকায় টাকার চিন্তা কখনো করতে হয়নি। বিদেশে কোনো স্কলারশিপ পেলে ভালো হয়। নূর ভাই ওয়েবসাইটে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তথ্য খোঁজ নিতেন। এভাবেই চলতে থাকে নূর ভাইয়ের বিদেশে পড়ালেখার স্বপ্নটা।
তিনশ’ বিশ একর আয়তনের আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টা খুব একটা বড় নয়। নয় হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অনেকেই ছিলেন আমার পরিচিত। আমার কাছে নূর ভাই আর তার হাসিটা ছিল ভিন্ন ধরনের। একই বিল্ডিং এ নূর ভাই ও আমাদের বিভাগ থাকায় কখনো কখনো আমাদের দেখা হয়ে যেত। হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করতাম—‘নূর ভাই কাস কখন?’
‘দশটা বিশে একটা কাস হবে। তারপর আর নেই। বিকেলে রুমে এসো।’
তাঁর মেসের রুমে গেলে কিছুই না কিছু খেতে দিতেন। সামনের আফিক ভাইর দোকান থেকেও মাঝে মাঝে কিছু কিনে এনে খাওয়াতেন। আমাদের বাসার পিসিতে একবার ভাইরাসে আক্রমণ করে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ধ্বংস করে দিল। নূর ভাইকে জানাতেই বলল—‘রিফাত আমার কাছে আপডেট এন্টিভাইরাস আছে নিও।’
শামালি শাহ মসজিদে নামাজ শেষে নূর ভাইর সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরতাম। মাগরিব আর এশা নামাজে বেশি দেখা হতো। পাঞ্জাবি পড়ে নূর নামাজে আসতেন। সময়ে অসময়ে নূর ভাইর রুমে হানা দিতাম। নূর ভাইর রুম মেট আতিক ভাইও ছিলেন প্রিয়। আমার খোঁজ নিয়ে বলতেন—‘তুমি তো সাংবাদিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব খবর তুমি পাও। আমাদের রেজাল্টের খবর সম্পর্কে কিছু জানো?’
আমি শুধু হাসতাম। হাসতাম এই ভেবে আমাকে তাঁরা ভালোবাসেন। ভালোবেসে তাঁদের নিজেদের কথা বলতেন। নূর ভাইও আতিক ভাইয়ের কথার সাথে সুর মিলেয়ে বলতেন—
‘তুমি কবে আমাদের নিয়ে নিউজ করবা। তুমিতো আবার ফিচার ঠিচার লিখো। আমাদের মেস নিয়ে লিখো।’
নূর ভাই বলার আগেই মেস নিয়ে একটা ফিচার যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল। নূর ভাইকে কথা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার নিয়ে কিছু লিখব। কথানুযায়ী এক পড়ন্ত বিকেলে মেসের কয়েকজনকে নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে আড্ডা দিলাম। সবাইকে সাথে নিয়ে ক্যামেরাবন্দী হলাম। নূর ভাই হাসিমুখে ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি হলেন। আমি ছবি নিয়ে শহীদ মিনার বিষয়ক একটা ফিচার তৈরি করে পত্রিকায় পাঠালাম। নূর ভাইকে এ খবর জানালে কবে প্রকাশ পাবে তা যেন আমি বলে দিই। কয়েক দিনের পরই ইত্তেফাকে গ্র“প ছবিসহ ফিচারটি ছাপা হয়। নূর ভাই কথা দিয়েছিল ফিচারটি ছাপা হলে মিষ্টি খাওয়াবেন। মিষ্টি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। মিষ্টি খাওয়ার জন্য নূর ভাই আর আমি একসঙ্গে হতে পারি না। আমার সুযোগ থাকলে তার কাসের ব্যস্ততা। দিন, সপ্তাহ মাস পেরোতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় সামার ভ্যাকাশনের বন্ধ হয়। নূর ভাই ময়মনসিংহ চলে যান। ফেইসবুক আর ফোনে কথা হলে মিষ্টি খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই নূর ভাই বলতেন—‘আরে মিয়া তোমাকে খাওয়াবো। আমার স্কলারশিপটা হলে বেশি খেতে পারবা।’
ভার্সিটি খোলে। এক শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে জিন্দাবাজার পয়েন্টে নামলাম। নূর ভাই বনফুলে ঢুকে আমি কী কী খাবো জানতে চাইলেন। পাটিসাপটা পিঠা, মিষ্টি আর কফি খেলাম। নূর ভাই জানতে চাইলেন—‘আর কিছু খাবা? আরও কিছু খাও মিয়া।’ নূর ভাইর নির্মল হাসিমাখা কথাগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো। যতবার তার মুখের দিকে তাকাতাম ততবারই মনে হতো নূর ভাই সত্যিই অনেক ভালো মানুষ। আমারও ভাগ্য ভালো যে একজন ভালো মানুষ আমার মতো সাধারণ একজনকে ভালোবাসেন। সেদিন মিষ্টি আর পিঠা খাইয়ে নূর ভাই তার কথা রাখলেন। এরপর হাজারো শিার্থীদের মাঝে আমাদের কাস, টার্ম টেস্ট আর পরীা চলতে থাকে সমান তালে। নূর ভাই সিনিয়র হওয়াতে আমার আগেই অনার্স শেষ করেন। দীর্ঘদিন ময়মনসিংহের বাসায় ছিলেন। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। মাস্টার্স হয়তো এখানে করা হবে এমনটি জানিয়েছিল।
হঠাৎ একদিন নূর ভাই মেসে হাজির। মাস্টার্স করার সিদ্ধান্ত নিয়েই আবার এসেছেন এমনটি জানালেন। মাস্টার্স করেই বিদেশে যাবেন। মাঝে মাঝে আমি মেসে ঢু মারতাম। কে কেমন আছে এমনটি জানার জন্যই যেতাম। ছাদে গিয়ে ধামালিপাড়া আর দূর আকাশের দৃশ্য দেখতাম। নূর ভাইও মাঝে মাঝে সাথে থাকতেন। নূর ভাইয়ের মাস্টার্সের কাস চলে। আমিও অনার্স শেষ করে মাস্টার্স এ।
দুজনার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আগের মতো আর মেসে তেমন কারো সাথে গল্প হয় না। হয় না আর কোনো খুনসুটি। জীবনের বহমান গতিতে আমরাও সমান গতিতে এগোতে থাকি। নূর ভাই ব্যস্ত তার পড়াশুনা আর বিদেশে যাবার জন্য।
নূর ভাই মাস্টার্স পরীা দিয়ে বাসায় চলে যান। মাঝে মাঝে ফোনে আলাপ হতো। স্কলারশিপ পেয়ে গেছেন নূর ভাই। বিদেশে যাবার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিমানের টিকিট শুধু বাকি। এসব সবাই জানত। কয়েক সপ্তাহ পরে আমাদের একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় কী যেন কাজে গিয়েছিলাম। সামনের করিডোরে দাঁড়িয়ে আনমনে সামনে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা কালো ব্যানার এর ওপর। ব্যানারে লেখা ‘বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র নূর মোহাম্মদ আর নেই’। নিজের চোখে পড়া এ সংবাদটি কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলনা। জনতা ব্যাংকের অফিসার, গণিত বিভাগের মিলন ভাইকে ফোন দিলাম। মিলন ভাই নূর ভাইদের সিনিয়র, এক সময় একই মেসে থাকতেন।
‘মিলন ভাই, নূর ভাইর খবর কিছু জানেন?’ জানতে চাইলাম।
‘নূর নাকি হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে।’ মিলন ভাই করুণ সুরে উত্তর দিলেন।
নিজের কানে কথাটি কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো।
‘কী বলেন এসব মিলন ভাই?’
‘হুম রিফাত। নূরের নাম্বারে ফোন দিয়েছিলাম। ওর ছোট ভাই রিসিভ করে এসব বলেছে।’
এরপর আতিক আর ওবায়েদ ভাইকে ফোন দিলাম। আফিক ভাইকে জানালাম। নূর ভাইর জন্য সবারই কষ্ট হলো। নূর ভাইয়ের আর উচ্চশিার জন্য বিদেশ যাওয়া হল না। আমার নোটবুকে রাখা কিছু ছবি দেখলাম। নূর ভাই হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কয়েকটা ছবিতে আমিও নূর ভাইয়ের পাশে।
রাতে ঘুমাতে গেলে নূর ভাইয়ের সাথে তোলা ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আমার চোখে ঘুম আসে না। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে নূর ভাইয়ের নাম্বারটার দিকে তাকাই। ইচ্ছে করে নূর ভাইকে ফোন দিয়ে জানতে—‘নূর ভাই স্কলারশিপ নিয়ে তো বিদেশ চলে গেলেন। আমাকে কবে নিবেন?’ মুঠোফোনটা রেখে চোখের জল থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×