কাতার এসে পৌঁছেছিলাম একদিন মধ্য রাতে। সবচেয়ে ভালো এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে খারাপ ফ্লাইটটিতে। পরে জেনেছিলাম কাতার এয়ারওয়েজের বাংলাদেশ রুটে প্লেনের অভাব পড়লে নাকি আদ্যিকালের এই প্লেনটা দিয়ে ঠেকা কাজ চালানো হয়। প্রচণ্ড ঠাসাঠাসি পরিবেশে না ছিলো সিটটাকে একটু হেলানোর ব্যবস্থা, না একটু বের হয়ে হাঁটার মতো জায়গা। আমাদের যেকোন আন্তঃজেলা বাসের সবচেয়ে খারাপটিতেও এরচেয়ে অনেক বেশী আরামের ব্যবস্থা আছে ভেবে এতগুলো পয়সা খরচ করে কেনা টিকেটটার জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ভাগ্যিস বোর্ডিং পাস নেয়ার সময় বলেছিলাম জানালার পাশে একটা সীট দিতে - জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কোন রকমে পার করা গেছে দুঃসহ সাড়ে-পাঁচটা ঘন্টা। যদিও প্লেন ওঠা এবং নামার সময় ছাড়া অন্ধকার ছাড়া দেখার মতো আর ছিলোনা কিছুই। এক ধাক্কায় প্লেনটা যখন উপরে উঠে গেলো, কৃত্রিম আলোয় আলোকিত মাতৃভূমির বিরাট একটা অংশ উপর থেকে একসাথে দেখতে অপূর্ব লাগছিল। এরপর প্রিয় শহরের সব আলো পেছনে ফেলে শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া - জানালার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শুধুই এলোমেলো ভাবনা।
দোহা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে যখন রাতের শহর দেখতে দেখতে যাচ্ছি, খুব বেশী পর্থক্য মনে হয়নি ঢাকার সাথে। শুধু মনে হচ্ছিল শহরটা বেশ পরিষ্কার, আর রাস্তাগুলো খুবই চওড়া। কোন জানজট নেই, রিকশা নেই, এমনকি বাসও চোখে পড়ে না। সিগনালগুলোতে কোন পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে হাত উচিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে না গাড়ির চলাচল, তারপরেও কেউ তা অমান্য করে চলে যাচ্ছে না। এর কারনটা অবশ্য জেনেছিলাম পড়ে। আসলে রাস্তা-ঘাটের প্রচণ্ড কঠিন আইন এবং সেটার অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগের কারনেই এই অবস্থা। সেই আইনের কিছু নমুনা দেয়া যাক।
প্রতিটা গাড়ি রাস্তায় নামতে হলে অবশ্যই লাগবে রুট পারমিট। সেটা প্রতি বছর নবায়ন করতে হবে। এটাকে আরবীতে বলে "ইস্তেমারা"। গাড়ীর ইস্তেমারা শেষ হয়ে গেলে সেটাকে নবায়ন করার জন্য সময় দেয়া হয় এক মাস। দেরী হলে প্রতিদিন হিসেবে দিতে হবে জরিমানা। ইস্তেমারা লাগানোর আগে করতে হয় ফিটনেস চেক। সেজন্য একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া আছে। তারা খুটিয়ে খুটিয়ে চেক করে গাড়ির বডি থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত সব কিছু। কোথাও বিন্দুমাত্র সমস্যা থাকলে সেগুলো ঠিকঠাক করে আবার চেক করিয়ে নিতে হবে ফিটনেস সার্টিফিকেট। গাড়ির পেইন্টে কোথাও সামান্য ফাটা থাকলেও সেটা "মেজর ফল্ট"। আর ভেতরে সমস্যা হলে তো কথাই নেই। এই কারনে ঢাকার রাস্তার মতো লক্কর-ঝক্কর গাড়ির কোন কমতি দোহার রাস্তায় না থাকলেও সেগুলো সমন্ধে এই নিশ্চয়তা দেয়া যায় যে, গাড়ীর দোষে অন্তত দূর্ঘটনা ঘটবে না। এরপর করাতে হবে গাড়ীর সাধারন-বীমা। তৃতীয় পক্ষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এই বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোন দূর্ঘটনা ঘটলে যে গাড়ীর দোষ প্রমানিত হবে, সেই গাড়ীর বীমা কোম্পানী অন্য গাড়ীটি ঠিক করে দেবে। আর বীমার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে দোষী গাড়ীর ড্রাইভারকে পকেটের টাকা দিয়ে অন্য গাড়ীটি ঠিক করে দিতে হবে। ফিটনেস রিপোর্ট এবং বীমার সার্টিফিকেট নিয়ে পুলিশ ষ্টেশনে গেলে তবেই হবে ইস্তেমারা।
এই তো গেলো গাড়ীর আইন। এবার আসি ড্রাইভারের কথায়। কেউ সিগনাল অমান্য করে চলে গেলে দিতে হবে ছয় হাজার রিয়েল জরিমানা। আর উল্টা রাস্তায় গাড়ী চালালে পঞ্চাশ হাজার রিয়েল। সীট বেল্ট না বাধলে, বা সামনের সীটে দশ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের বসালে, অথবা রাস্তার সর্বোচ্চ গতিসীমা অতিক্রম করলে জরিমানা পাঁচশ রিয়েল। সমান জরিমানা গাড়ী চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে। তবে মোবাইলের হেড-ফোন ব্যাবহার করলে কোন সমস্যা নেই। পাঁচশ রিয়েল জরিমানাগুলো ছাড়া বাকী সবগুলোর ক্ষেত্রেই রয়েছে জেলের ব্যবস্থাও। কাতারীদের সীটবেল্ট বাধা না থাকলে পুলিশ প্রায় সময়ই তাদের ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিদেশী হলে সাথে সাথেই জরিমানা। এছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে কারো জন্য কোন ছাড় নেই। কোন গাড়ীতে যাত্রী বেশী তুললে দিতে হবে জরিমানা। জরিমানা হবে মালবাহী গাড়ীগুলো অতিরিক্ত লোড করলে। সব ধরনের গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট ওজন ঠিক করা আছে পরিবহনের জন্য। ওভারলোডিং হলেই জরিমানা তিন হাজার রিয়েল। এই একটা আইনের কারনেই এক ধাক্কায় কাতারের নির্মান খরচ বেড়ে গেছে অনেক।
রাস্তার সবচেয়ে মজার আইন হলো সর্বোচ্চ গতিসীমার আইনটি। রাস্তার আইনগুলো কেউ অমান্য করছে কিনা সেটা দেখার জন্য সব গুরুত্বপূর্ন সিগনালে এবং বড় রাস্তার মাঝে বসানো আছে রাডার এবং ক্যামেরা। কেউ গতিসীমা অতিক্রম করলে বা সিগনাল অমান্য করলে রাডার সেটা ডিটেক্ট করবে এবং সাথে সাথে কয়েকটা ছবি তুলে নিবে ক্যামেরা। গাড়ী এবং ড্রাইভার দু'জনেরই ছবি উঠে যাবে মুহূর্তে। ওয়েব সাইট থেকে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে যে কেউ চেক করতে পারে তার কোন ট্রাফিক ভায়োলেশন হয়েছে কি না। বাধ্যতামূলকভাবে জরিমানা দিতে হবে ইস্তেমারার সময়। কোন মাফ নেই। অন্যথায় ইস্তেমারা লাগবে না। অনাদায়ে জেল। গতিসীমার আইনটি মজার বললাম এই কারনে যে, প্রায় সবাই এই আইন ভঙ্গ করলেও এতে ধরা খাওয়ার সংখ্যা খুবই নগন্য। দেশটা অত্যন্ত ছোট হওয়ায় কোন রাস্তার মাঝখানে কোন জায়গায় রাডার আছে তা সবার মুখস্ত। তাই সবাই আশির রাস্তায় নিশ্চিন্তে একশ-বিশ গতিতে গাড়ী চালায়। শুধু রাডারের সামনে এসে ভেজা বেড়ালটির মত গাড়ির গতি কমিয়ে সীমার মধ্যে নিয়ে আসে। পার হয়ে গেলে আবার একশ-বিশ! এ কারনে একমাত্র নতুন ড্রাইভাররা ছাড়া আর কেউই এতে তেমন ধরা খায় না। এত কঠিন যেই দেশের আইন, এবং যথাযথ যার প্রয়োগ, সেই দেশে কি দূর্ঘটনা ঘটা সম্ভব?
তারপরেও দূর্ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ দূর্ঘটনা। আর তার কারন আরবদের দূর্দান্ত স্বভাব। এদেশে এডভেঞ্চারের কোন সুযোগই নেই। দেশটার এমনিতেই নেই কোন প্রাকৃতিক বৈচিত্র, তার উপর আছে কঠোর ইসলামী আইন। তাই উঠতি বয়সের আরবদের একমাত্র এডভেঞ্চারের ব্যবস্থা হচ্ছে গাড়ী। সবারই আছে অন্তত একটি ল্যান্ডক্রুজার। সেই গাড়ী এরা চালায় জীবনের কোন তোয়াক্কা না করে যেভাবে খুশি সেভাবে। গোলচক্করে এমনভাবে গাড়ী ঘোরায় যে গাড়ীর দুই চাকা থাকে মাটিতে, বাকী দু'টো আকাশে। কোন সিগনাল না দিয়ে লাইন পরিবর্তন করে এক সূতা সামনে দিয়ে যখন ক্রস করে চলে যায়, গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। প্রায়ই এমন দূর্ঘটনা ঘটে যে, তিন-চার গাড়ীর প্রায় কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই প্রতিদিন ঘরে ফেরার সময় যখন শেষবারের মতো গাড়ী পার্ক করি, মনে মনে বলি, হে আল্লাহ্! তোমার হাজারো শুকরিয়া যে অক্ষত দেহে ঘরে ফিরিয়ে এনেছো।