বিশ শতকের বিশের দশকের কথা। বাংলার কাব্যাকাশে তখন নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ প্রখর রবির মতই দেদীপ্যমান। তাঁর একচ্ছত্র, উজ্জ্বল কাব্যচ্ছটায় বাকি কবিরা নিতান্তই ম্লান, অনুজ্জ্বল। এমনই এক সময় সেই আকাশে অত্যুজ্জ্বল ধূমকেতুর মত উদয় হলেন মাত্র বাইশ-তেইশ বছরের এক অর্বাচীন যুবক। নাম তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম। একের পর এক বিপ্লব ও দ্রোহের কবিতা লিখে তিনি কাঁপিয়ে দিলেন বাংলা কবিতার ভিত। সে কাঁপন সুদৃঢ় কাব্য-সিংহাসনে আসীন রবীন্দ্রনাথও টের পেয়েছিলেন বেশ ভালভাবেই। কবি-সেনাপতি নজরুল ঝড়ের বেগে এলেন, দেখলেন, জয় করলেন বাংলা কবিতার রাজ্য।
যে কবিতাটি নজরুলকে তাঁর কবি-জীবনের শুরুতেই খ্যাতির চরম শিখরে নিয়ে যায়, তার নাম ‘বিদ্রোহী’। নজরুল দ্রোহ-ভাবাপন্ন আরও অনেক কবিতা লিখলেও শুধু এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি বাঙালির চিরকালের ‘বিদ্রোহী কবি’। এরকম অসাধারণ শব্দচয়ন, স্বতন্ত্র ভাষারীতি ও অভিনব ছন্দের গাঁথুনিতে রচিত বিদ্রোহ-দৃপ্ত, রুদ্ররোষে বলীয়ান কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর একটিও নেই। এমনকি বিশ্বসাহিত্যেও এর তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার।
ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশের পরাধীন। প্রথম মহাযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। নজরুল তাঁর সৈনিক জীবন সমাপ্ত করে ফিরে এসেছেন কলকাতায়। বেছে নিয়েছেন সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের এক ত্রিমুখী জীবন। ব্রিটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষ তখন টালমাটাল। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করলেন। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। একই সাথে তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
এমনই এক উত্তাল সময়ে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে নজরুল রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ইংরেজি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ তারিখে। কবিতাটি প্রকাশ হওয়া মাত্র এমনই জনপ্রিয় হয় যে, একই সপ্তাহে প্রকাশক পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করে। এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (পত্রিকাটি অনিয়মিত হওয়ায় বাংলা ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল) ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারও ছাপা হয়। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’ এবং মাসিক ‘বসুমতী’ এবং পরের বছর (১৩২৯ সালে) মাসিক ‘সাধনা’য় পূনঃপ্রকাশিত হয়।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই পূনঃ পূনঃ প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। বস্তুত এই কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো ঘটনা। পরাধীনতার আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী, হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন বার্তা। তাদের হয়ে যেন নজরুল বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন:
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
নজরুলের এই রুদ্ররোষ যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক তাঁর একাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ বাজেয়াপ্তকরণ ও তাঁকে কারাদণ্ড প্রদান তারই প্রমাণ। কথিত আছে, এই কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই নজরুল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন এবং কাব্যাবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “গুরুদেব, আমি আপনাকে খুন করব, খুন।” ‘বিদ্রোহী’র এই বিজ্রনিনাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, কাজী, তুমিই পারবে আমাকে খুন করতে।” বস্তুত সেদিন থেকেই তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা অটুট ছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত। নজরুলের রবীন্দ্র-ভক্তি ও রবীন্দ্রনাথের নজরুল-মমতার সে আরেক অসাধারণ, শ্রুতিমধুর উপাখ্যান।
তারপর ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় এটি আরও বারোটি কবিতার সাথে স্থান পায়। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশ করেছিল কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস। এর প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহোদর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অংকন করেছিলেন শিল্পী বীরেশ্বর সেন। ‘অগ্নিবীণা’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রকাশের সাথে সাথেই এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারপর আরও কয়েকটি সংস্করণ বের হয়েছিল। বিদ্রোহী-ভাবাপন্ন কবিতা-সম্বলিত ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের উছ্বসিত প্রশংসা তখন বেরিয়েছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায় এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত লেখকদের লেখায় লেখায়।
বাঙালি জাতির ইতিহাস চিরায়ত দ্রোহের ইতিহাস। দু’শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এ জাতি বারবার আন্দোলন, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ করেছে। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের এক ক্রান্তিলগ্নে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্ম হয়েছিল। কবিতাটির বিষয়বস্তু প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। তবে এ প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ কেবল পরাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, বরং সকল অন্যায়-অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে। শাসক, শোষক, পীড়কের বিরুদ্ধে এ লড়াই শাসিত, শোষিত ও পীড়িতের। এ চিরন্তন লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের জন্য কবি এমন এক বীরের কল্পনা করেছেন, যে বীরের ‘চির উন্নত শিরে’র স্বরূপটি তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে:
বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
পরাধীনতার শৃঙখল ভেঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্মের নব্বই বছর পরও আজতক রাষ্ট্রের জনগণ রাজনৈতিক দুঃশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পায় নি–জনগণের প্রকৃত শাসন কায়েম হয় নি। সুতরাং যতদিন এই জনবিরোধী শাসন-শোষণ বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এসবের বিরুদ্ধে মানুষের সোচ্চার হওয়ার স্বার্থে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রয়োজনীয়তাও থাকবে। অন্যদিকে আজও সামাজিক নিপীড়ন-নির্যাতন ও মানুষে মানুষে শ্রেণীবৈষম্য চরমভাবে বিরাজমান। এসব সামাজিক অনাচারের প্রেক্ষিতে নজরুলের সেই বিদ্রোহ-দৃপ্ত উচ্চারণের প্রাসঙ্গিকতা তাই এখনও ফুরিয়ে যায় নি:
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন সব শান্ত
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দণ-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
তাই বাঙালির বিদ্রোহী, প্রতিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবেদন আজও অম্লান, অপরিসীম। এ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা সর্বকালীন, সার্বজনীন। বাঙালির সংগ্রাম ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্রোহের কবি নজরুল ও তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ‘চির উন্নত শির’ নিয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগান্তর।
আমার প্রিয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্ম জয়ন্তীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাই।
সবশেষে : লেখাটি শামিম ফয়সল ভাই ২৫ মে ২০১১ইং তারিখে আমার লেখা ব্লগে প্রকাশ করেন। নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তি উপলক্ষে আপনাদের সাথে লেখাটি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না তাই এ লেখাটি পোস্ট করলাম। ধন্যবাদ শামিম ফয়সল ভাইকে এত অসাধারণ একটি লেখার জন্য।
তথ্যসূত্র:
বাংলাপিডিয়া , বাংলা উইকিপিডিয়া , আন্তর্জালে প্রকাশিত নজরুল-সংক্রান্ত অন্যান্য লেখা ও আমার লেখা ব্লগ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৪ সকাল ৮:৪২