জুতা হাতে নিয়ে হাটছি।
ইচ্ছে করে হাটছি তা নয়, জুতাটা নেহাৎ ছিড়ে গেছে বলেই খালি পায়ে হাটা।
নাহলে এই শীতের রাতে কে হাটতে যাবে খালি পায়ে?
সে যাহোক, আজকের চাঁদটাকে অনেক বড় লাগছে।
যদিও পূর্ণিমার বাকি আরোও তিনদিন!
খালি পায়ে হাটার জন্য, আজ রাস্তার চারপাশের পরিবেশ
বাদে আমার নজর নিচের দিকেই বেশি।
খালি পায়ে না হাটলে বোঝা যায়না, পীচঢালা মসূন রাস্তায় কতটা পরিমান পীচ উঠা উঠা থাকে!
এতরাতে কোন মুচিকেও পাওয়া যাবেনা, সুতরাং আজ রাতটা খালিপায়েই যাবে।
ব্যপার নাহ্!
একটু আগে হাটতে হাটতে একটা ইয়ারফোন পেলাম।
সেটা কাজ করে কিনা,
সেটা জানা এমূহুর্তে সম্ভব নয়।
পকেটে দরকারি জিনিসছাড়া বাড়তি করে মোবাইল রাখা আমাকে শোভা পায়না।
তবু কিছু করার নেই, অগত্যা ইয়ারফোনটা কানে লাগিয়েই হাটছি।
খানিক ডাক্তার ডাক্তার অনুভূতি পাচ্ছি।
আমি হাটছিলাম 'বাতিঘর' এর সামনে দিয়ে।
সামনেই তিন রাস্তার মোড়।
আপাতত তেরাস্তার মোড়ে কিছুক্ষণ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম!
খানিকবাদেই চকবাজারের দিক থেকে একটা পুলিশের জীপ এসে আমার সামনে দাড়ালো।
এতরাতে খালিপায়ে,কানে ইয়ারফোন লাগানো কাউকে হয়তো পুলিশরা দেখতে পারেনা।
কনস্ট্যাবল নেমে এসে চোখ সরু করে তাকালো আমার দিকে,
সুন্দর করে সালাম দিলাম,
- 'জনাব, স্লামুআলাইকুম'
জবাব না দিয়ে চোখটা আরোও সরু করে তাকালো।
অবস্থা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না!
- 'এত রাতে খালিপায়ে এখানে কি?'
- 'আমার জুতা ছিড়ে গেছে তাই মুচি খুজতে এসেছি।'
- 'এত রাতে মুচি কি আকাশ থেকে আসবে এখানে? ইয়ার্কি হচ্ছে আমার
সাথে! নাম কি??'
- 'জ্বী, নাম স্বচ্ছ'
- 'এটা কারোও নাম হয় নাকি?? বুঝেছি, উল্টা পাল্টা খেয়ে ভুলভাল বকছিস! কানে ওটা কি দেখি!!'
বলেই টান দিয়ে কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে নিলেন।
- 'এ কি! খালি ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে ঘুরছিস কেনো??'
- 'এটা একটু আগে রাস্তায় পেয়েছিলাম।
কানে বাতাস ঢুকছিলো তাই ঢুকিয়ে রেখেছিলাম'
বলে একটা অমায়িক হাসি দিলাম।
ইয়ারফোনটা নিজের সিম্ফোনি এক্সপোলা পি১০ এ লাগাতে লাগাতে বললেন,
- 'কি করা হয়? বাসা কই?'
- 'অনার্স পড়ছি। থাকি মেস ভাড়া করে।'
ধুর নষ্ট! বলে ইয়ারফোনটা ছুড়ে ফেলে বললেন,
- 'এত রাতে রাস্তায় হাটা
ভালো মানুষের কাজ না। মেসে যাও, গিয়ে ঘুমাও। কাল সকালে জুতা সেলাই করো।'
বলেই গাড়িতে উঠে গেলেন।
দরজা লাগানোর আগে বললেন,
- 'রাস্তা কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস পকেটে তুলতে নেই...ইমরান গাড়ি স্টার্ট দাও'
আমি নিচু হয়ে ইয়ারফোনটা কুড়িয়ে নিলাম।
আবার হাটা শুরু করলাম।
... ...
সামনে তিথীদের বাসার গলি।
অনেকদিন মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি।
গলির সামনে এসেও দেখা না করাটা বেমানান লাগে!
দো'তালার বারান্দার সাথে লাগোয়া রুমটায় তিথী থাকে।
রুমে আলো জ্বলছে।
এতরাতে জেগে নিশ্চয়ই পড়ছে। সামনে ইয়ার ফাইনাল এক্সাম।
এতরাতে ডাকাটা কি ঠিক হবে?
নাহ্ তিথীর
বাবা মা শুনলে সমস্যা হবে।
আরেকটা কাজ অবশ্য করা যায়, তবে রিস্ক আছে!
কিছু উপায় নেই...
পাচিল টপকে কদমগাছটা বেয়ে বারান্দার পাশের জানালার কার্নিসে দাড়ালাম।
হ্যা এবার ডাক দেয়া যায়।
কয়েকবার 'বীটার...বীটার'বলে ডাক দেয়া পর শংকিত হয়ে বারান্দায় এলো তিথী।
শব্দের উৎস খুঁজে আমাকে দেখে শংকা ভাবটা কেঁটে গেলো।
ভেবেছিলাম, সিনেম্যাটিক এই এপ্রোচ দেখে তিথী বেশ অবাক হবে অথবা উচ্ছাসমাখা গলায় হালকা চেচিয়ে উঠবে,
নাহ্...মেয়েটা উল্টো বারান্দার গ্রিলে হাত দিয়ে চিড়িয়াখানার বাঁদর দেখার মত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
বললাম,
- 'হ্যালো! কি করো?'
গায়ের জড়ানো শালটা আরোও জড়িয়ে ভাবলেশহীন ভাবেই উত্তর দিলো,
- 'হ্যালো...এতরাতে কি মনে করে?'
- 'অনেকদিন দেখিনা তোমায়, মনটা কেমন কচকচ করছিলো! তাই দেখতে এলাম'
হাই চাপতে চাপতে তিথী বললো,
- 'ও..'
- 'খুশি হওনি?'
- 'এমন স্পাইডারম্যানেরমত আচরণে
যে কেউই খুশি হবে...মোবাইল কিনলে কবে? কানে ইয়্যারফোন!?'
- 'ওহ্...এটা তোমার জন্য গিফট! একটু লাগিয়ে দেখছিলাম ঠিকঠাক আছে কিনা। মোবাইল কিনতে যাবো কেনো?'
- 'ওহ্ তাই বলো...রাতে খেয়েছো কিছু? দাড়াও একটু আমি আসছি।'
এই বলে, ভিতর থেকে একটা প্লেট নিয়ে আসলো।
প্লেটে ঠান্ডা ২টা রোল,কিছু মাংস।
'কাছে সরে আসো' বলে চামচে করে মাংস গ্রিলের ফাক দিয়ে বাড়িয়ে দিলো।
চুপচাপ খেয়ে নিলাম।
'আরেকটু দাড়াও' বলে আবার ভিতরে গেলো।
তারপর বোটলে করে পানি এনে দিলো।
মুশকিল হলো বোটল তো গ্রীল দিয়ে আসবেনা।
অনেক জোরাজুরির পর হাল ছেড়ে দিয়ে
বললো,
- 'স্যরি...পানি খাওয়াতে পারলাম না!'
- 'থাক...মাংসটায় লবন বেশি হয়ে গেছে।'
- 'হুমম...এখনি চলে যাবে?'
বলে অদ্ভুত রকম মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো তিথী।
এই মায়াটাকেই বড্ড ভয় পাই।
যে কারণে ইচ্ছা করেই তিথী থেকে দূরে থাকি!
কিছু বললাম না।
ইয়ারফোনটা খুলে ওর হাতে
দিলাম।
- 'তিথী তোমাকে সুন্দর লাগছে।'
- 'হুম...'
- 'চোখের নিচটা ডেবে গেছে হালকা, হয়তো সেজন্যই'
- 'হুম..'
- 'আজ চাঁদের আলোটা খুব তীক্ষ্ণ তাইনা? চাদের আলোয় তোমাকে অন্যরকম লাগছে'
- 'হুম..'
- 'তুমি কি খালি হুম হুম করবে? কিছু বলবেনা?'
- 'তুমি আগের মতই আছো'
- 'জানি তো'
- 'অনেক রাত হয়ে গেছে'
- 'চলে যাবো?'
- 'থাকতে বললে, থেকে যাবে?'
- 'বলে দেখো?'
তিথী চুপ করে আছে।
বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, কদমগাছের পাতায় শিশির জমেছে।
- 'বীটার, অনেকক্ষণ তো হলো। যাই..'
কোন উত্তর নেই!
- 'কি হলো, বিদায় দাও!'
- 'তুমি এমন কেনো?'
তিথীর দিকে তাকালাম, সেই মায়াভরা চাহনী।
নাহ্ এই চোখগুলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না।
এ দৃষ্টিগুলোর জন্মই হয়েছে, মায়ায় বাঁধার জন্য।
নাহ্ আর থাকাটা উচিত হবেনা।
আস্তে করে নেমে এলাম কার্নিস থেকে।
রাস্তায় এসে দেখি তিথী গ্রীল ধরে তাকিয়ে আছে।
আমি নিচু হয়ে
জুতো হাতে নিলাম।
উঁচু করে দেখালাম, ছিড়ে গেছে।
চাঁদের আলোয় একটু হাসতে দেখলাম।
হাত নেড়ে বিদায় দিলাম, কবে দেখা হবে আবার কে জানে?
তিথীও ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
শুধু অভ্যস্ত হতে পারলাম না আমি,
চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পারছি, মেয়েটার চোখে পানি।
ঠোটটা নেড়ে কিছু বললো...
না বুঝলেও জানি কি বলতে চেয়েছে।
পিছু ফিরে হাটা শুরু করলাম।
আকাশের চাঁদটাকে ঝাপসা দেখাচ্ছে এখন।
কোথায় যেনো শুনেছিলাম,
চন্দ্রাহতদের সব কিছু বুঝাতে নেই।
চন্দ্রাহতদের সবকিছু দেখাতে নেই।
হয়তো তাই.... . . . .