১. জব্বার মিয়া দাড়িয়ে আছে রিকশার হেন্ডেল ধরে। চোখে টলমলে ভাব। তার চেয়েও বেশী ফুটে আছে উদ্বেগ। একটা পেসেনজার খুঁজছে। তার রিকশা চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস মনে করার অবকাশ নেই তার আজ। তবে মনে করলে দেখতে পেত কোনদিন এতটা হন্যে হয়ে যাত্রী খোঁজা হয়নি। এমনিতে পার্কের সামনে যাত্রীর অভাব হয়না। অথচ আজ একটাও মিলছে না। সামনে এগিয়ে যাবে কিনা ভাবছে-ঠিত এমন সময় পার্ক গেট থেকে একজোড়া কোপত-কোপতি বেরিয়ে আসল। সোজা তার দিকেই আসছে। হাতছাড়া হবার ভয়ে সেও একটু এগুলো। 'মামা ঘন্টা হিসাবে ঘুরবা?' ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। জব্বার মিয়া একটু চিন্তা করে বলে দিল, 'হ। দেড়শ কইরা লাগব।' ছেলেটা কিছু না বলে মেয়েটাকে ইশারা করল। মেয়েটা সিটে উঠে বসল। তারপর ছেলেটা বসে হুডটা টেনে দিল। শহরের বাইরের দিকে চলতে শুরু করল জব্বার। খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোটা ঘাম ঝড়ে পরল। শরীরটা ঝিম মেরে গেছে। তবে অনুভূতিটা ভোঁতা। আধঘন্টা যাবত্ রিকশা চলছে। ছেলেমেয়েগুলোর রসালো কথাবার্তাগুলো অন্যকোনদিন হলে জব্বারকে আকর্ষন করত। কিন্তু আজ করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু গতি শ্লথ হচ্ছে না। মিনিট দশেক পর পেছনের ছেলেমেয়েগুলোর ঝগড়া লেগে গেল কিছু একটা নিয়ে। রিকশা চালানোর ধ্যানে থাকায় ব্যাপারটা স্পর্শ করল না জব্বার মিয়াকে। স্পর্শ করল যখন মেয়েটা চিত্কার করে বলল,'মামা রিকশা থামান!' জব্বার তাড়াতাড়ি রিকশা থামায়। তারচেয়েও তাড়াতাড়ি মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে গেল। ছেলেটাও পেছন পেছন হাটা দিল। জব্বার মিয়া ছেলেটাকে বলল,'মামা ভাড়াডা?' ছেলেটা বিরক্ত দৃষ্টিতে জব্বারের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি একটা নোট তার হাতে গুজে দিয়ে আবার মেয়ের পেছন ছুট লাগায়। জব্বার মিয়া নোটটা একপলক দেখে আবার ছেলেটার দিকে এগুয়। কিন্তু তার বৃদ্ধ পা তরুণ পাগুলোর সাথে পারল না। হাতের দশটাকার নোটটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। এবার চোখের কোনে ঘামের সাথে দুয়েক ফোটা পানিও জমে।
২. জব্বার মিয়ার মাথাটা থাপ্পর খেয়ে ঝিম মেরে গেছে। অবাক হয়ে সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ছেলেটা বেঁচে থাকলে এর সমান হতো হয়তো। আজ এ ছেলে তাকে থাপ্পর মারল। শুধু পাঁচটা টাকা বেশি চাওয়ায়। রাস্তার আশপাশে লোক জড়ো হয়ে গেছে। তবে কেউ কিছু বলছে না। কারো কারো চোখে সহানুভূতি। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসল না। কারণ সে একটা রিকশাওয়ালা।
৩. বিকেলের দিকে বসতিতে ফিরল জব্বার মিয়া। ঘরে বসে আছে তার স্ত্রী। এমনিতে জব্বার বাড়ি ফিরলে তাকে হাতমুখ ধোয়ার পানি দেয়া হয়। এরপর খাবার। আজ তার কিছুই হলো না। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে স্ত্রীর দিকে তাকায় জব্বার। শাড়ির গিট থেকে পাচ হাজার টাকা বের করে দিল মর্জিনা বেগম। শত বিপদেও যে স্বর্নের চেনটা সে বিক্রি করেনি আজ তা বিক্রি করেছে সে।
৪. একটা কবরের সামনে দাড়িয়ে জব্বার আর মর্জিনা। সকাল থেকে মোট চারশ টাকা আয় হয়েছিল। মহাজনকে বলে আজকের জমার টাকাসহ ছয়শ টাকা এনেছে ধার। মোট একহাজার। বউএর গয়নাসহ ছ হাজার। এর মাঝে চার হাজার মর্গ থেকে লাশ আনতে খরচ হয়েছে। আর দাফনে আঠেরোশ। সকালে তার কলিজার টুকরা মেয়েটা মারা গেছে। পেটে ছমাসের বাচ্চা। বাচ্চাটা জারজ হলেও তার নাতি তো। শেষতক লাশটা আনা গেছে বলেই হয়তো তার মুখটা প্রসন্ন। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে স্ত্রীকে নিয়ে আগায় জব্বার। ভোরে গেরেজে যেতে হবে তার।
.
২২/০৮/২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৩৯