আগে থেকেই ঠিক করা ছিল কয়েক বন্ধু মিলে যাব কুয়াকাটা তারপর সেখান থেকে ঝালকাঠিতে এক বন্ধুর মামার বাসায়। প্রথমে যাব লঞ্চে করে বরিশাল তারপর সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটা। কিন্তু কপাল খারাপ যেইদিন যাওয়ার কথা সেইদিনই জানতে পারলাম সমুদ্র উপকূলে ৪ নং বিপদ সংকেত দেখান হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম প্ল্যান এখন চেঞ্জ করা যাবেনা। ৪ নং বিপদ সংকেত আর এমন কি। আমরা পৌছতে পৌছতেই হয়ত আর বিপদ সংকেত থাকবেনা। তাই কুয়াকাটাতেই যাব কিন্তু কারও বাসায় বলা যাবেনা। বলা হবে আরেক বন্ধুর দাদাবাড়ি কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা।
এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তা ঘুর্ণাক্ষনেও বুঝতে পারিনি।.....
লঞ্চের দুইটা কেবিন আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল। সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করে বরিশাল পৌছলাম পরদিন সকালে। সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটায় পৌছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। কুয়াকাটায় বাস থেকে নামতেই বিভিন্ন আবাসিক হোটেলের দালালেরা আমাদের ঘিরে ধরল পারলে টেনেই তাদের হোটেলে নিয়ে যায়।
একটা হোটেল পছন্দ হতে সেখানেই উঠলাম। মালপত্র রেখেই ছুটলাম সমুদ্র সৈকতে। কিসের কি বিপদ সংকেত। মানুষজন কম হলেও অনেকেই দেখি সমুদ্রে দাপাদাপি করছে। সবই স্বাভাবিক। আমরাও হৈ হৈ করে ফুটবল খেলায় মেতে উঠলাম। কিছু দূরে ছাউনির নিচে কিছু জুটিকে দেখলাম জড়াজড়ি করে চুমু খাচ্ছে। আমরাও সেখান দিয়ে ইচ্ছা করেই কিছুক্ষন দৌড়ঝাপ দিয়ে তাদের বিরক্ত করলাম।
সন্ধ্যা হতেই হোটেলে ফিরে আসলাম। রাতে খবর পেলাম ১০ নং বিপদ সংকেত দেখান হয়েছে। মাইকিং করেও বলে দেয়া হল সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে। সমুদ্র সৈকতে গেলাম অবস্থা দেখতে। দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের তর্জন গর্জন শুনলাম। পানিও খুব দ্রুতই বাড়ছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়াতে হোটেলে ফিরে এলাম। সবার মোবাইলে ততক্ষনে কল ও ম্যাসেজ করা শুরু করেছে উৎকন্ঠিত বাবা-মা। নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। কোনমতে সবাই জানালাম যে আমরা কিশোরগঞ্জে পাকা দালানের মধ্যে নিরাপদেই আছি।
সবাই মিলে সিদ্বান্ত নিলাম কুয়াকাটায় থাকা চলবেনা। পরদিন দুপুর থেকে মাঝরাতের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে। বরিশালেও ঝড় আঘাত হানবে জেনেও ঝালকাঠিতে বন্ধুর মামার বাসাতেই যাবার জন্য মনস্থির করলাম। পরদিন সকালে রওনা দিলাম বাসে করে। দুপুরে গিয়ে ঝালকাঠিতে পৌছলাম। সেখান থেকে একটা ছোট নদী পার হয়ে এরপর টেম্পো করে পোনাবাইলা নামক গ্রামে বন্ধুর মামার বাড়িতে পৌছলাম। সারাদিনই বৃষ্টি থাকায় বাসাতেই ক্যারম ও তাস খেলে কাটিয়ে দিলাম। তখনোও পর্যন্ত নিশ্চিত মনেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন বর্ষাকালের আমেজ। রাতে যে ভয়ংকর এক ঘূর্ণিঝরের অভিজ্ঞতা হবে তা বোঝা যাচ্ছিলনা।
সন্ধ্যার পর বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। ইলেকট্রিসিটি আগেই চলে গিয়েছে। কোন কোন জায়গায় পানি উঠা শুরু করেছে শুনে আমরা রাতের খাবার তাড়াহুড়ার মাঝে শেষ করে বন্ধুর মামার টিনের বাড়ি ছেড়ে পাশেই আরেক দুঃসম্পর্কের মামার পাকা দালানে আশ্রয় নিই। আশপাশের আরও অনেক গ্রামবাসীও আসে আশ্রয় নিতে।
যতই সময় যাচ্ছিল বাতাসের গর্জন ততই বাড়ছিল। সিডর প্রবল আঘাত হানে প্রায় রাত এগারটার সময়। প্রচন্ড শক্তিতে আশপাশের গাছপালা ও বাড়িঘরের উপর আছড়ে পড়ে। কতকগুলো টিনের বাড়ির চাল উড়ে যায় মুহূর্তেই। বিশাল বিশাল গাছও পরাস্ত হয়ে নুয়ে পড়ে, উপড়ে যায়। পাকা দালানটাকেও নিরাপদ মনে হচ্ছিলনা। সবাই একমনে দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে। ছোটবাচ্চারা কেঁদে উঠে। অনেকেই বলে উঠে, ঐ আজান দে, আজান। কেউ একজন আজান দিয়ে উঠে। মাঝে-মধ্যে অল্প একটু জানালা খুলে টর্চ মেরে দেখলেই দেখা যায় আশপাশের গাছপালার উপড় দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ রূপ প্রায় এক ঘন্টার মত স্থায়ী থাকে এরপর দুর্বল হয়ে যায়। বাতাসের গর্জন শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে বাইরে বের হয়ে মনে হল এক ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। বেশিরভাগ গাছই আর আস্ত নেই। অনেক বাড়ির চাল উড়ে গেছে। আমরা প্রথম যে টিনের বাড়িতে ছিলাম সেটারও একাংসের চাল উড়ে গেছে। পাশের পুকুরটাও ভাঙ্গা গাছপালায় ভর্তি। বাড়ির মানুষজনের সাথে আমরাও হাত মিলালাম গাছ-ডালপালা ও টিন সরানোর কাজে।
ঐ দিনই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আসার সময় যে ইটবিছানো পথ দেখছিলাম তা ভাঙ্গা গাছ ও ডালপালায় জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। টেম্পো চলা অসম্ভব এমনকি সাইকেলও তাই পায়ে হেঁটেই আমরা রওয়ানা দেই। মনে হচ্ছিল যেন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। যাওয়ার পথে সিডরের তান্ডবের ফলে রেখে যাওয়া চিহ্ণ দেখতে দেখতে গেলাম। গ্রামবাসী কুড়াল-করাত নিয়ে নেমে পড়েছে বাড়ির উপর আছড়ে পড়া গাছপালা পরিষ্কার করতে। কোন কোন জায়গায় বিশাল বিশাল গাছকে শিকড়সহ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে সিডর কি প্রচন্ডভাবেই না আঘাত হেনেছিল। অনেকেই ভাঙ্গা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিল।
...........
সিডরের আঘাতে জর্জরিত স্থানগুলোর মানুষেরা স্বজনহীন, গৃহহীন হয়ে এক দুঃসহ জীবন-যাপন করছে। আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন, চিকিসাহীন দুর্গত মানুষগুলো আছে ত্রানের আশায়। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যগ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে যার যা সামর্থ্য তাই নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন আমাদের মানবিক দায়িত্ব। আসুন আমরা সকলে এগিয়ে আসি এইসব দূর্গত মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৩:৩৭