somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘূর্ণিঝড় সিডরের কবলে

১৯ শে নভেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল কয়েক বন্ধু মিলে যাব কুয়াকাটা তারপর সেখান থেকে ঝালকাঠিতে এক বন্ধুর মামার বাসায়। প্রথমে যাব লঞ্চে করে বরিশাল তারপর সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটা। কিন্তু কপাল খারাপ যেইদিন যাওয়ার কথা সেইদিনই জানতে পারলাম সমুদ্র উপকূলে ৪ নং বিপদ সংকেত দেখান হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম প্ল্যান এখন চেঞ্জ করা যাবেনা। ৪ নং বিপদ সংকেত আর এমন কি। আমরা পৌছতে পৌছতেই হয়ত আর বিপদ সংকেত থাকবেনা। তাই কুয়াকাটাতেই যাব কিন্তু কারও বাসায় বলা যাবেনা। বলা হবে আরেক বন্ধুর দাদাবাড়ি কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা।
এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তা ঘুর্ণাক্ষনেও বুঝতে পারিনি।.....

লঞ্চের দুইটা কেবিন আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল। সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করে বরিশাল পৌছলাম পরদিন সকালে। সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটায় পৌছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। কুয়াকাটায় বাস থেকে নামতেই বিভিন্ন আবাসিক হোটেলের দালালেরা আমাদের ঘিরে ধরল পারলে টেনেই তাদের হোটেলে নিয়ে যায়।

একটা হোটেল পছন্দ হতে সেখানেই উঠলাম। মালপত্র রেখেই ছুটলাম সমুদ্র সৈকতে। কিসের কি বিপদ সংকেত। মানুষজন কম হলেও অনেকেই দেখি সমুদ্রে দাপাদাপি করছে। সবই স্বাভাবিক। আমরাও হৈ হৈ করে ফুটবল খেলায় মেতে উঠলাম। কিছু দূরে ছাউনির নিচে কিছু জুটিকে দেখলাম জড়াজড়ি করে চুমু খাচ্ছে। আমরাও সেখান দিয়ে ইচ্ছা করেই কিছুক্ষন দৌড়ঝাপ দিয়ে তাদের বিরক্ত করলাম।

সন্ধ্যা হতেই হোটেলে ফিরে আসলাম। রাতে খবর পেলাম ১০ নং বিপদ সংকেত দেখান হয়েছে। মাইকিং করেও বলে দেয়া হল সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে। সমুদ্র সৈকতে গেলাম অবস্থা দেখতে। দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের তর্জন গর্জন শুনলাম। পানিও খুব দ্রুতই বাড়ছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়াতে হোটেলে ফিরে এলাম। সবার মোবাইলে ততক্ষনে কল ও ম্যাসেজ করা শুরু করেছে উৎকন্ঠিত বাবা-মা। নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। কোনমতে সবাই জানালাম যে আমরা কিশোরগঞ্জে পাকা দালানের মধ্যে নিরাপদেই আছি।

সবাই মিলে সিদ্বান্ত নিলাম কুয়াকাটায় থাকা চলবেনা। পরদিন দুপুর থেকে মাঝরাতের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে। বরিশালেও ঝড় আঘাত হানবে জেনেও ঝালকাঠিতে বন্ধুর মামার বাসাতেই যাবার জন্য মনস্থির করলাম। পরদিন সকালে রওনা দিলাম বাসে করে। দুপুরে গিয়ে ঝালকাঠিতে পৌছলাম। সেখান থেকে একটা ছোট নদী পার হয়ে এরপর টেম্পো করে পোনাবাইলা নামক গ্রামে বন্ধুর মামার বাড়িতে পৌছলাম। সারাদিনই বৃষ্টি থাকায় বাসাতেই ক্যারম ও তাস খেলে কাটিয়ে দিলাম। তখনোও পর্যন্ত নিশ্চিত মনেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন বর্ষাকালের আমেজ। রাতে যে ভয়ংকর এক ঘূর্ণিঝরের অভিজ্ঞতা হবে তা বোঝা যাচ্ছিলনা।

সন্ধ্যার পর বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। ইলেকট্রিসিটি আগেই চলে গিয়েছে। কোন কোন জায়গায় পানি উঠা শুরু করেছে শুনে আমরা রাতের খাবার তাড়াহুড়ার মাঝে শেষ করে বন্ধুর মামার টিনের বাড়ি ছেড়ে পাশেই আরেক দুঃসম্পর্কের মামার পাকা দালানে আশ্রয় নিই। আশপাশের আরও অনেক গ্রামবাসীও আসে আশ্রয় নিতে।

যতই সময় যাচ্ছিল বাতাসের গর্জন ততই বাড়ছিল। সিডর প্রবল আঘাত হানে প্রায় রাত এগারটার সময়। প্রচন্ড শক্তিতে আশপাশের গাছপালা ও বাড়িঘরের উপর আছড়ে পড়ে। কতকগুলো টিনের বাড়ির চাল উড়ে যায় মুহূর্তেই। বিশাল বিশাল গাছও পরাস্ত হয়ে নুয়ে পড়ে, উপড়ে যায়। পাকা দালানটাকেও নিরাপদ মনে হচ্ছিলনা। সবাই একমনে দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে। ছোটবাচ্চারা কেঁদে উঠে। অনেকেই বলে উঠে, ঐ আজান দে, আজান। কেউ একজন আজান দিয়ে উঠে। মাঝে-মধ্যে অল্প একটু জানালা খুলে টর্চ মেরে দেখলেই দেখা যায় আশপাশের গাছপালার উপড় দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ রূপ প্রায় এক ঘন্টার মত স্থায়ী থাকে এরপর দুর্বল হয়ে যায়। বাতাসের গর্জন শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে বাইরে বের হয়ে মনে হল এক ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। বেশিরভাগ গাছই আর আস্ত নেই। অনেক বাড়ির চাল উড়ে গেছে। আমরা প্রথম যে টিনের বাড়িতে ছিলাম সেটারও একাংসের চাল উড়ে গেছে। পাশের পুকুরটাও ভাঙ্গা গাছপালায় ভর্তি। বাড়ির মানুষজনের সাথে আমরাও হাত মিলালাম গাছ-ডালপালা ও টিন সরানোর কাজে।

ঐ দিনই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আসার সময় যে ইটবিছানো পথ দেখছিলাম তা ভাঙ্গা গাছ ও ডালপালায় জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। টেম্পো চলা অসম্ভব এমনকি সাইকেলও তাই পায়ে হেঁটেই আমরা রওয়ানা দেই। মনে হচ্ছিল যেন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। যাওয়ার পথে সিডরের তান্ডবের ফলে রেখে যাওয়া চিহ্ণ দেখতে দেখতে গেলাম। গ্রামবাসী কুড়াল-করাত নিয়ে নেমে পড়েছে বাড়ির উপর আছড়ে পড়া গাছপালা পরিষ্কার করতে। কোন কোন জায়গায় বিশাল বিশাল গাছকে শিকড়সহ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে সিডর কি প্রচন্ডভাবেই না আঘাত হেনেছিল। অনেকেই ভাঙ্গা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিল।

...........

সিডরের আঘাতে জর্জরিত স্থানগুলোর মানুষেরা স্বজনহীন, গৃহহীন হয়ে এক দুঃসহ জীবন-যাপন করছে। আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন, চিকিসাহীন দুর্গত মানুষগুলো আছে ত্রানের আশায়। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যগ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে যার যা সামর্থ্য তাই নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন আমাদের মানবিক দায়িত্ব। আসুন আমরা সকলে এগিয়ে আসি এইসব দূর্গত মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৩:৩৭
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×