রাকিবের আজ মনটা খারাপ । সে জানে এই মন খারাপের কোন মানে হয় না কিন্তু তারপরেও তার মন কোন যুক্তি মানছে না । একটা মেয়েকে সে খব পছন্দ করে । বলা যায় ভালোই বাসে । নাম মেহজাবিন । ফেসবুকে পরিচয় । ৩ বছর চ্যাট করার পর গত ৭-৮ মাস ধরে মোবাইলে নিয়মিত কথাবার্তা হত । তাও সারা রাত ধরে । জানে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । কিন্তু কি করবো ? মন তো মানে না । তার সম্বন্ধে বলতে গেলে সে অসম্ভব লক্ষ্মী আর সহজ সরল একটা মেয়ে । আর সে যখন কথা বলে তখন মনে হয় যেন জলতরঙ্গ বাজছে । এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে তার সাথে কথা বার্তা একেবারে বন্ধ । ওর প্রাক্তন প্রেমিক নাকি ওর সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টায় আছে । আর এর মাঝে আমি নাকি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি । অথচ গাধাটা জানে না আর কয়েক মাস পরেই মেয়েটার বিয়ে । ওর প্রেমিক আমাকে মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে থ্রেট দেওয়ার চেষ্টা করে । শালার লগে কি কথা কমু, ওর চিকন গলার আওয়াজ শুনলেই আমার হাসি পায় ।
গত কাল রাতে মেহজাবিন সাথে কথা হয়েছিল আমার । কখনো দেবদাস সাজি নি । তাই এই উপলক্ষে একটু দেবদাস সাজার জন্য ব্যালকনি তে বসে আয়েশ করে একটু রঙ্গিন পানি খাচ্ছিলাম । এমন সময় তার ফোন কল । ভেবেছিলাম ফোনটা রিসিভ করবো না কিন্তু তারপরেও কি কারণে রিসিভ না করে পারলাম না । বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর তাকে বলি-
- আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখবা ?
-- কি বল ?
- তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে । দেখা করবা একদিন ?
-- তুমি তো জানোই, আমার কিছু সমস্যা আছে ।
- এত দিন ধরে সম্পর্ক আমাদের, আজ পর্যন্ত তুমি দেখা দিলে না । ভয় পেয় না । তোমাকে আমি তুলে নিয়ে যাবো না ।
-- যদি তোমার সাথে চলে যেতে চাই তুমি নেবে আমাকে ?
- না । নেব না । সে সাহস আমার নেই । থাকলে অনেক আগেই আগেই নিয়ে যেতাম । আর আমাকে তুমি ভালো করেই চেন । আমার সাথে সংসার করলে তুমি সুখী হবে না ।
-- তুমি এত শিউর হলে কিভাবে যে আমি সুখী হব না ?
- বাদ দাও এসব । শেষ সময়ে এসে এসব কথা বলে লাভ নেই । কাল অথবা পরশু আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই ।
-- এত তাড়াহুড়ো কিসের ?
- তুমি বুঝবে না ।
-- এমন কেন কর ? বুঝিয়ে বল
- তুমি অন্য কারো হওয়ার আগেই আমি তোমাকে দেখতে চাই । ঠিক যেমনটা আমি ভেবে রেখেছিলাম । তোমার পাশে আমি অন্য কাউকে দেখতে চাই না ।
-- কেন ? বিয়ের পর তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে না ?
- আমি রাখতে চাই না । কষ্ট পাবো । তাই একবারেই আখেরি দেখা করতে চাই । করবে না দেখা ?
-- কবে করতে চাও ?
- কাল অথবা পরশু ।
-- লং জার্নি করে আসবে, কষ্ট হবে না ?
- তোমার জন্য না হয় একটু কষ্ট সহ্যই করলাম । কি এমন আসে যায় তাতে ?
-- ঠিক আছে । টিকেট কাটার পর কবে আসছ আমাকে কনফার্ম করো ।
- আর শোন তুমি কিন্তু ওই নীল রঙের সালোওয়ার কামিজটা পড়ে আসবে ।
-- কেন ?
- ওটা পড়লে তোমাকে নীল পরীর মত লাগে ।
-- ঠিক আছে । ওটাই পরবো ।
- ওকে । রাখি তাহলে ?
-- রেখে দিবে ?
- হম । এক হাতে নিকোটিন আর অপর হাতে রঙ্গিন পানি নিয়ে বসে আছি জোছনা পান করবো বলে ।
-- এসব ছাইপাশ না খেলে হয় না ? কেন শুধু শুধু নিজের ক্ষতি করছো ?
- নাহ । মাঝে মাঝে এগুলোর দরকার আছে ।
-- ওকে । ভালো থেকো ।
- বাই ।
আসলে ওর সাথে আমার সারা রাত কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো । ইচ্ছে করেই বললাম না । কি দরকার মায়া বাড়িয়ে ?
কাল সকালেই যাবো বাস কাউন্টারে । টিকেট কাটতে হবে । রাতের বাসেই চলে যাবো । আপাতত এখন সুধা পানে মত্ত থাকি ।
পরের দিন সকাল বেলা চলে গেলাম বাস কাউন্টারে । রাতের টিকেট কেটে মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম দেখা হচ্ছে কাল । আমি আসছি ।
১০ টার দিকেই কাউন্টারে চলে গেলাম ১১ টার বাস ধরতে । বাস ছেড়ে দিল সময় মতই । জানালার পাশের সিটে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরও পেলাম না । ঘুম ভাঙল ফেরি ঘাটে এসে । বাস থেকে নেমে ফেরির একদম পেছনে গিয়ে খোলা বাতাস আর পানির গর্জন শুনতে শুনতে কয়েকটা সুখটান দিয়ে নিলাম । আবার বাসে উঠার সময় হল । ফেরি ওই পারে চলে এসেছে । পৌছাতে মনে হয় আরো ৩-৪ ঘন্টার মত লাগবে । বাসে উঠেই আরেক ঘুম । ঘুম ভাঙল বাসের সুপার ভাইজার এর ডাকে ।
- মামা, ও মামা উঠেন ।
-- কি হইসে মামা ডাক ক্যান ? দেখ না ঘুমাইতাছি ।
- বুহুত ঘুমাইসেন । এইবার বাড়ি যাইয়া ঘুমান । বাস গ্যারাজে লইয়া যামু ।
-- আইসা পরছি নাকি ?
- হ মামা ।
-- তো অইটা আগে কইবা না ।
উঠে দেখি পুরো বাসে যাত্রী বলতে আমি একাই আছি । আর বাকি সবাই যে যার মত ছলে গেছে । মেজাজ পুরা বিলা হইয়া গেল । ইম্পরট্যান্ট কাজে ক্যান যে এত ঘুম পায় বুঝি না । বাস থেকে নেমে কাছের একটা হোটেলে গেলাম নাস্তা করতে । দেখা হবে বিকালে আর এখন বাজে সকাল ৯ টা । এতক্ষণ আমি কি করুম ? বন্ধুর বাসায় গেলে ঘুমাইতে পারুম না, এইটা সেইটা বহুত কিছু জিগাইবো । তারচেয়ে ভালো হয় কোন হোটেলে গিয়ে একটা রুম ভাড়া করি । আরামে থাকতে পারবো । যেই ভাবা সেই কাজ । কাছের একটা হোটেলে ১ দিনের জন্য ১ টা রুম ভাড়া নিলাম ।
দুপুর পেড়িয়ে বিকেল হল । মেহজাবিন কে ফোন দিয়ে জেনে নিলাম কোথায় আসতে হবে । সময়ের অনেক আগেই চলে গেলাম সেখানে । রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটা সুবিধা জনক জায়গা খুজে পেয়ে সেটাই দখল করে রাখলাম । মনে মনে ভাবছি ১ মাস ধরে শেভ না করা রাকিবকে সে চিনতে পারবে ? আরে ধুর । কি যাতা ভাবছি । কিন্তু সে এখনো আসছে না কেন ? ৪ টার সময় আসার কথা এখন ৫ টা বাজে । ফোন দেই সেটাও ধরে না । অনেক ক্ষণ ধরে বসে আছি । এবার আমাকে সুখটান দিতেই হবে । রাস্তার পাশে একটা চা-বিড়ির দোকান দেখে সেখানেই বসে পরলাম । একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করে যাচ্ছি কিন্তু ওর আসার কোন খবর নেই । সন্ধ্যা ৭ টা বাজে । বুঝে গেলাম ওর সাথে আমার আর দেখা হবে না । কষ্টের একটা হাসি হেসে চলে গেলাম বাস কাউন্টারে, রাত ১১ টার ঢাকার বাসের টিকেট কনফার্ম করতে ।
সারাটা সন্ধ্যা বাইরেই কাটালাম । মোবাইল থেকে ওর সমস্ত এসএমএস, নাম্বার সব ডিলিট করে দিলাম । কি দরকার এসব রেখে, শুধু শুধুই কষ্ট পাবো । রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ওকে একটা মেসেজ দিলাম- চলে যাচ্ছি,ভালো থেকো । সাড়ে ১০ টার দিকে বাস কাউন্টারে চলে গেলাম । বাসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছি । এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল-
- সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দাও । এটা তোমাকে শেষ করে দিবে ।
পেছনে ঘুরেই দেখি মেহজাবিন দাঁড়িয়ে হাতে ব্যাগ । আমি তো পুরাই অবাক ।
-- তুমি এত রাতে এখানে কি কর ? আর তোমার হাতে ব্যাগ কেন ?
- ভয় পেয় না । আমি তোমার সাথে পালিয়ে যাচ্ছি না । পরশু দিন ডাক্তারের সাথে আমার এপয়েনমেন্ট আছে । ভাবলাম তোমার সাথেই যাই ।
-- কিন্তু তুমি আজকে আমার সাথে দেখা করলে না কেন ?
- পরে বলছি । আগে আমার ব্যাগটা ধর তো আর দেখ দুজনের সিট একসাথে করা যায় কি না ।
-- সিট নাম্বার তো আলাদা । একসাথে কিভাবে বসবো ?
- আগে বাসে উঠো তারপর দেখছি ।
বাসে উঠে আমার পাশের সিটের আঙ্কেলকে ওর সিটের সাথে উনার সিট এক্সচেঞ্জ করার জন্য রীতিমত রিকুয়েস্ট করা শুরু করে দিল আর আমি ঘোড় লাগা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি । সিট দখল করে বিজয়ীর হাসিতে হেসে উঠে বলল-
- দেখলে, কিভাবে সিটটা ম্যানেজ করলাম আর শোন জানালার পাশে কিন্তু আমি বসব ।
-- মানে কি ? ওইটা আমার সিট
-- এখন ওটা আমার সিট,বুঝলে । এখন যাও, দোকান থেকে আমার জন্য চিপস,বিস্কুট আর পানির বোতল নিয়ে আসো আর শোন ভুলেও এখন সিগারেট খাবা না ।
- ওকে ম্যাডাম যাচ্ছি । আপনার আর কিছু লাগবে ?
-- হিহিহি । আপাতত না । পরে লাগলে আপনাকে জানাবো । ঠিক আছে ?
সব কিছু কিনে বাসে উঠার সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিল । ছাড়ার সাথে সাথেই জেরা করার ভঙ্গিতে ওকে বললাম-
- তুমি বিকেলে আসো নি কেন সেটা বল ?
-- দেখ আমি আসার অনেক চেস্টা করেছি । কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই আমার ফিউচার জামাই তার বাপ-মা নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসে । তুমি ফোন দিচ্ছিলে আমি টের পেয়েছি কিন্তু বিশ্বাস কর তোমার সাথে কথা বলার অনেক চেস্টা করেছি কিন্তু কোন সুযোগই আমি পাইনি । প্লিজ,রাগ করে থেকো না ।
- আমি রাগ করলেই কি আর না করলেই কি ? আমার কথায় কারো কিছু আসে যায় নাকি ?
-- দেখ,এমন কর কেন ? তোমার সাথে বিকেলে দেখা করতে না পেরে এক রকম যুদ্ধ করে আমি আজ ঢাকায় যাচ্ছি শুধু তোমার সঙ্গ পাবো বলে । আব্বু-আম্মুর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছি বলে আজ তারা আমার উপর এত প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারেনি । না হলে কোন ভাবেই আসতে দিতো না । একটু বোঝার চেষ্টা কর ।
- ঠিক আছে । মাফ করে দিলাম ।
-- মাফ করলা মানে ? আমি কোন অপরাধ করেছি নাকি ? ভাব লও ?
- ওফ । এইবার একটু চুপ থাকবা ?
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছি । মেহজাবিনও কথা বলেছে না । চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । শেষমেস আমাকেই নীরবতা ভাঙতে হল ।
- বিয়ে কবে ?
-- ডিসেম্বরে ।
- ভালো ।
-- তুমি আসবা না আমার বিয়ে তে ?
- না আসবো না ।
-- কেন ?
- আমি তোমাকে বলতে পারবো না । আমি শুধু এটাই জানি আমি আসতে পারবো না । আই এম সরি ।
-- তুমি আসলে আমার অনেক ভালো লাগত ।
- বাদ দাও এসব । অন্য কথা বলো ।
তারপর সারা রাত ধরে আমরা কথা বললাম । পুরো বাসের সবাই ঘুমিয়ে আছে । শুধু ঘুম নেই আমাদের চোখে । চলতে চলতে বাস এক সময় ফেরি ঘাটে এসে পৌছাল । বাস যখন ফেরিতে উঠলো তখন তাকে নিয়ে ফেরির পেছনের দিকে গেলাম । নদীতে তখন জোয়ার চলছে । সেদিন সম্ভবত পুর্ণিমা রাত ছিল । এক পাশে চাঁদ আর অপর পাশে সে । ওয়াও, লাইফ ইজ সো বিউটিফুল । নিজের অজান্তেই হেসে উঠলাম ।অবশেষে আবার বাসে উঠার সময় হয়ে এলো । এক সময় বাস ছেড়ে দিল । ঢাকায় পৌছাতে মনে হয় আর এক-দেড় ঘন্টা লাগবে । খালি রাস্তা ধরে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে বাস । আর সেই বাসের খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঢোকা বাতাস আমার কাধের উপর শুয়ে থাকা মেহজাবিনের চুল গুলো জড়িয়ে দিচ্ছে আমার মুখে । মেহজাবিন, তুমি হয়ত জানো না তোমাকে কত টুকু ভালবাসি । কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তোমাকে সেই কথাটা বলার সাহস আমি পাই নি । একটা কথা আছে না- যা চাই তা পাইনা আর যা পাই তা চাই না ।
এক সময় বাস ঢাকায় এসে পৌছাল । তখনও সে ঘুমাচ্ছে । খুব আস্তে করে তাকে ডাকলাম –
- মেহজাবিন, ওঠো । আমরা ঢাকায় চলে এসেছি ।
ঘুম জড়িত কন্ঠে সে বলল
-- আরেকটু ঘুমাই ?
- আরে উঠো । আমার কাধের উপর শুয়ে আছ তুমি । মানুষ জন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে ।
ধরফর করে সে উঠে বসলো । লজ্জা ভরা কন্ঠে বলে উঠলো-
- সরি । তোমার কাধে শুয়ে ছিলাম বলে ।
-- আরেহ, সরি বলার দরকার নেই । বরং আমার ভালোই লেগেছে ।
- তুমি এত ফাজিল ক্যান ? আচ্ছা শোন আমার দুলাভাই আসবে আমাকে নিয়ে যেতে । তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত আমার সাথে থাকবা ?
-- আচ্ছা ঠিক আছে । চল এখন বাস থেকে নামি ।
কিছুক্ষণ পরেই ওর দুলাভাই চলে আসলো । তখন আমি দাড়িয়েছিলাম অপরিচিতের ভঙ্গিতে যাতে ওর দুলাভাই বুঝতে পারে ও একাই এসেছে,আমার সাথে নয় । সব কিছুই ঠিক ছিল কিন্তু চলে যাবার মুহুর্তে কেন জানি মনে হল ওর চোখ দুটি ভিজে আসছে । আমি তাড়াতাড়ি ওর কাছ থেকে সরে এলাম । এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারবো না । এক সময় ও চলে গেল । আমিও একটা সিগারেট ধরিয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম । মনে প্রানে চাচ্ছি ওকে দ্রুত ভুলে যেতে । কিন্তু কখনো পারবো কিনা তা জানি না ।