অমাবস্যা! অন্ধকারের প্রতীক। ভয়, তীব্রতা, নৈরাজ্যের প্রতীক! তবুও কিছু মানুষ ভালবাসে অন্ধকারকে! তৈ তাঁদেরই একজন! সবার যখন জ্যোৎস্না নিয়ে এত মাতামাতি তখন সে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বসে থাকে! ঠিক যে রাতে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়, কুৎসিত চাঁদটাকে ঢেকে ফেলে, সেই রাতে তৈ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বাগত জানায় তিমিরকে! তিমির, তৈ এর একমাত্র প্রেমিক!
-একটা কবিতা শুনবি?
- তোর প্রিয় কবিতা?
- হুম!
- কখনো তোর কবিতা শুনব না,বলেছি?
-
“ আমাকে টান মারে রাত্রি জাগানো দিন...
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার!
আমার ঘুম ভেঙ্গে, হটাৎ খুলে যায়...
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার!”
- আজ পূর্ণিমা! আজ বিচ্ছেদের রাত!
তৈ কুচকে যাওয়া কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিল! কাউকে সমুদ্রের তলদেশে নিয়ে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলে দিলে যেরকম বোধ হয়, তৈ এর ঠিক তাই হচ্ছে! তবুও সে বিছানায় লেপটে শুয়ে আছে, সমস্ত ঘর অন্ধকার! সে জানে, আর একটু পরই অন্ধকার ঘরেও আলোরা এসে উকি দেবে, নূপুরের মৃদু সুর শোনা যাচ্ছে! তৈ এর চিৎকার করে তিমির বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে! কিন্তু সে জানে, তিমির তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে... এই বোধ তৈ কে আরও অস্থির করে ফেলে! সে নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে শুধু একটি লাইন ভেবে যাচ্ছে, তাঁকে এসব ভুলতে হবে, তলিয়ে যেতে হবে, ঘুমে, অন্ধকারে, শুধু একটি লাইন! ‘আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার... আমাকে টানে... অন্ধকার... অন্ধকার... তিমির... তিমির... আমাকে টানে...’ ডুবে যেতে হবে! নয়তো অনর্থ হয়ে যাবে! অনর্থ! সে এসব ভাবতে চায়না, সে ডুবে যেতে চায়, সমুদ্রে ডুবে যাবার মতন! গত তিন বছর থেকে যেভাবে যায়, প্রতি পূর্ণিমায়! ঠিক সেভাবে!
হল না! আজ সত্যিই হল না! যত দিন যাচ্ছে পূর্ণিমা তত প্রকট হচ্ছে, নূপুরের শব্দ তত তীব্র হচ্ছে! তৈ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল, ছিঁড়ে যাওয়া কাগজ গুলো তুলে নিল! নাহ! আর একবার! সে ছোট্ট করে আবার দুটি কাগজ ছিঁড়ে নিল, কাঁপা হাতে লিখল- ‘তিমির’ , ‘জ্যোৎস্নাবী!’
প্রতিবার ঐ একই নাম, একই শব্দ! একই দ্বিধা! তবু যেতে হবে ওকে!
জ্যোৎস্নার আলোয় তৈ এর মাথা ঝিম ঝিম করছে! নূপুরের শব্দে কান ছিঁড়ে যাচ্ছে! তবুও তাঁকে যেতে হবে, ছাঁদ অবধি! যেতেই হবে!
-আজ পূর্ণিমা!
জ্যোৎস্নাবীর নূপুরে জ্যোৎস্না সন্ধি! জ্যোৎস্নার বন্যায় ভিজতে ভিজতে সে ভাবছে এরকম জ্যোৎস্নাময় রাতে তাঁর মৃত্যু হলেও ক্ষতি নেই! বরং খুব বেশী সুখ হবে তাঁর! পূর্ণিমার রাতে জীবনের সাথে বিচ্ছেদ! এসব ভাবতে ভাবতে পেছনে খুব পরিচিত হাতের ছোঁয়া, তাঁর জীবনের সবচে কাছের বন্ধু, তৈ!
এখন নিজেকে খুব হালকা লাগছে জ্যোৎস্নাবীর! মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলো গুলো তাঁকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দূরে কোথাও! হয়তো ঐ চাঁদটার কাছে! কে জানে! শুধু দূর থেকে কিছু মিষ্টি শব্দ গুচ্ছ ভেসে আসছে, সেই পরিচিত শব্দগুচ্ছ গুলো-
“
আমাকে টান মারে রাত্রি জাগানো দিন
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙ্গে
হটাৎ খুলে যায়
মধ্য রাত্রির বন্ধ দ্বার ।
এ যেন নিশিডাক
মৃতের হাতছানি
এ যেন কুহকের অজানা বীজ ।
এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়
হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া খনিজ ।
আমাকে যেতে হবে
এখনও যেতে হবে
রয়েছে অশরীরি অপেক্ষায়
যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দুলে
যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।"
কবিতার সাথে কান্নার সুর মিশে গানের মত শোনাচ্ছে! অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় কোন গান! পৃথিবীর শেষ জ্যোৎস্নাময় কোন অদ্ভুত সুন্দর গান! জ্যোৎস্নাবী পুরো মন নিবিষ্ট করে সেই গান শোনার চেষ্টা করছে, তৈ এর কণ্ঠের চমৎকার গান!
উৎসর্গঃ অদ্ভুত সুন্দর এই কবিতা যিনি লিখেছেন সেই কবি কে! অনেক চেষ্টা করেও কবির নাম, এমনকি কবিতার নাম খুঁজে পাইনি! তবু অপেক্ষা করে আছি কোনদিন হয়তো জানতে পারবো! কোন কবিতা আমার ঠিক মন না ছুঁয়ে গেলে আমি আবৃতি করি না, এই একটি কবিতা আমি অগণিতবার আবৃতি করে ফেললাম! সেই সেই দিন থেকে! দুর্জয় ভাইয়া যতই বলুক না কেন, কবি না হতে পারার আফসোস আমার থেকেই যাবে! আমি কেন কবি নই!