মাইলটাক যাওয়ার পরই শুরু হলো আসল বিপদ। ওরে সর্বনাশ !!! পাহাড়ের খাড়া গিরিখাত ধরে নামতে শুরু করলো আমাদের ঘোড়াগুলো, আলগা পাথুরে পথ খানাখন্দে পরিপূর্ন। ঘোড়াওয়ালাদের হাজারো আশ্বাস সত্ত্বেও আতঙ্কে আমাদের আত্মারাম খাচাছাড়া। কিছুদুর নেমে ঘোড়াগুলোও অস্বসতিতে নাক দিয়ে ঘো-ঘো আওয়াজ করতে লাগলো আর সবেগে মাথা ও কান নাড়তে লাগলো। ঘোড়াওয়ালেদের জানালাম আমরা আর যাবো না। মাথায় থাক আমাদের দুধ-গঙ্গা দর্শন। কিন্তু ঘোড়াওয়ালার জানালো কোন সমস্যা নাই তাদের ঘোড়াগুলো অতি-প্রশিক্ষিত ও এ-পথে প্রতিদিন কয়েকবার যাতায়াত করে। ঘোড়াওয়ালাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা মৃদু কিত্কিত্ শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো আবারও চলতে শুরু করলো আর আমরা সর্বশক্তিতে ঘোড়ার পিঠ-আকড়ে পড়ে থাকলাম।
কিছুদুর গিয়েই দেখা মিললো দুধ-গঙ্গার। এবার বুঝতে পারলাম এর নাম রহস্যটি। চওড়া দৈর্ঘ্যের পাথুরে নদী দুধ-গঙ্গা। পানির রঙ সম্পূর্ন সাদা। এখন বর্ষা নয়, তাই বিশাল পাথরের চাঁইগুলো ডিঙিয়ে সফেদ জলরাশি কুলকুল করে বয়ে চলেছে, দু'ধারে পাইনের ঘন জঙ্গল, মাথার উপর অফুরন্ত নীল। নৈসর্গিক এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি জানিনা। সম্বিৎ ফিরে পেরাল "হ্যালো কাউবয়" সম্বোধন শুনে। ফিরে তাকিয়ে দেখি দু'জন ষাটোর্ধ বৃটিশ (পরে জেনেছি) পর্যটক হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। পরক্ষনে বুঝতে পারলাম আমাকে রাখাল বালক ডাকার কারনটি। অনেক আগে শখের বশে আমি একটি কাউবয় হ্যাট কিনেছিলাম, যেটি পরে সুদুর হিমাচল প্রদেশ ও উত্তর বঙ্গ তথা দার্জিলিং ঘুরে এসেছি আমি। মুখের গঠনগত কারনে হ্যাটটি বেশ ভালোই মানায় আমাকে। তাছাড়া চিরাচরিত জিনস্ এর ট্রাউজার ও শীতকালীন জ্যাকেটও তার সাথে ভালোই মানিয়ে গেছে। ত্বকের রঙ পুরোপুরি পশ্চিমাদের মতো না হলেও রোদে পোড়া রাখাল-বালক হিসেবে আমাকে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
পরিচিত হলাম বৃদ্ধ দুই পর্যটকের সাথে। জানলাম ওরা হেঁটে হেঁটেই কাশ্মির পর্যটন করছে। থাকছেন সাথে করে নিয়ে আসা টেন্ট ও স্লিপিং ব্যাগে। রান্নাবান্নাও নিজেরাই করছেন। অনেকটা চমৎকৃতই হলাম তাদের এই অফুরন্ত প্রানশক্তি ও ভ্রমণ পদ্ধতি দেখে।
দুধ গঙ্গা দেখা হলো, ছবিও তোলা হলো প্রচুর। সাথে থাকা চকলেট ও পানীয় পান করে আবারও ফিরে চললাম যুসমার্গ জিপ স্ট্যান্ডে। ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাই তার সাথে করে আনা খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিয়েছেন, তাই কোনরকম বিলম্ব ছাড়াই যখন রওনা দিলাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে তখন বেলা দুইটা। হোটেলে পৌঁছুতে কমপক্ষে ঘন্টা দু'য়েক তো লাগবেই, তাই পথিমধ্যে কোথাও লাঞ্চ সেরে নেবো কিনা চিন্তা করছি কিন্তু কোন রেস্টুরেন্টই পছন্দ হচ্ছে না। পরে রিয়াজ ভাই পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের হোটেল ম্যানেজারকেই ফোন করলাম লাঞ্চের জন্যে। সে জানালো তিনটের পর তাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। তাই ওখানে খাবার মেলার কোন চান্স নেই।
হোটেলে ঢোকার মুখে পাউরুটি ও জেলি কিনে নিলাম। ওটা দিয়েই লাঞ্চের পর্ব সমাধা করবো ভাবছি এই সময় রুমের ইন্টারকম বেজে উঠলো। অমায়িক গোলাম মোস্তফা সাহেব (হোটেল ম্যানেজার) জানালেন আমাদের লাঞ্চ তৈরী, খেতে আসুন। এই স্পেশাল সার্ভিসের কারণ জানতে চাইলে কারন হিসেবে উনি আমাদের সাথে থাকা বাচ্চারা যাতে না খেয়ে উপোস না থাকে সে জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছেন। খেয়েদেয়ে সবাই ঘন্টাখানেক বিশ্রাম, তারপর নোমানের স্ত্রী ফারহানা ও আমার স্ত্রী টুম্পা বাচ্চাদের আমাদের জিম্মায় রেখে চলে গেলো শপিং-এ। দু'রুমের মধ্যে একরুমে বাচ্চা সবগুলোকে কার্টুন ছবি দেখতে দিয়ে আমি ও নোমান তিনতলা রুমের সুদৃশ্য খোলা বারান্দায় বসে বসে কাশ্মিরের বিখ্যাত সুপুষ্ট ও স্বাদু আপেল ভক্ষন করতে লাগলাম।
সন্ধ্যায় দু'জনে মিলে বেরুলাম শেষ বারের মতো ডাল লেইকের শোভা দর্শনে। দুরে হাউসবোটের রকমারি আলোকসজ্জা রাতের ডাল-লেকইকে করে তুলেছে নয়নাভিরাম। রাতের ডিনার হিসেবে কাশ্মিরী ভেড়ার টিক্কা ও নান কিনে নিলাম।রুমে ফিরেই অজান্তেই মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল আগামীকাল নান্দনিক সোন্দর্যের এই হোটেল ছেড়ে পহেলগাঁও চলে যাবো বলে। চলবে......