বিআরটিসি দো-তলা বাসের দো-তলাতেই বসে আছি। দুপুরের সময় বলে অনেকগুলি সিট ফাঁকা পড়ে আছে, আমি বসে আছি একেবারে সামনের দিকে চালকের মাথার উপরে। ফাঁকা রাস্তা হলে পিচ ঢালা রাস্তায় তাকিয়ে থাকি, মাঝের ফাটলে চেহারা খুঁজি(পাশাপাশি অনেকগুলো ফাঁটল থাকলে কেন যেন মনে হয় এইটা কি কারো চেহারা কিংবা কোন বস্তুর ছবি অজান্তে ফুটিয়ে তুলছে)। আর জ্যামের রাস্তায় ফুটপাথের মানুষগুলোর হাঁটা, পাশের বাসের ড্রাইভার, হেল্পার, যাত্রীর মুখে বিরক্তি এইগুলো দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়।
রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল এই পর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে সিগন্যালে পড়লাম। সামনে খেয়াল করলাম, লাশবাহী একটা ট্রাক। লাশকে মাঝখানে রেখে সবাই এই রোদে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। সিগন্যালের বিরক্তি নাকি কষ্ট নাকি লাশের জন্য কষ্ট নাকি এই দুপুরের রোদের জন্য কষ্ট। লাশের মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছিল, কাকে দেখে বেশি জীবন্ত মনে হয় তা দেখতাম।
সিগন্যাল ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই বাসায় চলে আসি। তখনও মাথায় ঘুরছে সেই লাশবাহী ট্রাকের দৃশ্য। এতো কাছে থেকেও লাশটি তার আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলতে পারছে না। জীবিত অবস্থায় কি এতোগুলো মানুষ তার পাশে থাকতো? সবসময় না হলেও অন্তত সপ্তাহে একবার? না হয় মাসে একবার?
আমার একটি চিঠি জমেছে, নিজের লেখা। প্রেরক আমি আর প্রাপক অজ্ঞাত কেউ কিংবা সবাই। সপ্তাহে অন্তত একটি চিঠি লিখা হয়। খুব সুন্দর করে মনের কষ্ট কিংবা ভালো লাগা একটি পাতায় লিখি। লিখা শেষ হলে শব্দ গুলো, বাক্যগুলো উল্টা পালটা করে আরেকটা কাগজে লিখি। এরপর কোনদিন রাতে কিংবা খুব ভোরে বাসার ছাদে গিয়ে প্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দিই। হয়তো রাস্তায় পড়ে থাকে কিংবা কারো বাসার বারান্দায় জমা হয় কিংবা আবার বাড়ির ছাদেই ফিরে আসে। আমি উড়িয়ে দিয়েই পিঠ ঘুরিয়ে নিচে নেমে আসি। আর সুন্দর করে গুছানো চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলি। সেই ছাই pringles এর একটি কৌটাতে জমিয়ে রাখি।
আজকে ভিন্ন কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাসার খুব কাছেই ৫ মিনিট হাঁটার দূরত্বে নতুন কবরস্থান হয়েছে। সেখানে গেলাম, গিয়ে দেখি একটি কবর খোড়া হচ্ছে। আমি সেই কবরের কাছে যেতে যেতে খোড়া শেষ হয়ে গিয়েছি। সদ্য জন্ম নেয়া কবর বুক মেলে রেখেছে কারো জন্য, অপেক্ষা করছে কারো জন্য। তারা আগে কেউ কাউকে দেখে নি তবুও কি মিলনের অপেক্ষা, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হবে একে অপরের সাথে। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে কবরে ফেলে দিলাম, এরপর চিঠির উপরে মাটি ছিটিয়ে দিলাম। চিঠিটার কবর হয়ে গেলো কি? হয়তো তাই হবে। অনুভূতির কবর দিতে পারলে আরো বেশ হতো। তবে আমি এখানে চিঠিটা রেখে যাচ্ছি যে মানুষটি এখানে আসছে কিছুক্ষণের মধ্যে। সময় করে আমার কিছু জানতে পারবে হয়তো, মৃত অন্য কারো সাথে হয়তো রসিয়ে রসিয়ে আমার গাধামির আলোচনা করবে। আমি তো জানবো না সে পড়েছে কি না, আমি তো জানবো না সে কাকে বলছে। সে তো জানবে না আমি কে ছিলাম, কে আছি….
কপালের ঘাম নাক দিয়ে চুইয়ে কবরে পড়লো, আর কত কি রেখে যেতে চাই এক কবরে?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৫