দেশের রফতানি আয়ের সর্ববৃহত্ খাত তৈরি পোশাক আগামীতে টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েই দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। এ খাতে স্থিতিশীলতা থাকবে কিনা তা নিয়ে মালিকরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি উত্কণ্ঠা শ্রমিকদের মাঝেও। এরমধ্যে নানা ধরনের উস্কানি এ খাতে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর দখলে আটঘাট বেঁধে নেমেছে প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র। নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে দিয়ে একে একে দখল করে নেয়া হচ্ছে বড় বড় গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলো। কোনোটির আংশিক মালিকানা আবার কোনোটির পুরো মালিকানা কিনে নিচ্ছে বিদেশিরা। পোশাক খাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিকল্পিতভাবে দেশের পোশাক খাত দখলে নেমেছে বিদেশিরা।
এরই মধ্যে পোশাক খাতের বড় কয়েকটি কারখানা চলে গেছে বিদেশিদের হাতে। মালিকরা বলেছেন, সঙ্কটের কারণে তারা কারখানা চালাতে না পেরে বিক্রি করে দিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছেন। বিক্রীত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এসকিউ গ্রুপ, ক্রিস্টাল গার্মেন্টস, শান্তা গার্মেন্টস, শাহরিয়ার ফেব্রিক্স, মাস্টার্ড গার্মেন্টস, ফরচুন গ্রুপ, ইউনিয়ন স্পোর্টস ওয়্যার, রোজ ফ্যাশন, রোজ নিটিং, এজাক্স সুয়েটার প্রভৃতি। শুধু এই কয়েকটি কারখানা নয়, গত এক বছরে এ ধরনের অর্ধশতাধিক কারখানার মালিক হয়েছেন বিদেশিরা। কিনে নেয়া কারখানাগুলোতে উন্নতমানের মেশিন বসিয়ে ছাঁটাই করা হচ্ছে ৯০ শতাংশ শ্রমিক। বিক্রির তালিকায় আছে আরও শতাধিক কারখানা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, বিদেশি মালিকদের প্রায় সবাই প্রতিবেশী দেশ ভারতের। শ্রীলঙ্কার কয়েকজন উদ্যোক্তাও অবশ্য এ তালিকায় আছেন। এদিকে ২৮ জুলাই পোশাক শিল্পের জন্য নতুন ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হবে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মালিকদের উদ্দেশে আরও বলেছেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা এখন যে বেতনে কাজ করছেন তা অত্যন্ত অমানবিক। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর মালিকপক্ষ বলছে, এতে শ্রমিকরা আরও উস্কে যাবে। তবে শ্রমিকদের মধ্যে এ ধারণা তৈরি হয়েছে, সরকার তাদের পক্ষেই। পোশাক শিল্পের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে এ খাতে মালিক-শ্রমিক উভয়ের মধ্যেই উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা বাড়ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৭৮ সালে ৮ লাখ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি বর্তমানে ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৪০ হাজার থেকে বেড়ে কর্মসংস্থান দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখে। ৪০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ শিল্পখাত জিডিপিতে ১৪ শতাংশ অবদান রাখছে। গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্যে ৫৩৬ কোটি টাকাই এসেছে পোশাক শিল্পখাত থেকে।
গত বছর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পাঁচ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা মুনাফার তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকাই এ খাতের অবদান। পরিবহন খাতকে গার্মেন্ট শিল্প দেয় বছরে ৫২০ কোটি টাকা, প্রিন্টিং সামগ্রী ব্যবহৃত হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধু তা-ই নয়, গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত ৩০ লাখ নারী শ্রমিক প্রতি বছর অন্তত ২০০ কোটি টাকার কসমেটিকস ব্যবহার করছেন। কিন্তু সরকারের উদাসীনতার কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
জানা গেছে, পোশাক শিল্পে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় কর্মরত কর্মকর্তাদের ৮০ শতাংশই বিদেশি এবং এর ৭০ ভাগই ভারতীয়। এসব কর্মকর্তাই এখন এ শিল্পের জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, কমপ্লায়েন্স কারখানাগুলোর শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তাদের উস্কে দিয়ে ভাংচুর করা হচ্ছে বড় বড় কারখানা। আর এতে সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছেন এসব বিদেশি কর্মকর্তা।
প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাক কারখানায় বর্তমানে ২২ হাজারের মতো বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে দেড় হাজারের বেশি ভারতীয়। যোগাযোগ, মার্কেটিং, গুণগত মানসহ সব দিক থেকে দক্ষ হওয়ায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প মূলত তাদেরই নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তারা পরিচালিত হন তাদের তৈরি করা ছক অনুযায়ী। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ যে ভারতের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে তার সবই ভারতীয়দের নখদর্পণে। তারাই মূলত ছক আঁকেন বাংলাদেশের সেরা কারখানাগুলোকে ভারতীয়দের দিয়ে কিনিয়ে নেয়ার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে কারখানায় ভাংচুর চালিয়ে উদ্যোক্তাদের মনোবল নষ্ট করেন তারা। পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ব্যবসায়িক সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে ধারণা দিয়ে কারখানা কিনিয়ে দেন। মালিকানা পরিবর্তন হওয়ার আগে বিভিন্ন অজুহাতে কারখানাগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। নতুন মালিকরা এসে এগুলোর আধুনিকায়ন করেন উন্নত মেশিনারি দিয়ে। ফলে এসব কারখানা থেকে প্রায় ৯০ ভাগ শ্রমিকই বাদ পড়েন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, যোগ্য লোকের অভাবে বেশিরভাগ কারখানা মালিককেই ম্যানেজমেন্ট চালাতে হয় বিদেশিদের দিয়ে। শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতেই থাকে।
সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সী জানান, ‘ভালো মানের পোশাক কারখানায় একের পর এক ভাংচুর ও লুটপাট হচ্ছে। একটি মহল শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে এসব কারখানা বন্ধ করে দিলেও জড়িতরা শাস্তি পাচ্ছেন না। আর এ সুযোগে সস্তায় বিদেশিরা কিনে নিচ্ছে এসব কারখানা। পরে এগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অটোমেশিন বসিয়ে চলছে উত্পাদন। এতে দুটি দিকে ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, মালিকানা চলে যাচ্ছে বিদেশিদের হাতে, দ্বিতীয়ত অটো মেশিনারিজের কারণে ৯০ ভাগ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব।’ টিপু মুন্সী বলেন, এদিকটি গুরুত্বসহকারে না দেখলে এক সময় গোটা পোশাক খাতই হয়তো অন্যদের দখলে চলে যাবে।
বিজিএমইএ’র আরেক সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, দেশে পোশাক শিল্পের জন্য দক্ষ জনবল খুব একটা তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যম স্তরে এ ঘাটতি প্রকট। ফলে বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তারা এ স্তরে বিদেশিদের নিয়োগ দেন।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, দেশের ছোট-বড় মোট ৪ হাজার ৮০০টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মধ্যে বিশ্বমন্দা, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে ১ হাজার ৮০০ ফ্যাক্টরি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। চালু কারখানাগুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে উত্পাদন কম হচ্ছে। ফলে অনেক অর্ডার নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেক রফতানি অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও বিমানে অর্ডার সরবরাহ করতে হচ্ছে। তাতেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে রফতানি বাজার। বাংলাদেশের এ বাজার চলে যাচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও তাইওয়ানসহ অন্যান্য দেশের দখলে। বিদ্যুত্ সমস্যার কারণে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে গিয়ে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। শুধু জেনারেটরের জন্য তেল কিনতে ব্যয় হচ্ছে বছরে ১ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা। ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কটের কারণে সরকারের গ্যাস রেশনিং সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি। উল্টো অবস্থার অবনতি হয়েছে।
পোশাক শিল্পখাতে শুধু চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ না পাওয়ার কারণে বার্ষিক মোট ক্ষতির পরিমাণ ২১৫০ কোটি টাকা। আর গ্যাস-বিদ্যুত্ সমস্যার কারণে শুধু নভেম্বর ২০০৯ থেকে এপ্রিল ২০১০ এ ৬ মাসে প্রায় ৪০ হাজার টন তৈরি পোশাক বিমানে সরবরাহ করতে হয়েছে, যার কারণে পোশাক শিল্পের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা, যা উক্ত সময়ে রফতানিকৃত পোশাকের সিএম মূল্যের প্রায় ৩.৮%। এছাড়াও ২০০৬-এর পরবর্তী সময়ে বিদ্যুতের মূল্য দু’বার বাড়ানো হয়েছে। গত ১ মার্চ ২০১০ থেকে শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ৬%-৯% বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুত্ সরবরাহ ঘাটতির কারণে একটি মাঝারি শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের বছরে প্রায় ৯০ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ টাকা ডিজেল ক্রয় ও জেনারেটর রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয়। ফলে দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ খাতটি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
পোশাক খাত দখলের পাঁয়তারা : একটি প্রতিবেশী দেশ এগিয়ে : মালিক শ্রমিকদের উদ্বেগ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১১টি মন্তব্য ২টি উত্তর


আলোচিত ব্লগ
Appalachian Trail ৩৫০০ কিমি পায়ে হেটে
অ্যাপালাচিয়ান ট্রেইল: এক অসাধারণ অভিযানের গল্প
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবুন, আজ আপনাকে ১৫-২০ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। রাত হবে পাহাড়ের কোলে তাঁবুতে, খাওয়া-দাওয়া চলবে নিজের রান্না করা খাবারে,... ...বাকিটুকু পড়ুন
সসীমের সৃষ্টিকর্তা বা তৈরী কারক না থাকা এবং অসীমের সৃষ্টিকর্তা বা তৈরী কারক থাকা সম্ভব নয়
সৃষ্টি বা তৈরী হয় লিমিট বা সীমা অনুযায়ী। সেজন্য লিমিট বা সীমা না দিলে সসীম বা লিমিটেড সৃষ্টি বা তৈরী হয় না।লিমিট বা সীমা না দিলে সসীম বা... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গিলে খাবো
যারা ফেনি এলাকা নিয়ে শংকিত তাদের জন্য এই পোস্ট। ইনশাআল্লাহ্ সেই ভুল করার মত সাহসও উনাদের হবে না। কেউ শিকার করতে গিয়ে নিজে শিকার হতে চায় না। আর সেনাবাহিনী এত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার: কুরআন ও হাদীসের আলোকে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার: কুরআন ও হাদীসের আলোকে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
ভূমিকা
আজ ১ মে, মহান মে দিবস—শ্রমিক দিবস। এটি শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার, মর্যাদা ও সংগ্রামের প্রতীকী দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
মানবিক করিডোর: অযথাই ভয় পাচ্ছি সম্ভবত
ড.ইউনূসের ভালো কাজগুলোর সমর্থন করি। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এমন কাজ সমর্থন করি না।
আমার চিন্তাভাবনায় ভুল থাকতে পারে। কিন্তু ভয় কাটানোর কোন বাস্তবিক উপায় আছে?
রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক... ...বাকিটুকু পড়ুন