শুল্ক ফাঁকি দিতে আলাদা করে আনা হয়েছে এসির আউটলেট
চট্টগ্রামচট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি ইয়ার্ডে আটক ট্রান্সটেক ব্র্যান্ডের পণ্যভর্তি চারটি কনটেইনারের মধ্যে দুটি খুলে বের করে আনা হয়েছে ৫৪০ ইউনিট এয়ারকন্ডিশনারের আউটলেট (যা ঘরের বাইরে স্থাপন করা হয়)। এসব আউটলেটের গায়ে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে 'ট্রান্সটেক'। কাগজের বাক্সেও লেখা আছে ট্রান্সটেক। ইংরেজিতে আরো লেখা আছে মার্কেটেড বাই ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস লিমিটেড। দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন ট্রান্সকম গ্রুপের লোগোও রয়েছে এতে।
খোলা দুটি কনটেইনারে কোনো কমপ্রেসর নেই। আলাদাভাবে সেগুলো আমদানি করে আনার পর ঢাকায় নিজস্ব কারখানায় সংযোজন করা হয়।
শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশ্যে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করার অভিযোগে গত ৬ এপ্রিল শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমদানি করা এ চালান আটক করেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কনটেইনার খুলে এসব পণ্য ফের পরীক্ষা করেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কায়িক পরীক্ষার সময় উপস্থিত শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে পূর্ণাঙ্গ পণ্যকে যন্ত্রাংশ হিসেবে আমদানির ঘোষণা দিয়েছে।'
এ ব্যাপারে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের হেড অব বিজনেস জাফরুল আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমদানি করা এয়ারকন্ডিশনার আমাদের নয়, কেউ হয়তো শত্রুতামূলকভাবে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্সকে ফাঁসানোর জন্য এসব পণ্য নিয়ে এসেছে।' গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের শেখ মুজিব রোডের এস এস টাওয়ারে ট্রান্সকমের শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, ট্রান্সটেক ব্র্র্যান্ডের এয়ারকন্ডিশনার সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। বন্দরে আটক এয়ারকন্ডিশনার আউটলেটের সঙ্গে শোরুমে রাখা আউটলেটের হুবহু মিল। প্রতিষ্ঠানের সেলস এক্সিকিউটিভ মুমিনুল ইসলাম জানান, এক টনের প্রতিটি ট্রান্সটেক এয়ারকন্ডিশনার বিক্রি হয় ৩৮ হাজার টাকায়। ট্রান্সটেক ব্র্যান্ড সারা দেশে বিক্রি হয় ট্রান্সকমের শোরুমে।
আমদানি চালানেও ব্যাপক গরমিল রয়েছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দুই কনটেইনার এয়ারকন্ডিশনার আউটলেটের আমদানিকারক চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজারের ৪৩ এয়াকুবনগর রোডের মেসার্স বার্ড ইন্টারন্যাশনাল। আমদানি পণ্য ছাড় করার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের 'জি এন ইসলাম' নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নথিপত্র দাখিল করে। গত ২২ মার্চ এসব পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিনের সার্টিফিকেট দেয় সিঙ্গাপুর চেম্বার। অর্থাৎ সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও পণ্যগুলো চীনের বেইজিয়াও বন্দর থেকে জাহাজে তোলা হয় ২ মার্চ। সিঙ্গাপুর থেকে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেওয়া হলেও কিন রিপোর্ট ফাইন্ডিংস (সিআরএফ) করেছে চীনের জন্য নির্ধারিত পিএসআই কম্পানি ব্যুরো ভেরিতাস। সিঙ্গাপুরে পিএসআই কম্পানির নাম এসজিএস। গতকাল দুপুরে পণ্যের কায়িক পরীার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যুরো ভেরিতাসের কর্মকর্তা চন্দন চক্রবর্তীকে কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো ধরনের সদুত্তর দিতে পারেননি। পণ্যের মূল্য দেখানো হয় ২০ হাজার ৭২৭ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৪০ টাকা)। অর্থাৎ শুল্ক পরিশোধের আগে প্রতিটি এয়ারকন্ডিশনার আউটলেটের মূল্য দেখানো হয়েছে দুই হাজার ৬৬৮ টাকা!
গতকাল এসব পণ্যের কায়িক পরীক্ষার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান জি এন ইসলামের স্বত্বাধিকারী নুরুল কাউসার। প্রথমে তিনি নিজেকে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের জে টি সরকার হিসেবে পরিচয় দেন। কালের কণ্ঠ প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে জি এন ইসলামের আরেক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বলেন, 'এসব পণ্য ছাড় করার সঙ্গে সোমনাথ দে নামের একজন সম্পৃক্ত আছেন।' সোমনাথ দের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে আমার সংশিষ্টতা নেই। তবে আমি সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসা করি লিলি এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্সে। জি এন ইসলামের স্বত্বাধিকারী নুরুল কাউসারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে।' বন্দরের ভেতরে নুরুল কাউসারের সামনে সোমনাথের সঙ্গে সংশিষ্টতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন।
উলেখ্য, গত শুক্রবার কালের কণ্ঠে 'ট্রান্সকমের চার কনটেইনার এয়ারকন্ডিশনার আটক, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ' শিরোনামে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। এতে সোমনাথ দের আমদানি চালানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরমিল থাকে বলে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহমুদ বিলু মন্তব্য করেন।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্রাংশের ওপর সব ধরনের শুল্ক ১২৫ শতাংশ আর পূর্ণাঙ্গ পণ্যের শুল্ক ১৪৯ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাস্টমস গোয়েন্দা জানান, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করা এয়ারকন্ডিশনারের বাংলাদেশি আমদানিকারক ও সিঙ্গাপুর থেকে রপ্তানিকারক একই ব্যক্তি। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তাঁর বাড়ি। তিনি প্রায়ই সিঙ্গাপুরে থাকেন। ট্রান্সটেক ব্র্যান্ডের আমদানি করা এই এয়ারকন্ডিশনার বিক্রির জন্য আমদানিকারকের নিজস্ব কোনো শোরুম নেই। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়_এত বিপুল পরিমাণ পণ্য যায় কোথায়? আসলে সরকারের ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব পণ্যকে যন্ত্রাংশ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করে ঢাকার মহাখালীর একটি কারখানায় সংযোজনের পর বাজারজাত করা হয়। এভাবে পণ্য আমদানিতে দুই ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। এক. কারখানায় সংযোজনের পর মূল্য সংযোজন কর ফাঁকি দেওয়া যায়। দুই. বেশি পরিমাণ পণ্য সরাসরি নিজেরা আমদানি করলে লাভ অনুপাতে প্রচুর অঙ্কের আয়কর দিতে হয়। তাই দ্বিতীয় পকে দিয়ে পণ্য আমদানি করলে সরকারকে সহজে আয়করও ফাঁকি দেওয়া সম্ভব।
আটক করা চারটি চালানের বাকি দুই কনটেইনার আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে খুলে আবার কায়িক পরীক্ষা করা হবে বলে জানান একজন কাস্টমস কর্মকর্তা।
source: Click This Link