প্রধান বিচারপতির এজলাসসহ সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরে নেতৃত্বদানকারী এক আইনজীবীকে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর ভাংচুরে নেতৃত্বদানকারী সেই আইনজীবী হচ্ছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদ্য বিদায়ী সভাপতি এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিনের মেয়ের জামাতা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল খসরুজ্জামান। ওই ঘটনার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ভাংচুর করা অবস্থায় তার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতৃত্বে সেদিন সুপ্রিমকোর্টে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। এই তাণ্ডবে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী খসরুজ্জামান লাথি মেরে কোর্টের দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন। সেই দরজা ভাঙার ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়। এছাড়া বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাব্য তালিকায় এমন আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে খুনের মামলার প্রধান আসামি বিচারপতি হচ্ছেন বৃহস্পতিবার আমার দেশ-এ প্রকাশিত এই খবর নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবীদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সরকার পক্ষ গতকাল রাজশাহীতে ওই মামলাটি তড়িঘড়ি করে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসলাম হত্যার বিচারাধীন মামলার প্রধান আসামি ছিলেন রুহুল কুদ্দুস বাবু, যিনি বিচারপতি হচ্ছেন। গতকাল বাবুসহ ৯ জনের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গত সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্ট আদালতের একজন কর্মচারী তাকে জানিয়েছেন রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ৯ আসামির নাম প্রত্যাহারের জন্য পিপি ইব্রাহিম আদালতে একটি দরখাস্ত দেন। এজাহারকারীর আইনজীবীকে কোনো রকমের শুনানির সুযোগ না দিয়েই পিপির দরখাস্ত আদালত মঞ্জুর করেছেন। এজাহারকারী নায়েব আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম জানান, এই প্রত্যাহার আদেশের বিরুদ্ধে শিগগিরই তারা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন মামলা দায়ের করবেন।
উল্লেখ্য, সরকার হাইকোর্ট বিভাগে আরও ১৫ জন অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছে। এর মধ্যে জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস রুহুল কুদ্দুস বাবুর নামও রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসলাম হত্যার চার্জশিটভুক্ত একনম্বর আসামি তিনি। রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ২৫৯/২০০২ নং মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল লতিফ হলের ছাত্র আসলাম প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় ৩০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এই থানায় ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসের মামলা নং-১৪। এই মামলায় প্রধান আসামি হলেন তত্কালীন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা রুহুল কুদ্দুস বাবু। মামলার এজাহারে বলা হয়, রুহুল কুদ্দুস বাবু কিরিচ দিয়ে আসলামকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পুলিশ তদন্ত শেষে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ১নং আসামি রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জ গঠনের ওপর শুনানি শেষে আদালত বাবুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। বাকি কয়েকজনকে চার্জ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই অব্যাহতি আদেশের বিরুদ্ধে মামলার বাদী পক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করে। রিভিশনের শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ রায় দেয়। রায়ে চার্জশিটভুক্ত সব আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের জন্য নিম্ন আদালতের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। এই মামলাটি বর্তমানে রাজশাহীর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আসামিরা জামিনে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার সংশ্লিস্ট আইনজীবী।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মচারী আইনেও রয়েছে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের হলে তিনি সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকবেন। ফৌজদারি অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়ার পরই কেবল তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন, ফৌজদারি অভিযোগের জন্য একজন সরকারি চাকরিজীবী সাময়িক বরখাস্ত হন। অথচ একটি খুনের মামলার আসামিকে সরকার হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে উচ্চআদালতকে কলঙ্কিত করছে। খুনের মামলার আসামি এখন বিচারকের আসনে বসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
এদিকে গতকাল এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে এই হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ৯ আসামির নাম প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। আদালত প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আসলামের পরিবারের আইনজীবী জানান, হাইকোর্ট থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের নির্দেশ থাকার পরও নাম প্রত্যাহার করার অর্থ হচ্ছে হাইকোর্ট ও দেশের প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করা। তিনি বলেন, এতেই প্রমাণ করে সরকার দেশে আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। সরকার নিজের ইচ্ছামতো আদালতকে পরিচালিত করছে।View this link