বিবর্ণ কৃষ্ণচূড়া- ১ম পর্ব
আবিরের গল্প
পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে তারপর ফেসবুকে লাজুক রাজকন্যাকে ক্ষুদে বার্তাটি লিখেছে আবির। ক্ষুদে বার্তা লেখা তার কাছে এমন কোন বিষয় না, বড় বড় গল্পও সে মাঝে মাঝে একদিনের মাঝে লিখে ফেলে। কে জানে এই সামান্য এক লাইনের মেসেজটি লিখতে গিয়ে কেন তাকে ব্যাকস্পেস চেপে এতবার মুছতে হলো আর লিখতে হলো। আবির জানে যে একুশ বছরের একটা ছেলে অনুযায়ী তার লেখা ভালো। তবে ফেসবুকে মানুষ মাতামাতি করে এমন অবস্থা করে যে সে সাক্ষাত রবীন্দ্রনাথের শিষ্য! নিজেকে এতটা যোগ্য না মনে করলেও নিজের জনপ্রিয়তা উপভোগ করে সে। কাঁদিয়ে দিতে পারে সে মেয়েদের তার প্রেমের গল্প দিয়ে। একেকটা গল্প লিখে পোস্ট দেবার পর মেসেজে ভরে যায় তার ওয়াল আর ইনবক্স। প্রথম প্রথম সে আগ্রহ নিয়ে এসবের উত্তর দিতো। একেকটা গল্প দেয়ার পর সেকেন্ডে সেকেন্ডে চেক করতো মন্তব্যের ঘর আর ইনবক্স। মেয়েদের মেসেজের উত্তর দিতো কবিতায়। কিন্তু একটা ধাক্কা খাওয়ায় এসব বন্ধ করে দিয়েছে সে। কবিতা নামে একটা মেয়ে তাকে বলেছিলো সে নাকি মরে যাবে আবিরকে না পেলে। মেয়েটাকে আবিরের কবিতার মতই স্বচ্ছ মনে হয়েছিলো। কম্পমান বুকে সে দাঁড়িয়েওছিলো কার্জনহলে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে, ব্যাগের মাঝে কবিতাকে নিয়ে লেখা কবিতায় মোড়া পাঁচটি কদম ফুল নিয়ে। তার লেখা কবিতার প্রিয় গল্পের নায়কের মত। মেয়েটা এসেছিলো, স্নিগ্ধ শিউলীফুলের সজীবতা নিয়ে, চোখে শিশুর মত সারল্য নিয়ে। আবির শুধু তাকিয়েছিলো; সে শুধু দেখছিলো নারীর চোখের ভাষা মূহুর্তে কিভাবে বদলে যায়। সরলতা মিশে গিয়ে প্রথমে দেখা দিলো সেখানে বিষ্ময়, তারপর অবিশ্বাস...আর তারপর? ঘৃনা! প্রথম বলা কথাটা আজও আবিরের কানে বাজে, কথাটাই আবিরকে সাহায্য করেছে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিতে, কথাটাই আবিরকে করেছে আরো শক্তিশালী। কবিতা বলেছিলো, “তুমি...মানে আপনার চোখ ট্যারা?” কথাটা আবিরের কাছে নতুন নয়, কিন্তু তাও কেন যে এত কষ্ট পেলো সে! কিছু বোঝার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো তার। কবিতা আর বেশীক্ষণ থাকেনি। কবিতাটাও আর তাকে দেয়া হয়নি, ফুলগুলো সেদিনই মরে গিয়ে বেঁচেছে।
হ্যাঁ, জন্মের সময় থেকেই তার চোখের মণিদুটো মিলেমিশে থাকতে পারেনি। একজন যদি আবিরের কথা শুনে একদিকে আসে তো অপরটি জায়গা ছেড়ে নড়ে না। মা আদর করে বলে ছেলে তার লক্ষীট্যারা, পরিবারের সৌভাগ্য। ছোটবোনটা সারাদিন তার পিছে পিছে ঘোরে। কিন্তু মা আর বোনের মত করে আর কেউ যে ভাবে না! তার হাসিটা একদম বাচ্চাদের মত, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। ফার্স্ট হয়নি সে কখনো, কিন্তু কোনদিন পাঁচের বাইরেও যায়নি।বাস্কেটবল খেলায় বন্ধুরা তাকে তার হাইটের জন্যই টানাটানি করে। কিন্তু আবির যায় না, জনবহুল কোন পরিবেশে সে যায় না। তার কষ্টে অর্জিত সব গুণাবলী ব্যর্থ হয় প্রতিনিয়ত; স্রষ্ঠার তুলির আঁচড় একটুখানি বেঁকে যাওয়ায়। মানুষের দেয়া প্রতিটি আঘাত প্রতিহত করার জন্য আবির বেছে নিয়েছে সবচেয়ে সহজ পন্থা। আড্ডায় সে নিজেই ব্যঙ্গ করে তার দুর্বলতার, প্রচন্ড হাসায় সে সবাইকে। বন্ধুদের ছুড়ে দেয়া কথা গুলো এসে তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। অনেক আগেই হৃদয়ের চারপাশে সে গড়ে তুলেছে পাথরের প্রাচীর।
মেয়েটিকে আবির দেখেছিলো ধানমন্ডিতে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে। ১৬ নাম্বার রোডে তার ছোটবোন কোচিং করে। বৃষ্টিতে রিক্সা পায় কি না পায় সেজন্য আবির সেদিন গিয়েছিলো বোনটাকে আনতে। গিয়ে দেখলো এক গ্রুপ মেয়ে দাঁড়িয়ে হাহা হিহি করছে। বোনের জন্য অপেক্ষারত আবির সাবধানে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ায়। কোন মেয়েদের গ্রুপের সামনে পড়ে তাদের বাড়তি আনন্দ দেয়ার ইচ্ছা তার নেই। তখনই নজরে পড়লো মেয়েটিকে, একাকী দাঁড়িয়ে, ছাতার সাথে যুদ্ধরত অবস্থায়। ছাতাটার রড একপাশে বেঁকে গিয়েছে, তাই কিছুতেই সোজা হচ্ছে না। লাজুক মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেয়েটা খানিকক্ষণ চেষ্টা করলো ছাতা ঠিক করতে,তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টির কাছেই আত্মসমর্পন করলো। প্রচলিত অর্থে মেয়েটিকে কোনভাবেই সুন্দরী বলা যায় না। বেশ শ্যামলা, স্বাস্থ্যও একটু ভালো। অন্তত এখনকার মেয়েদের মত জিরো ফিগার তো অবশ্যই না। চেহারা একেবারেই বিশেষত্বহীন, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কিন্তু আবিরের নজর কাড়লো তার চোখজোড়া, বিষন্ন আত্মবিশ্বাসহীন অসহায় একজোড়া চোখ। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের কুচ্ছিত হাঁসেরছানার মত ভীত যে কিনা এখনো জানেই না যে সে পথ ভুলে অন্য কোথাও এসে পড়েছে। ফিস ফিস করে আবির নিজেকেই বলে, “তোমায় আমি দেখেছিলাম... ঘন বর্ষায় নীল ছাতা হাতে... তোমায় আমি দেখেছিলাম...”
মেয়ের নাম জোগাড় করা তেমন কঠিন কিছু হলো না। বোনকে জিজ্ঞেস করতেই সে ঠোঁট উলটে বলে দিলো। সব টিনএজারের মত তার বোনও অতিরিক্ত কথা বলে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবিরের নাজিফার সম্পর্কে সব জানা হয়ে গেলো, তবে দুঃখের কথা হচ্ছে নেতিবাচক কথাই বেশী। মেয়েটা বন্ধু-বান্ধবহীন, কিছুটা অদ্ভুত, কাপড়-চোপড়ের সেন্সবিহীন, কঠিন ছাত্রী এবং ভীষন ভাবে থাকে। মেয়েটার কথা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিরের মাথা থেকে চলে গেলো। মাস দেড়েক আগে সে ধানমন্ডি লেকে গিয়েছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে। আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ রাস্তায় তাকিয়ে দেখে জ্যামের মাঝে মেয়েটি রিক্সায় বসে আছে। মেয়ের শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আর হাতের উলটা পিঠ দিয়ে বারবার মুখ ঘসছে। বালিকা কাঁদছে। কেন জানে না আবিরের ভীষন মন খারাপ হলো। আহারে, মানুষের জীবনে কতই না দুঃখ থাকে। ওর তাকানো দেখে ওর দুই-তিনজন বন্ধুও তাকালো। নাজিফাকে আবির দেখছে দেখে শুরু হয়ে গেলো পচানো। “কি রে দোস্ত, হাতি পালার শখ হইছে নাকি তোর!” “ফেয়ার এন্ড লাভলীর একখান চৌবাচ্চায় যদি এইডারে চুবানো যায় ফেয়ার এন্ড লাভলী কালা হইয়া যাইবো এই মেয়ের কিছু হইবো না!”- ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি কথা যেন আবিরের গায়েই এসে লাগলো। একটা মানুষকে না জেনে কি চমৎকারভাবে তার বন্ধুরা শুধুমাত্র মেয়েটির চেহারা দেখেই তার সম্পর্কে ধারনা করে ফেললো! যেহেতু দেখতে অপ্সরী না সেহেতু এই মেয়েকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার কোন প্রয়োজন নেই। অথচ প্রত্যেকেই ভালো পরিবারের ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। ফেসবুকে বা ব্লগে এরাই গলা ফাটিয়ে চেঁচায় যে মেয়েদের সৌন্দর্য পরিমাপ করার অর্থ তাদের পণ্যে পরিণত করা, ভার্সিটিতে নারী দিবসে মেয়েদের সম্মান রক্ষার্থে র্যালিতে ভূমিকম্প তুলে ফেলে। অথচ র্যালি থেকে বেরিয়েই মোবাইলে সদ্য তোলা ছবিগুলোতে কোন মেয়ে সুন্দরী কোন মেয়ে কি কাপড় পড়েছে সেসব নিয়ে আলোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। আবিরের গা ঘৃণায় রিরি করে ওঠে। কেউ মেয়েদের নিয়ে কিছু বললেই ছোটবোনটির কথা মনে পড়ে ওর। ইশশ, যদি ও ওর বোনটাকে এমন একটা দেশে পাঠাতে পারতো যেখানে সবাই মেয়েদের মানুষ হিসেবে দেখে!
ফেসবুকে মেয়েকে খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলায় পড়লো সে। বোনের ফ্রেন্ডলিস্ট তোলপাড় করে খুঁজেও নাজিফা নামে কাউকে পাওয়া গেলো না। হয়ত মেয়ে ফেসবুক ব্যবহারই করে না। কিন্তু প্রকৃতির ইচ্ছে বোঝা বড় মুশকিল। আবির সেদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ল্যাবে বসে ফেসবুক গুতাচ্ছিলো, হঠাৎ দেখলো তার বোনকে কে যেন বেশ কিছু ছবিতে ট্যাগ করেছে। অভ্যাসবশত ছবিগুলো খুললো সে। খুলেই স্তম্ভিত! এক ছবিতে মেয়েটি তার বোনের হাত ধরে হাসিতে ফেটে পড়ছে, নিশ্চই খুব মজার কোন গল্প হচ্ছিলো। শিশুর সারল্য মেশানো হাসি। ট্যাগ ধরে এবারে মেয়েকে পেয়ে গেলো আবির, লাজুক রাজকন্যা। পুরো রাত ইতঃস্তত করে কাটানোর পরে মেয়েকে মেসেজ পাঠিয়েই দিলো সে। কিছুক্ষণ পরেই উত্তর এলো ওপাশ থেকে। সংশয় কাটিয়ে উঠে আবির টাইপ করতে শুরু করলো। প্রথমে দিনে দুই-তিনটা মেসেজ, তারপর সাত-আটটা... আর তারপর অগণিত। ক্লাসের ফাঁকে, আড্ডার মাঝে, ফুটপাতে চা-হাতে অথবা ভাত খাবার টেবিলে... ক্ষুদেবার্তা আসার নোটিফিকেশন আসলেই সে লাফিয়ে ওঠে। কড়কড়া রোদে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে অথবা বর্ষনমুখর বিকেলে জারুল ফুলের গালিচা মোড়ানো কলাভবনে দাঁড়িয়ে আবির মোবাইল টিপতে থাকে। ওপাশ থেকে মিষ্টি এক কিশোরীর নুপুরের রিনিকঝিনিক শব্দ ভেসে আসে...আবির তন্ময় হয়ে শোনে। কল্পনায় কিশোরীর সাথে খালি পায়ে বৃষ্টিস্নাত ফুলার রোডে হেঁটে বেড়ায় ও, কিশোরী ফুচকার দোকান দেখে দাঁড়িয়ে আবদার করে। ফুচকার প্লেট দিয়ে গিয়ে কিশোরীর আঙ্গুলে ওর স্পর্শ লাগে। কিশোরী লাজুকভাবে চোখ নামিয়ে নেয়, আবির মুগ্ধ হয়ে দেখে। হৃদয়ের প্রতিটি কণা চিৎকার করে কিশোরীকে বলে, “তুমি সুন্দর, বৃষ্টিভেজা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতই তুমি সুন্দর”।
বিবর্ণ কৃষ্ণচূড়াঃ শেষ পর্ব