নাজিফার গল্প
“নাজিফা! অ্যাই নাজিফা!!” রাগত স্বরে মেয়েকে ডাকেন নাজমা। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেলো অথচ মেয়ের খবর নেই।
“নাজিফা!!!!”
“আম্মু আসছি, আর দুই মিনিট!”
“আমি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াবো না ফাজিল মেয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়ে এত কি? হ্যাঁ? মার্কেটে দেখবেটা কে তোকে শুনি?”
রাগের মাথায় বলা সাধারন কথাটা নাজিফার বুকে এসে লাগে। মূহুর্তে চোখে পানি চলে আসে। অতি কষ্টে ঠেলে আসা কান্নাটা গিলে ফেলে আয়নার দিকে তাকায় সে। আম্মু তো ঠিকই বলেছে, দেখবেটা কে তাকে? চিরুনি ওখানেই ফেলে সে করিডোরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “আম্মু আমি যাবো না”।
নাজমার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হয়। “কেন যাবি না?”
দূর থেকেই উত্তর আসে, “আমার ভালো লাগছে না”।
বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে আর একটা কথা না বলে নাজমা বেরিয়ে যান। এই মেয়ের যন্ত্রনায় তার জীবন অস্থির। বড় ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে তার তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি, কিন্তু ছোটটাকে কোন ভাবেই উনি বুঝতে পারেন না। ক্লাস টেনে পড়া নাজিফা তার একটু বেশী বয়সের সন্তান। মেজটার সাথে বয়সের গ্যাপ ১০ বছরের। পান থেকে চুনও খসতে হয়না, তার কি থেকে কি হয় কে জানে, রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। থেকে থেকেই নাজমার মনে হয় মেয়েটাকে একটু কাউন্সিলার দেখানো দরকার। পিজি হাসপাতালে নাকি বেশ কিছু ভালো কাউন্সিলার বসেন। কিন্তু নাজিফার বাবা হেসেই উড়িয়ে দেন।
দরজা বন্ধ করেই নাজিফা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্নাকাটি তার কাছে নতুন কোন বিষয় না। এ বিষয়ে যদি কোন পদক আনার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সে নির্ঘাত বাংলাদেশের হয়ে সোনা জিততো। সপ্তাহের সাতটি রাতের মাঝে ৫টি রাতই সে কাঁদে। আজকাল সে কান্না লুকানোতে এত অভিজ্ঞ হয়ে গেছে যে ক্রন্দনরত অবস্থায় কথা বললেও তার মা বা ভাই-বোন দরজার ওপাশ থেকে কিছুই বুঝতে পারেনা। কাঁদতে কাঁদতে দেয়াল আলমারিতে লাগানো বিশাল আয়নার দিকে তাকায় সে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বড় বড় কিছু অশ্রুকণা। অসম্ভব কালো এবং বেশ মোটা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, চোখ-মুখ ফুলে আরো বিশ্রী অবস্থা। চোখ ফিরিয়ে দেয়ালে তাকিয়ে আরো বেশী কষ্ট লাগে তার। কক্সবাজারের সৈকতে তারা তিন ভাই বোন মা-বাবার মাঝখানে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। তার পরিবারের প্রত্যেকে ফর্সা, এমনকি সারাদিন রোদে ঘুরে বেড়ানো ভাইটা পর্যন্ত। মাঝখান থেকে কেন তার গায়ের রঙ এমন হলো ভেবে পায় না সে। তার বাবা বলেন নাজিফা নাকি দেখতে একদম তার দাদীর মত হয়েছে, আদর করে তিনি নাজিফাকে ডাকেন ছোট-মা। তার জন্মের আগেই দাদী মারা গেছেন, তারপরেও দাদার ওপরে নাজিফার অনেক রাগ। কি দরকার ছিল তার কালো বউ ঘরে আনার? তার বাপ-চাচা সবাই পেয়েছে দাদার রঙ আর মাঝ থেকে সে হয়েছে দাদীর ছায়া! কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে দোষারোপ করে নাজিফা, দিনের মাঝে অসংখ্যবারই করে। রঙ কালো হয়েছে তাও মানা যায়, সবাই তো আর ফর্সা না। ওর ক্লাসেও অনেক মেয়ে কালো, কিন্তু তারা কেউ নাজিফার মত না। কালো মেয়েদের কিছু না কিছু সৌন্দর্য থাকে। কারো থাকে রেশমের মত ঝলমলে চুল অথবা কারো থাকে কাজল ছাড়াই টানা টানা চোখ অথবা চমৎকার ফিগার। এই যেমন ধরা যাক তার বান্ধবী মাহীর কথা। মাহীর রঙ নাজিফার মতই কালো, কিন্তু তাতে কি? মাহীর দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো মুস্কিল। লম্বাটে চেহারা, ভলিউম লেয়ারের লম্বা চুল, যা পরে তাতেই দেখতে অপূর্ব লাগে। মাহী কথাও বলে খুব সুন্দর করে। নাজিফার কোন কিছুই ভালো না। সে খাটো, যথেষ্টই মোটা, চুল এত পাতলা যে বব কাট করে রাখতে হয়, দূর থেকে বোঝা না গেলেও কাছে এলে বোঝা যায় যে মুখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত, এমনকি নাকটা পর্যন্ত থ্যাবড়ানো। তার চোখজোড়া অবশ্য মন্দ নয়, কিন্তু চশমার ফ্রেমের আড়ালে সে চোখ খুঁজে বের করার ধৈর্য কার আছে? আচ্ছা তার দাদী কি সে আমলের ডাইনী বুড়ি ছিল? নতুবা এরকম চেহারার একজন মানুষের দাদার মত সুপুরুষ স্বামী জোটে কিভাবে?
চোখ মুছে ল্যাপটপে বসে ফেসবুক খোলে সে। জানে যে তার মন আরো খারাপ হবে, তারপরেও। এ এক অদ্ভুত নেশা। হোমপেজ দেখেই নিজেকে আরো ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। তার বান্ধবীদের কি চমৎকার সব ছবি। মাহীটা কাল স্কুল পালিয়ে আশুলিয়া গিয়েছিলো তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে, সেই ছবি আপ করেছে আজ। রূপা আর সোনিয়াকে দেখা যাচ্ছে তাদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কেএফসির দাদু পুতুলের সাথে। গ্রুপ ডেট। এধরনের আড্ডায় কখনো নাজিফাকে ডাকা হয় না, সে বড্ড বেমানান এসবের সাথে। নোটিফিকেশন চেক করে তার আতংকে গলা শুকিয়ে যায়। স্বর্ণা তার জন্মদিনের ছবি আপলোড করছে এবং তাতে তিনটি ছবিতে নাজিফাকে ট্যাগ করেছে। নাজিফা দ্রুত ছবিগুলো দেখতে থাকে...এটা কিভাবে সম্ভব? তার যেন কোন ছবি না ওঠে সে ব্যাপারে সে সদাসতর্ক থাকে। কোন ফাঁকে গ্রুপছবিতে সে ঢুকে গেছে। তাড়াতাড়ি ছবিগুলো আনট্যাগ করে সে। প্রতিটি ছবিতেই তাকে ভয়াবহ দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগছে যেটাতে সে মহুয়ার হাত ধরে হাসছে। মহুয়ার মিষ্টি হাসির পাশে তাকে সাক্ষাত কাজের বুড়ি বেটির মত দেখাচ্ছে। এরকম চেহারার একটা মেয়ের ট্যাগ যদি বলে “লাজুক রাজকন্যা” তবে ল্যাপটপের স্ক্রিন ফেটে চৌচির হবে। অবশ্য আগে সে গ্রুপ ছবি আনট্যাগ করতো না; আর সে ছিলোও তার আসল নামেই, নাজিফা আহনাফ। কিছুদিন আগে রুবির প্রোফাইলে গ্রুপ ছবিতে এক ছেলে কমেন্ট করেছিলো, “তোমার পাশে এই কালা ধুমসীডা কেডা? পুরা ছবির জায়গা তো একলাই খায়লাইলো!” কমেন্টটা রুবী মুছে ফেলেছে দেখার সাথে সাথেই, কিন্তু সে জানে না তার আগেই নাজিফা দেখেছে। সারা রাত কেঁদেছে সেদিন ও। কান্না শেষ হবার পর প্রথম যে কাজটি করেছে সেটি হলো প্রোফাইলের নাম এবং বর্ণনা পরিবর্তন। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে খুঁজে খুঁজে যাবতীয় ছবি আনট্যাগ করে দেয়া। এবং তৃতীয় কাজটি হচ্ছে প্রোফাইলের প্রাইভেসি অপশনে গিয়ে প্রোফাইল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। যেহেতু তাকে খুঁজে বের করার কোন উপায় নেই, সেহেতু অপশন নিয়ে কোন মাথাব্যথাও নেই।
টুং শব্দে স্ক্রিনে তাকিয়ে নাজিফা দেখে তার ইনবক্সে একটি মেসেজ এসেছে। হবে কোন ছেলে। ছেলেরা রাজকন্যা, অ্যাঞ্জেল, প্রিন্সেস জাতীয় নাম দেখে খুব আগ্রহ নিয়েই অ্যাড করে কিংবা মেসেজ পাঠায়। তবে কেউই তার বন্ধু হতে পারে না। কথাবার্তা শুরু হবার ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাঝে তারা ছবি দেখার জন্য ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দেয়। সেটা এড়াতে চাইলেই একেক জন একেকরকম রিএ্যকশন দেখায়। এক গ্রুপ কোন কথা বার্তা না বলে আনফ্রেন্ড করে বিদেয় হয়, আরেক গ্রুপ “মানুষের মনই যে মুখ্য, চেহারা যে গৌণ” সে বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে মাথা ধরায় আর তৃতীয় গ্রুপ বড়ই ভয়ংকর। তারা তাকে ছেলে ধরে নিয়ে “তুই শালা ফেক আইডি” “ব্যাটা বেজন্মা মাল্টি” ইত্যাদি বলে গালিগালাজ শুরু করে। সেগুলোকে তারই তখন ব্লক করতে হয়। তারপরেও নাজিফা হাল ছাড়েনা। সে মিরাকেল নামক শব্দটিতে এখনো আস্থা রাখে। প্রতি রাতেই কাঁদতে কাঁদতে সে কল্পনা করে একটা ছেলে তার জন্য গোলাপ নিয়ে স্কুলের সামনের গাছে ঠেস দিয়ে অপেক্ষা করছে। কোন ছেলে যদি হঠাৎ সঠাৎ তাকিয়ে বসে, নাজিফা সেটা নিয়ে তিন রাত কল্পনায় থাকে। “ভালোবাসি” শব্দটি শোনার জন্য বুভুক্ষের মত প্রতীক্ষায় আছে সে। না হয় হলো মিথ্যে করেই! নতুবা দামী স্কুলে পড়া নাজিফার চলতি মতে “জাতে ওঠা” হয়ে উঠছে না। কোন আড্ডায় সে মিশতে পারে না। কেউ তার মত বই পড়ে না, ক্লাসের ৯০ ভাগ মেয়ে লেখক বলতে শুধু জানে হুমায়ূন আহমেদ আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম। কেউ গান শোনে না, কেউ কম্পিউটারে গেমস পর্যন্ত খেলে না। হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, মেকআপ আর ছেলে- এই চারটি বিষয়ে তাদের যাবতীয় কথাবার্তা সীমাবদ্ধ। নাজিফা হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়াল ভালোই দেখে, মেকআপের যাবতীয় সরঞ্জাম চাহিবা মাত্র সে তার আপুরটা নিতে পারে; শুধু চতুর্থ বিষয়েই সে নিশ্চুপ। গত বছর সে পার করেছে তার সুইট সিক্সটিন, কিন্তু ডিজনীর প্রিন্স আসলো কই?
মেসেজটা খুলে দেখে নাজিফা। “অচেনা আঁধারে” নামে কেউ একজন পাঠিয়েছে। মেসেজটি একটু অন্য ধরনের এবং সংক্ষিপ্ত। “লাজুক রাজকন্যা, আমি বাস করি আধাঁরে। তবে মাঝে মাঝে আলো দেখতে সাধ জাগে। কৃত্রিম বৈদ্যুতিক আলো না, ভোরের সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি। বন্ধু হবে?” নাজিফা একটু অবাক হয়। অচেনা আঁধারের প্রোফাইল ঘেটে সে কোন কিছু বের করতে ব্যর্থ হয়। না আছে কোন বর্ণনা, না আছে কোন ছবি। এমনকি সে ছেলে না মেয়ে সেটিও লেখা নেই। তবে প্রোফাইল ভর্তি চমৎকার সব স্ট্যাটাস। ছোট গল্প, কবিতা, রম্য অথবা সমসাময়িক ঘটনা। প্রতিটি স্ট্যাটাসেই হাজারখানিক করে লাইক, প্রচুর শেয়ার। এ যেই হোক, ফেসবুকে বেশ বিখ্যাত। কিছু কমেন্ট পড়ে নাজিফা বুঝলো যে এটা কোন ছেলে হবে। পর পর কয়েকটা গল্প পড়ে ফেললো নাজিফা, চমৎকার লেখা। এই ছেলে তার বন্ধু হতে চায়? নিঃশ্বাস না ফেলে নাজিফা উত্তর লিখলো, “আপনার প্রোফাইল দেখলাম। মনে হচ্ছে আপনি বেশ বিখ্যাত। আমি সাধারনের মাঝেও সাধারন। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। বন্ধু হতে পারবেন তো?” প্রায় সাথে সাথেই উত্তর আসে, “ফেসবুকে অনেকেই বিখ্যাত হয়। সেসব ফানুসের মতই, দৃষ্টি সীমানার বাইরে গেলেই ফুস! আর হলামই বা বিখ্যাত, সে তো আর গায়ে লেখা থাকে না। এই মেসেজে আমি আপনার পাশের বাড়ির ছেলেটির মতই সাধারণ, একটি মেয়ের কাছে তার বন্ধুত্ব প্রার্থনা করছে। বিঃদ্রঃ লাইনটি আমার নয়, পুরনো একটা সিনেমা থেকে সামান্য পরিবর্তন করে মেরে দিয়েছি”। নাজিফা হেসে ফেললো। তড়তড়িয়ে কিবোর্ডের উপর দিয়ে চললো তার দু’হাতের আঙ্গুলগুলো।
এইইই ছিল শুরু... অচেনা আঁধার আর লাজুক রাজকন্যার যৌথভাবে লেখা গল্পের। এবারের গল্পটা লেখা হচ্ছে একদম অন্যভাবে। নাজিফা অবাক হয়ে দেখলো এই ছেলে তিনগ্রুপের কোনটিতেই পড়ে না, তাকে রাখতে হবে একদম আলাদা একটা স্থানে। গ্রুপ বলা যাচ্ছে না, কারন আর কাউকে সম্ভবত পাওয়া যাবে না। এক মাস ধরে তারা দিন নেই রাত নেই চ্যাট করে যাচ্ছে কিন্তু একবারও অচেনা আঁধার না জিজ্ঞেস করেছে তার নাম, না দেখতে চেয়েছে কোন ছবি। মাঝেমাঝে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত গল্প করে তারা ফেসবুকে। সতের বছরের বরফের মত জমে থাকা কথা গুলো আস্তে আস্তে গলে বেরিয়ে আসছে।নাজিফা নিজেই জানতো না যে সে এত কথা বলতে পারে, এত বই সে পড়েছে, এত গানের কলিও যে তার মুখস্ত! অচেনা আঁধারও ঠিক তার মত। স্কুলের সময়টুকু ছটফট করে নাজিফা, তাদের স্কুলে মোবাইল ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার কারনে সে ওই সময়ে অচেনার সাথে কথা বলতে পারে না। মেসেজ দিয়ে উত্তর পেতে সামান্য দেরী হলে গলার কাছে কান্না মুচড়ে ওঠে। সারাক্ষণ কেমন যেন একটা উচাটন ভাব। একেই কি বলে ভালোবাসা? কিশোরীবেলার প্রথম ভালোবাসা?
বিবর্ণ কৃষ্ণচূড়াঃ ২য় পর্ব
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল মামু।