মেলবর্ন ডায়েরী : আয়না দিবস
দিনটা শুরু হয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবেই। রবিবার, ছুটির দিন। ছুটির দিনের সব নিয়ম মেনে চলছিলাম, দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা...নাস্তা নিয়ে নাক সিঁটকানি...সবই। বেলা বারটার দিকে দেখা করতে গেলাম বান্ধবীর সাথে। আসলে বান্ধবী বলা ভুল...সোজা বাংলায় বললে জিগারের দোস্ত, ইংরেজীতে যাকে বলে Bestie আর নিজের ভাষায় বললে “সব আকাম-কুকামের নির্ভরযোগ্য সাথী”। আমি যে মাসে অস্ট্রেলিয়া এসেছি ঠিক তার আগের মাসে সেও এসেছে। তবে দুই শহরের মাঝের দূরত্ব প্রায় ১০০০ কিমি, অর্থাৎ প্রায় ১০-১১ ঘন্টার যাত্রাপথ। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ছয়-সাত মাস আগে দেখা হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে আল্লাহ চাইলে কি না হয়। হঠাৎ করেই সে ৬ সপ্তাহের জন্য মেলবর্নে! যা হোক, একজন আরেকজনের বাসায় যেতে পারিনা, সেও দেড় ঘন্টার সফর; দুইজনেই থাকি শহরতলীতে। সুতরাং সময় পেলেই সিটিতে ছুটি দেখা করতে। সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক... ট্রামের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা খেলাম, ট্রামে উদাস ভাবে গান শুনলাম...ট্রাম থেকে নেমে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলাম... সিটি চষে বেড়ালাম গুগল ম্যাপ খুঁজে... কারণ ছাড়াই খ্যাক খ্যাক করে হাসলাম... চিৎকার করে কথা বললাম...ন্যানদোসে ঢুকে হইচই বাঁধিয়ে দিলাম... সবই স্বাভাবিক। চার ঘন্টা চার মিনিটের মত উবে গেলো...ফ্লিনডার্স রেল স্টেশনে ওকে বিদায় জানিয়ে আমি ট্রামে ফিরতি পথ ধরলাম।
রবিবারের ট্রাম, নিঃশ্বাস নেবার মত জায়গা নেই। মোটামোটি স্যান্ডউইচ অবস্থায় আছি, হঠাৎ দেখি একজন নেমে গেলো। কারো মাঝে খালি জায়গা নেবার আগ্রহ দেখা গেলো না। কারণ অতি সাধারণ, বাকি তিনটি সিটে তিনজন বৃদ্ধা বসে আছেন। অজ্ঞাত কারণে এখানকার পোলাপান বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এড়িয়ে চলে; ঝুলে ঝুলে দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু সেখানে বসবে না। আমি “এক্সকিউজ মি” বলতে বলতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে জায়গা দখল করলুম। বসার সাথে সাথে মিষ্টি হাসি দিয়ে একজন বৃদ্ধা স্বাগত জানালেন। প্রথমেই আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো তার কানের বেপরোয়া ধরনের লাল রঙের দুল জোড়া। আমি প্রতিউত্তরে ছোট্ট হাসি দিয়ে কানের মাঝে ইয়ারফোন ঢুকালাম। গান খুঁজতে খুঁজতে শুনতে পেলাম আমার পাশের লাল রঙের কোট পরা বৃদ্ধা (বয়সকালে মহিলা যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন তা বলতে দুইবার দেখতে হয়না) বলছেন, “বাসায় যাবার আগে একটা মুরগী কিনবো। যদি আজ রাতে রেঁধে ফেলি আগামী দুইদিন চলে যাবে, কি বলো?” লাল দুল উত্তর দিলো, “কিভাবে রাঁধবে বলো তো! আমি সেদিন নেটে একটা চমৎকার রেসিপি দেখেছি”। ভীষন শান্ত চেহারার তৃতীয় বৃদ্ধা (ধূসর টুপি) উত্তর দিলো, “এসব বাদ দিয়ে ডায়েটিং এর চিন্তা করো! চেহারা কিন্তু দিনদিন খারাপ হচ্ছে!” সবার সম্মিলিত হাসি। লাল কোট হঠাৎ লালদুলের হাতের ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “আমরা কি খুব বেশী খরচ করে ফেলেছি নাকি আজকে!! যা দেখি সবই পছন্দ হয়, কি যে সমস্যা!” লালদুল উত্তর দিলো, “তোমারই তো দোষ! তোমারটা দেখেই তো আমি কিনলাম!” হাসতে হাসতে ধূসর টুপি বললো, “একটা গোপন কথা বলি, কাউকে বলো না। আমার মেয়েকে ডাক্তার বলেছে ২০ কেজি ওজন কমাতে। যদিও আমার মেয়ে স্বীকারই করে না যে তার ওজন ১০০ ছাড়িয়েছে!”
অত্যন্ত সাধারন কথা বার্তা, শুনে অবাক হবার কিছুই নেই...কিন্তু আমি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণ শুনেই বুঝতে পারলাম যে এঁরা দীর্ঘদিনের বান্ধবী। কতদিন হবে? অন্তত ১৫-২০ বছর, নাকি তারচেয়েও বেশী? তারা আড্ডা দিতে থাকলো... আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম। হঠাৎ করে মনে হলো আমি মেলবর্নের ট্রামে না...ঢাকা মেডিকেলের চত্বরে বসে আছি। পাংশু মুখে আমি আর ফারিয়া জামার প্যাকেট হাতে নিয়ে বসে আছি। একই রকম জামা কিনে এনেছি, এখন মাসের বাকিদিন গুলোর খাওয়া খরচ কোথা থেকে আসবে কে জানে! মিমো এসে ঘ্যান ঘ্যান করছে কেন তাকে ওয়ার্ডে রেজিস্টার স্যার বেশী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে অপমান করে, আসিফ এসে বললো, “গোপন খবর শোন! অমুক কিন্তু তমুকের সাথে এক্কেবারে লিংকড আপ। একখান মারামারি বাঁধবো হাসপাতালে ঐ মাইয়া লইয়া, আমি নিশ্চিত!”
হঠাৎ কেউ একজন গায়ের উপরে এসে পড়লো। তাকাতেই একটা ছেলে অপরাধীর হাসি দিলো। আমি বিষ্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম, আমার কাছে মনে হলো তানভীর দাঁড়িয়ে আছে, পাশে আবিদা। আমরা নেপালের ভয়ংকর এক দুর্গম জায়গায় লোকাল এক বাসে সবাই চিড়ে চিপ্টে হয়ে দাঁড়িয়ে-বসে আছি। সামনের রাস্তা মিলিটারি আটকে দিয়েছে, প্রায় এক দিন ধরে পেটে খাবার নেই, পানি খাইনি...কিন্তু আনন্দের কমতি নেই! এর মধ্যেই বাসে আয়োজন করা হয়েছে নৃত্য-গীতি অনুষ্ঠান...তারিক পিছন থেকে ভোকাল দিয়েই যাচ্ছে, প্রানশক্তির অভাব নেই!
ট্রাম এক স্টপে থামতে এশিয়ান এক মেয়ে উঠলো। ততক্ষণে ট্রামের ভিড় বেশ কিছুটা কমেছে। মেয়ে উঠে বসতে যেতেই পেছন থেকে আরেকটা মেয়ে ডাকলো। প্রথম মেয়েটির মুখে দ্রুত কিছু অভিব্যক্তি খেলে গেলো... বিষ্ময়...অবিশ্বাস অতঃপর বাঁধভাঙ্গা আনন্দ! চিৎকার করে দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো... সিটে বসেও তাদের হাসি থামে না। আমি অবাক হয়ে ভাবছি...ওরা কি আমি আর ফারিয়া না? পোখারায় স্বপ্নের প্যারাগ্লাইডিং শেষ করে ল্যান্ডিং করেই প্যারাসুট আর হেলমেট না খুলেই একজন আরেকজনের দিকে দৌড়! আহ কি আনন্দ...আমরা আকাশে উড়েছি!
আমি সজোরে মাথা ঝাঁকালাম...পাগল হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম... ৫/৬ জন ছেলে মেয়ে হাতে বার্গার আর কোক নিয়ে রাস্তার ধারে এক চত্বরে বসে হাসাহাসি করছে। মূহুর্তেই ছেলে মেয়ে গুলো হয়ে গেলো ফারিয়া, আসিফ, আহাদ, দীপন, চৈতী আর মালেকা! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না যখন দেখলাম নীল রঙের শার্ট (যেটা আমরা সবাই শখ করে কিনেছি দিল্লী থেকে) পরে আমি নিজে ডমিনসের চকোলাভা হাতে নিয়ে চিৎকার করছি। সেকেন্ডের মাঝে পার হয়ে গেলাম জায়গা। কফি হাতে এক টুপি পরা মেয়ে হাসতে হাসতে যাচ্ছে একটা লম্বা ছেলের সাথে... মনে হচ্ছে টেম্পুর সাথে আমি হেঁটে যাচ্ছি, হাতে কফির বদলে কোকের প্লাস্টিকের বোতল... ডাস থেকে বের হয়ে ফুলার রোডের দিকে হেঁটে যাচ্ছি... নিরর্থক গন্তব্যবিহীন হন্টন! জানি না কোথায় যাবো, জানতেও চাই না কোথায় যাওয়া প্রয়োজন।
হাসির শব্দে চটকা ভাঙলো। তিন বৃদ্ধা প্রাণ খুলে হাসছে...আহ কি প্রাণবন্ত! লাল দুল লাল কোটকে মনে করিয়ে দিলো যে তার স্টপ চলে এসেছে প্রায়। লাল কোটের রূপবতী বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বেরুবার অনুমতি চাইলো। আমি কি ভেবে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “আচ্ছা কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো? আপনারা কতদিন ধরে একজন আরেকজনকে চেনেন?” তিনজনেই মজা পেয়ে হাসলো, রূপবতী বললো, “probably you weren’t even born then!” স্টপ এসে গেছে, উনি নেমে গেলেন। আমার কাছে মনে হলো জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ফারিয়াকে আমি আসিফ আর মিমো বিদায় জানাচ্ছি।
লাল দুলও বিদায় জানিয়ে পরের স্টপেই নেমে গেলো। এখন শুধু ধূসর টুপি আর আমি। অদ্ভুত এক আয়না মোড়া সুরঙ্গের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি আজ আমি। কোনভাবেই মনে হচ্ছে না এটা অপরিচিত কোন দেশ, অজানা এক জায়গা। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে একই ঘটনা, একই কাহিনী বারবার ঘটে যাচ্ছে...শুধুমাত্র বদলে যাচ্ছে চরিত্রে অভিনয় করা পাত্র-পাত্রী। এই মূহুর্তে আমি ছিমছাম শান্ত মেলবর্নের রাস্তা আর জনবহুল কোলাহলপূর্ন ঢাকার রাস্তার কোন পার্থক্য পাচ্ছি না... সামনে বসা বৃদ্ধা আর আমার মাঝে কোন বৈসাদৃশ্যও চোখে পড়ছে না। বৃদ্ধা যে চরিত্রে প্রায় ৩০ বছর আগে অভিনয় করেছে সেই চরিত্র সময়ের পরিক্রমায় আমার কাছে এসে ঠেকেছে। ট্রামের ঐপ্রান্তে দরজার কাছে অপেক্ষারত কিশোরির ভূমিকায় আমি একসময় ছিলাম। হয়ত আমি দাঁড়িয়েছিলাম সিলেটের মীরের ময়দানে, দাঁড়িয়ে ছিলাম রিক্সার প্রতীক্ষায়। বৃদ্ধা ভাগ্যবতী, বয়স যে বেড়েছে তা টেরই পাচ্ছেনা। চিরযৌবনের গুপ্তরহস্য তার হাতের মুঠোয়…বন্ধুরা তাকে ঘিরেই রয়েছে। ইচ্ছে হলেই সে হতে পারে ২০ বছরের তরুনী অথবা চল্লিশোর্ধ নারী, বন্ধুরা তার বয়স বাড়তে দেয়না! আমি ১৯৯৮ এ যেতে পারছি না, ২০০৬ এ না, এমনদি ২০১১ তেও না...একা একা এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া যায় না। টাইম মেশিনটা বড্ডো গোলমেলে, একা উঠলে ইঞ্জিন চালু হয় না। বন্ধুদের সাহায্য লাগে। অভিমানে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরলো। ধূসর টুপি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে...আমি মেঘলা দিনেও সানগ্লাসের দিকে হাত বাড়াই।
কিছু কিছু অর্থহীন দিন আচমকাই অকারণে আয়না মোড়া গোলকধাঁধা হয়ে যায়। অতীত বর্তমান সব মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। প্রাণপণ খুঁজেও বাস্তবতার কঠোর পথ মেলে না, স্মৃতিগুলো আয়নার প্রতিবিম্বরূপে আঁকড়ে ধরে। ফাঁদে পড়া আমার মত মানুষগুলো ছায়া দেখে আশায় থাকে যে এরকম দিন আবার আসবে, নিশ্চই আসবে। এরকম কিছু আয়না দিবসই তাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমি নিশ্চিত ঢাকায় অফিস ফেরত আমার বয়সী কেউ একজন বাসের ভীষন ভীড়ে এরকম আয়নার ফাঁদে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আমার মত সেই আরেকজনকে দেখতে বড় ইচ্ছে হয় আমার। পাশে বসে বলতে ইচ্ছে হয়... তুমি একা না, আমিও আছি তোমার সাথে।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন