মেয়ে, একবার তুমি নিজের দিকে তাকাও
কেস নাম্বার ১:
কার্ডিওলজীতে ব্যস্ত অ্যাডমিশন ডিউটি সামলাচ্ছি। দিনটাই ছিলো খারাপ, কোন রুগীকেই ভালো আছেন বলে ফেরত পাঠাতে পারছিলাম না। ট্রলিতে করে একটার পর রুগী আসছে, মাত্র দুইজন ডাক্তারের এত রুগী সামলানো একটু কষ্টকরই বটে। সেজন্য নাসরিন (ছদ্মনাম) যখন একটা ইসিজি করে এলো তখন তাকে একটু বসিয়েই রাখলাম। অভিজ্ঞতা বলে ২০-২১ বছরের ছেলে মেয়েরা হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা বুকে ব্যথা বলে পরিবার পরিজনকে ভয় দেখাতে এমনি এমনি চলে আসে। ব্যস্ততার মাঝে এসব রোগ ছাড়া রুগী অসহ্য লাগে। সব কাজ সেরে সবার শেষে আসলাম নাসরিন কে দেখতে। মেয়েটি দেখতে বেশ চমৎকার, হাসি খুশী। কলেজ পর্যন্ত পড়েছে, এর পরই বিয়ে হওয়ায় পড়াশোনা বন্ধ। বয়স ২৩, ইসিজি এক নজরে তেমন কিছু মনে হলো না, অভ্যাস বশত স্টেথোস্কোপ টা বুকে ঠেকাতেই চমকে উঠলাম। হৃদপিন্ড ভয়ংকর শব্দ করে চলেছে, এতই ভয়ংকর যে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে সব শব্দের অর্থ বোঝা অসম্ভব। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আজকেই প্রথম এলেন? আগে কোন সমস্যা হয়নি?” উত্তরে সে এক বস্তা রিপোর্ট বের করে আমাকে দেখালো। ভালভে সব জাতীয় গন্ডগোল তার ৩ বছর ধরে। প্রেগন্যান্সিতে হার্টের সমস্যা বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয় বাচ্চার সময়েই সে মর মর হয়েছিলো। এখন তৃতীয় বাচ্চা পেটে, আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তাই এসেছে। আমার তার ডাক্তারের উপর রাগ হলো। এত খারাপ কেস, ডাক্তারের পই পই করে নিষেধ করে দেয়া উচিত ছিল যাতে আর বাচ্চা না নেয়। বাচ্চা নেয়া তার জন্য সুইসাইডের সামিল। আমি বললাম, “আপনি কি জানেন যে বাচ্চা নেয়ার জন্য আপনার জীবন সংশয় হতে পারে?” সে মাথা নীচু করে বললো, “জ্বী জানি”। হতবাক হয়ে বললাম, “তাহলে?” এবারে পাশ থেকে উত্তর দিলো তার শ্বাশুড়ি, “আগের দুইটা বাচ্চাই তো মেয়ে”। কয়েক মুহূর্ত লাগলো আমার উত্তরটা হজম করতে। সিসিউএর মাঝেই এত জোরে ধমক দিলাম মহিলাকে যে আমার বন্ধু তার রুগী ফেলে দৌড়ে এলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে মেয়েকে বললাম, “তোমার জামাই এর কি মত?” মেয়ে অশ্রু টলমল চোখে বলল, “তারও একই কথা”। আর কোন কথা না বলে আমি তাকে ভর্তি করলাম, শুধু তার শ্বাশুড়িকে একটা কথাই বললাম, “এই মেয়ে যদি জীবিত এই হাসপাতাল থেকে বের না হয়, ডেথ সার্টিফিকেট আমি নিজে লিখবো এবং তাতে লেখা থাকবে, দিস ইজ এ পুলিশ কেস।” শ্বাশুড়ি আমাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না, দেয়ার কথাও না। এটা যে বাংলাদেশ তা আমি যেমন জানি, সেও জানে।
কেস নাম্বার ২:
কার্ডিওলজী ইউনিটেই স্যারের সাথে রাউন্ডে ছিলাম। দূর থেকে একটা রোগী দেখিয়ে স্যার প্রশ্ন করলেন, “বলতো ঐ রুগীর কি হয়েছে?” ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মহিলার বয়স আনুমানিক ৫০, অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের। আশে পাশের বাচ্চা গুনে দেখলাম ৪টি। হাপরের মত তার বুক একবার উপরে উঠছে একবার নামছে। লেফট হার্ট ফেইলুর হবার কথা। স্যার শুনলেন, তারপর বললেন, “আর?” আরেকজন ভাইয়া বললেন, আগে থেকে শ্বাসের সমস্যা থাকলে কর পালমোনালি হতে পারে। স্যার বললেন, “তোমরা আর কিছুই দেখতে পাচ্ছ না? দেখতে পাচ্ছ না তার ঐ পাশে যে একটা ছোট বাচ্চা শুয়ে আছে?” তারপরে স্যার রুগী দেখাতে নিয়ে গেলেন। ডিসিএম হয়ে ভয়াবহ অবস্থা। মহিলার বয়স ৪৭। তার স্বামী একটা গার্মেন্টসে চাকরি করে। অক্সিজেন নিয়েও সে শ্বাস নিতে পারছে না, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায় যে সে নিজেও চাইছে পাকাপাকিভাবে মুক্তি পেতে। এটা তার ৭ নাম্বার বাচ্চা, ৪ নাম্বার বাচ্চার সময়েই তার হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তারের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও তার স্বামী দিকপাত করে নি। দ্বিতীয় বাচ্চা ছেলে হলেও প্রতিবন্ধী, তাই তার আরেকটি ছেলে চাই ই চাই। গতকালই মহিলা তার স্বামীকে একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে। তার স্বামীর গর্বিত মুখ দেখলাম, পুত্র সন্তান পাওয়া গেছে। এখন মহিলা মরলেও বা কি, দেশে কি আর বিয়ে করার জন্য মেয়ের অভাব?
কেস নাম্বার ৩:
ইন্টার্ণীরত অবস্থায় একবার মাথায় ঢুকেছিলো যে গাইনী এবং ইনফার্টিলিটি মেডিসিন পড়বো। একারনে আমি একজন বিখ্যাত ম্যাডামের ক্লিনিকে কাজ করা শুরু করি। টেস্ট টিউব বেবী ব্যাপারটা আমাকে খুবই ইন্টারেস্টেড করেছিলো। বিকেলের ডিউটিতে আমার কাজ ছিলো রোগীদের ইতিহাস নেয়া। প্রচুর ইনফার্টিলিটি কেসের ইতিহাস নিতে নিতে দেখলাম, ২২-২৬ বছরের মেয়েরাও বাচ্চা না হওয়ার সমস্যায় ভুগে চলে আসছে। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখলাম যে তারা কোন কারনে প্রথম বাচ্চা ডিএনসি বা অন্য কোন উপায়ে নষ্ট করেছিলো। এরপর থেকে আমি গাইনী আউটডোরে যতদিনই বসেছি, কাউন্সেলিং জন্য আসলে আমি স্বামী-স্ত্রীকে বলেছি বাচ্চা ডিএনসি না করতে। একদিন ম্যাডামের রুমে বসে আছি, দেখলাম ৩২ বছরের একটা মহিলা দ্বিতীয় বারের মত ডিএনসি করতে এসেছে। মহিলা তার স্বামীর সাথেই এসেছে, বেশ ভালো অবস্থাপন্ন পরিবার। তার অবশ্য একটি পুত্র সন্তান আছে। আমি তাকে বললাম, “আপনাদের কি আর বাচ্চা নেবার ইচ্ছে আছে?” সে বললো, অবশ্যই। এটা শুনে ম্যাডাম বেশ বিরক্ত হলেন। বললেন, “তাহলে আপনারা আবার বাচ্চা নষ্ট করতে চান কেন? আল্লাহর দান আপনারা স্বীকার করেন না কেন? একবার ডিএনসি করা হয়েছে, আরেকবার করলে যে আপনার আর বাচ্চা নাও হতে পারেন তা জানেন?” উত্তরে মহিলা বললো, তার শ্বশুড় বেশ অসুস্থ। অন্য কেউ ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করতে চায় না, সপ্তাহের ৭ দিনই তাকেই ক্লিনিক আর ঘর সব সামলাতে হয়। এ অবস্থায় প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে তিনি শ্বশুড়ের যত্ম নিতে পারবেন না। ম্যাডাম রেগে বললেন, “আর কেউ নাই?” স্বামী কাঁচুমাচু করে বললো, “আমার ভাই বোন গুলি আসলে ঠিক দায়িত্ব নিতে চায় না।যদিও আমার সাথে থাকে একটা ছোট ভাই আছে, তারপরেও”। ম্যাডাম অনেক বুঝিয়েও, ডিএনসির অনেক কমপ্লিকেশন বলেও তাদের নিরস্ত করতে পারলেন না। মহিলা তার নিজের স্বাস্থ্যের চেয়ে তার পরিবারের দেখভাল করাকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করলো।
কেস নাম্বার ৪:
হাসপাতালে একটু কাজ বেশী থাকায় সেদিন বেরুতে দেরী হয়ে গিয়েছিলো। লাঞ্চ না করেই দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লিনিকে গেলাম। গিয়েই শুনলাম একটা ডিএনসি হচ্ছে ওটিতে, আমি যেন পেশেন্ট ফলো আপ করি। ম্যাডাম ব্যস্ত ছিলেন, কাজ শেষ করেই বেরিয়ে গেলেন, আমি রুগীর ঔষধপত্র লিখতে শুরু করলাম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি একটা মহিলা পাশে এসে বসে আছে, আমি ভাবলাম রুগীর লোক। লেখা শেষ করে ডিসচার্জ নোট দিতে গিয়ে দেখলাম মহিলার হাতে ক্যানুলা করা। পরে বুঝলাম এই মহিলারই ডিএনসি হয়েছে মিনিট পনের আগে। হায় হায় করে তাড়াতাড়ি বললাম তাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে। মহিলা নাছোড়বান্দা, সে ডিসচার্জ পেপার নিয়ে এখনি চলে যাবে। আমি তার ব্লাড প্রেশার আর অন্যান্য চেক করে দেখলাম নরমালের একটু নীচে। তাকে বারবার বললাম তাকে বিশ্রাম নিতেই হবে, মাত্র একটা অপারেশন হয়েছে। নতুবা আমি ডিসচার্জ পেপার দেবো না। মহিলা আমাকে কাতর অনুরোধ জানালো যে তার বাচ্চার কোচিং আছে, তাই ৪০ মিনিটের মাঝে বাসায় পৌঁছাতেই হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনার স্বাস্থ্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ না বাচ্চার একদিনের কোচিং? আপনার তো সাথে গাড়িও নাই, রিক্সা করে যে ঝাঁকুনি সহ্য করে যাবেন, ব্লিডিং শুরু হলে সেটা সামলাবেন কি করে?” মহিলার এক কথা, সে খুবই শক্ত, তার কিচ্ছুই হবে না। সে লুকিয়ে এসেছে ডিএনসি করতে, কারন তার বাসায় এখন দেবরের ভার্সিটির পরীক্ষা, ননদের ইন্টার পরীক্ষা, এক বাচ্চার জ়েএসসি না কি পরীক্ষা, আরেক বাচ্চার কোচিং- এখন সে প্রেগন্যান্ট হলে এদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হবে। নিজের যা ইচ্ছা হোক, কারো পড়াশোনার ক্ষতি করা যাবে না।
উপরের কেসগুলোর মত, বা এগুলোর চাইতেও হাজার গুণ খারাপ উদাহরন আমাদের আশে পাশেই ছড়িয়ে আছে। প্রথম যখন ইন্টার্ণী শুরু করি, তখন ভাবতাম যে দরিদ্র আর অশিক্ষিত মেয়েরাই এসবের বেশী শিকার হয়। এখন জানি, শিক্ষা অশিক্ষা বলে কিছু নেই, সব জায়গার অবস্থাই একরকম, শুধু বাহ্যিক খোলসটারই পার্থক্য। আমার এক বন্ধুর কথা জানি, যে সারাজীবন মেডিকেলের সব পরীক্ষায় চরম ভালো রেজাল্ট করেও বিয়ের পর পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়েছে। সে তার পছন্দের সাবজেক্ট ছেড়েছে তার স্বামীর সুবিধার জন্য, ট্রেনিং ছেড়েছে কারন তাতে পয়সা আসে না, পড়াশোনা ছেড়ে ক্লিনিকে চাকরি নিয়েছে যাতে তার ডাক্তার স্বামী পড়াশোনা চালাতে পারে। এত কিছু করেও তার স্বামী আর শ্বাশুড়ির মন ভোলাতে পারেনি, ডিভোর্স ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে এখন তাতে ব্যর্থ। এসবের জন্য দায়ী কে? অবশ্যই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, যে সমাজ নারী-পুরুষ উভয়ের সম-শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হলেও, সেই শিক্ষার ব্যবহার সম্পর্কে এখনো উদার হতে পারেনি। যতই আমরা একবিংশ শতাব্দী বলে গলা ফাটাই না কেন, এখনো এখানে নারীর জীবনের চেয়ে একটি পুত্রসন্তান অধিক কাম্য আর নারীর স্বাস্থ্যের চেয়ে তার পরিবারের আর সকলের দেখভাল করাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
মেয়ে, অনেক হয়েছে, এখন একবার তোমার নিজের দিকে তাকাও। তুমি যদি তোমার অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হও, কেউ তোমাকে তা এগিয়ে দেবে না। হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকাদের মত দয়া করে চুপ করে থেকো না, আল্লাহ তোমাকে জিহবা দিয়েছে কথা বলার জন্য। কথায় আছে, বাচ্চা না কাঁদলে মাও নাকি দুধ খাওয়াতে ভুলে যায়। তাই তুমি তোমাকে জানো, শক্ত হও। পথ অনেক কঠিন, আর তুমি তোমার পরিবার পরিজনের ভালোর চিন্তায় অনেক দুর্বল, তারপরেও, অন্তত একটি বার তুমি নিজেকে মেয়ে বলে না ভেবে মানুষ বলে ভাবো। তুমি যদি ভালো থাকো, অবশ্যই তোমার আশে পাশের সবাইও ভালো থাকবে।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন