বেফাঁস কথায় হাসফাঁস - ১
কথা বার্তা চলছে, চলবেই। বেফাঁস কথাও সেই প্রস্তর যুগ থেকে সবাই কে বিব্রত করছে, এখনো করবে। সবাই বলবে, এর পরে বাসায় এসে লজ্জায় পড়বে। এসব কথার উদাহরণের কোন শেষ নেই। আজকাল অনেক দোকানের সেলসম্যানদের দেখেই বোঝার কোন উপায় নেই যে তারা আসলে কর্মচারী না ক্রেতা। এই সমস্যা মনে হয় আর্চিস বা হলমার্ক জাতীয় দোকানে বেশী হয়। ঘটনাস্থল বসুন্ধরার আর্চিস এর দোকান। এক বন্ধুর জন্য গিফট কিনেছি, এখন আমার দরকার চমৎকার একটি বাক্স যাতে ভরে দেবো। যাওয়া মাত্র একটি তরুণ দৌড়ে এলো, “কি জাতীয় কার্ড খুঁজছেন আপু?” না তাকিয়েই বললাম, “না কার্ড চাই না, গিফট বক্স দেখবো”। না তাকানোটা বড় জাতীয় ভুল হলো।
“ওহ” তরুণ বিরস বদনে সরে গেলো। বন্ধু বান্ধবের কাছে শুনেছি এরা প্রেমের কার্ড চয়েস করে দিতে বড়ই ভালু পায়। তো একটা গিফট বক্স পছন্দ হওয়ার পরে দেখি হাত পাচ্ছি না (আমি আবার উচ্চতায় ধরনীর কাছাকাছি কিনা)। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম, দূরে একটা উড়াধূড়া ছেলে দাঁড়িয়ে। জিন্সে না হলেও ৭ জায়গায় ছেঁড়া। আর পাশেই লাল রঙ এর শার্ট আর কালো টাই পরে এক যুবক এক আপুর পিছে দাঁড়ানো, বিভিন্ন কার্ড তুলে তুলে দেখাচ্ছে।এর আগেও আমি সেলসম্যানদের এমন পোষাক পড়তে দেখেছি। তো তাকে গিয়ে বললাম,
“ভাই গিফট বক্সটা একটু নামিয়ে দিন তো”।
যুবক আমতা আমতা করতে লাগলো।
আমি তো ছাড়ার পাত্রী না। “দেখাতে হবে না, হাত পাচ্ছি না তো। শুধু নামিয়ে দিন”।
ছেলেটি মুখ কাঁচুমাচু করে এলো নামিয়ে দিতে। সাথে সাথে আপুর চিৎকার,
“তুমি নামাতে যাচ্ছ কেন? তুমি কি সেলসম্যান?”
ওরে খাইছে মোরে, এই ছেলে এই আপুর বয়ফ্রেন্ড! পরিস্থিতি ঠিক করতে গিয়ে আরো গুবলেট করে ফেললাম। ছাগলের মত বললাম,
“আপনি লাল শার্ট পড়েছেন কেন?”
এবার আপু তার বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ততক্ষনে উড়াধূড়া ছেলে চলে এসেছে। হাসতে হাসতে আমার বক্স নামিয়ে দিলো।
এই ঘটনা এই প্রথম না। আরো ঘটেছে। সবচেয়ে লজ্জায় পড়েছিলাম, যখন এক সিনিয়র ভাইয়ার সাথে এরকম বেয়াক্কেলে কথা বলেছি। গত বছরের রোজার মাস। হাসপাতালে ইভিনিং ডিউটি। এখন ইফতারি একা কি করে করা যায়? আরেক ওয়ার্ডে ইভিনিং ডিউটিতে আছে, সেরকম এক বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতালের সামনেই ভ্রাম্যমান ইফতারির দোকানে গিয়েছি কিনতে। আমার আবার জিলাপী দেখলেই মাথা নষ্ট। মহা মনোযোগে জিলাপী দেখতে দেখতে বললাম,
“মামা একটা জিলাপী দেন তো”।
মামা বললেন, “আপা একটাই দিব?”
আমি মাটির দিকে তাকায় দেখলাম ছেঁড়া স্পঞ্জ স্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। বনির দিকে তাকায় বললাম, “ঐ তুই নিবি না একটাই নিব?”
বনি দেখি হে হে করে বোকার হাসি দিচ্ছে।
“হু বুজছি, নিবি না। মামা দেন একটাই দেন। আর বুট দেন, আর পিঁয়াজু দেখতে এমন ক্যান?”
এবার বনির গলা শোনা গেলো, “রোজা রেখে ত্রিনিত্রির মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভাইয়া। হেহেহে, ফাজলামি করতেছে”।
এবার তাকিয়ে দেখি সাড়ে সর্বনাশ। আমি অর্থোপেডিক্স ডিপার্টমেন্টের এক ভাইয়া কে মামা ভেবে যা ইচ্ছা তাই অর্ডার দিয়ে যাচ্ছি। ওয়ার্ড থেকে নির্ঘাত কাঁটা ছেঁড়া করে এসেছেন, তাই স্পঞ্জ স্যান্ডেল। ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন, “জীবনে কেউ বলেনি চেহারা ভালো; তবে কেউ মামাও ভাবে নাই”।
লজ্জায় তিন দশে তিরিশ বার সরি বললাম আর বনির ঝাড়ি খেলাম।
এর পরের ঘটনা আরো করুণ। আমাদের পরীক্ষার মাঝে একটি পার্ট হচ্ছে OSPE। এর সাথে অনেকেই হয়ত পরিচিত, ১৫/২০ টি স্টেশন থাকে, প্রতিটিতে সময় থাকে ৩/৪ মিনিট। এর মাঝে সেখানে প্রশ্ন থাকে উত্তর দিতে হয়, রুগী থাকলে তাকে পরীক্ষা করতে হয়। এই পরীক্ষা আমাদের জন্য ত্রাস ছিলো। মাত্র ৩ মিনিটে যে সব কিছু মনে পড়বে, বা পড়লেও লিখে বা বলে আসতে পারবো তার গ্যারান্টি কই?
তো ঘটনাস্থল গাইনী পরীক্ষা হল। তখন আমরা মাত্র চতুর্থ বর্ষের স্টুডেন্ট। একটি স্টেশনে জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতির উপরে রুগীকে কাউন্সেলিং করাতে হবে – এই হচ্ছে প্রশ্ন। রুগী সেজে বসে আছে আমাদেরই এক ডাক্তার আপু। আর ম্যাডাম বসেছেন মার্কস দেয়ার পেপার নিয়ে। উল্লেখ্য একেবারে বসা থেকে শুরু করে রুগীকে আল্লায় হাফেয জানানো-সবেতে মার্ক আছে। আপনি যদি রুগীর সামনে বসে আপনার নিজের নাম বলতে ভুলে যান, তবে গেলো ১ মার্ক। তো ওই স্টেশনে তখন আমার এক বন্ধু, যে অতিরিক্ত টেনশন করে। আমি তার আগের স্টেশনে লেখা শেষ করে মনোযোগ দিয়ে তার পরীক্ষা দেয়া শুনছি, কারণ ঘন্টা পড়লেই আমাকে ওখানে দৌড় দিতে হবে।
আমার বন্ধু আপুকে ভালোই কাউন্সেলিং করলো জন্ম নিয়ন্ত্রণকরন পিল নিতে। সব পয়েন্ট টাচ করলো। সমস্যা হলো কনডম নিয়ে। কি এক কারণে সে সব ভুলে বসে রইলো। খেই হারিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। আমি তো “ইশ, উশ” করছি, এই সহজ জিনিস মনে করতে পারছে না যে কনডমের অপকারিতা কি! ফেউলুর রেট টা বলে দিলেই তো হয়। ম্যাডাম সাহায্য করার চেষ্টা করছেন, “বলো ছেলে, বলো, কেন কাজ করবে না?”
আমার বন্ধু আপুর দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ন গুরুত্বহীন একটা পয়েন্ট যেটা শুনলে স্যার ম্যাম্ রা রেগে যান, সেই পয়েন্টটি বলে বসলো,
“মা, কনডমের একটা বড় সমস্যা আছে। আপনি আপনার দাম্পত্যজীবনের সুখ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবেন না”।
বলেই চক্ষু বিস্ফোরিত করে বসে রইলো। আমি হাসি আটকাতে পারলাম না, আমার স্টেশনে বসে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলাম। আপুও হাসতেছে। ম্যাডাম বিরক্ত। ঘন্টা পড়লে এবার আমার পালা।
পিল আর কপার টি শেষ করে কনডমে যেতেই আমি হতভম্ব। ফেইলুর রেট কিছুতেই মনে পড়ছে না। কিভাবে সম্ভব? একটা অপকারিতাও মুখ দিয়ে বের করতে পারলাম না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। মুখ না খুললে ওই পয়েন্ট শূন্য পাবো। বাধ্য হয়ে শুরু করলাম,
“মা, এর একটা বড় ধরনের সমস্যা আছে……”
ম্যাডাম থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমিও কি আগের ছেলের পয়েন্ট বলতে চাও?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
“উঠো, কিছু বলা লাগবে না”। যেতে যেতে শুনলাম ম্যাডাম আর আপু খ্যাক খ্যাক করে হাসতেছে।
এর আগেও এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে। কাউন্সেলিং করে নেয়ার আগে জেনে নিতে হয় যে তার বাচ্চা কয়টি বা বিয়ে কতদিন হয়েছে। তো আগের দিন পরীক্ষা দিতে এসে আমার আরেক ক্লাসমেট প্রথম যে প্রশ্ন করলো তা এরকম,
“মা, আপনার কি বাচ্চা হয়?”
বোমা ফাটানো প্রশ্ন। তবে রুগী সেজে যে আপু বসে ছিলেন, সেই আপু ছিলেন ভীষন মজার। হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন,
“হবে না কেন? প্রায়ই হয়”।
এই জোক্স নিয়ে হাসাহাসি করেই পার করলাম মেডিকেলের পরবর্তী দুইটা বছর।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১১ দুপুর ২:৫৪