কিছু কিছু ফিল্ম আছে যেগুলো খুবই দারুণ, কিন্তু শুরুটা হয়তো ভীষণ বোরিং। প্রথম ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট হয়তো জোর করে ঝিমুতে ঝিমুতে দেখতে হয়, তারপরেই মূল ইন্টারেস্টটা শুরু হয়। কিন্তু স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন এমন একটা ফিল্ম যেটা একেবারে প্রথম দৃশ্য, প্রথম ডায়লগ থেকেই ইন্টারেস্টিং। এই মুভির মূল থীম হচ্ছে ইন্টারকানেকটিভিটি। মুভির মূল চরিত্র হ্যারল্ড ক্রীক নামের এক মাঝ বয়েসী একজন আইআরএস অডিটর। তার কাজকর্ম নিঁখুত সংখ্যা নিয়ে বলেই সম্ভবত সে অত্যন্ত গতানুগতিক, নিয়মানুবর্তী এবং সময়ানুবর্তী জীবন যাপন করে। তার এই নিয়ামুবর্তী জীবন যাপনের একটা উদাহরণ হল, গত ১২ বছর ধরে সে প্রতিদিন সকাল বেলা তার ৩২টি দাঁত ৭৬ বার করে ব্রাশ করে আসছে - ৩৮ বার আড়াআড়ি এবং ৩৮ বার উপর-নিচে। কিন্তু তার এই সাজানো গোছানো জীবন সম্পূর্ণ ওলট পালট হয়ে যায় এক সকালে, যখন সে শুনতে পায় কেউ একজন তার জীবন যাপন হুবহু বর্ণনা করে চলছে।
মুভির শুরুটাই হয় মূলত এই ন্যারেশনের মাধ্যমে। মুভির প্রথম ডায়লগটাই হচ্ছে, দিস ইজ এ স্টোরি অ্যাবাউট এ ম্যান নেইম্ড হ্যারল্ড ক্রীক অ্যান্ড হিজ রিস্টওয়াচ। এরপর বর্ণনাকারী হ্যারল্ডের জীবন যাপনের একটা বর্ণনা দিতে থাকে এবং আমরাও পর্দায় হ্যারল্ডকে বর্ণনা অনুযায়ীই জীবন যাপন করতে দেখতে থাকি। কিন্ত ঝামেলাটা বাঁধে যখন হ্যারল্ড দাঁত ব্রাশ করতে থাকে এবং বর্ণনাকারী মহিলাকন্ঠ সেই দাঁত ব্রাশের বর্ণনা দিতে থাকে, তখন হ্যারল্ডও প্রথমবারের মতো আমাদের সাথে সাথে সেই বর্ণনা শুনতে পায়। এরপর থেকেই শুরু, হ্যারল্ড যা যা করতে থাকে, মহিলা সবকিছুই অত্যন্ত শুদ্ধ উচ্চারণে সাহিত্যের মতো বর্ণনা করে যেতে থাকেন। হ্যারল্ডের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একে একে বিভিন মনোবিশ্লেষকের কাছে গিয়েও কোন সমাধান না পাওয়ায় সে শেষ পর্যন্ত একজন সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অধ্যাপক তার কাছ থেকে বর্ণনাকারীর শব্দচয়ন এবং ভাষার গাঁথুনি শুনে নিশ্চিত হয়, বর্ণনাকারী কোন সাধারণ মানুষ নয়, কোন এক সাহিত্যিক। প্রতিটি মানুষের জীবনের কাহিনী একেকটা গল্প হলেও এই সিনেমার মূল চরিত্র হ্যারল্ডের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা। হ্যারল্ডের ক্ষেত্রে একটা গল্পই হচ্ছে তার জীবন। পৃথিবীর কোন এক প্রান্ততে হয়তো একজন লেখিকা একটা উপন্যাস লিখে চলছেন, আর হ্যারল্ড তার প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিদিনের নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে সেই উপন্যাসেরই বাস্তবায়ন করে চলছে। উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে জীবন যাপন করা হয়তো খুব একটা খারাপ অভিজ্ঞতা না, যদি না উপন্যাসটা ট্র্যাজেডি হয়। হ্যারল্ডের এই উপন্যাসটা কি কমেডি, নাকি ট্র্যাজেডি? জানার জন্য শুরু হয় হ্যারল্ডের অনুসন্ধান। মুভির শেষ দিকে সুন্দর চমক আছে। জানতে হলে আপনাকে কষ্ট করে দেখে ফেলতে হবে মুভিটা।
ইন্টারকানেকটিভি নিয়ে তৈরি ভিন্ন স্বাদের চমত্কার এই মুভিটি দেখার পর আপনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে এর "স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন" নামটা খুবই সার্থক হয়েছে। নামটি মূলত নেওয়া হয়েছে মার্ক টোয়েনের বিখ্যাত একটা উক্তি থেকে। উক্তিটি হচ্ছে: "Truth is stranger than fiction, but it is because Fiction is obliged to stick to possibilities; Truth isn't." ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই মুভিতে হ্যারল্ড ক্রীক চরিত্রে অভিনয় করেন উইল ফ্যারেল। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে আছেন ডাস্টিন হফম্যান, এমা থম্পসন, ম্যাগি জাইলেনহল। অভিনয়ের পুরোটা সময় উইল ফ্যারেল কানে একটা ইয়ারপিস পরে থাকতেন, যেন শুধুমাত্র তিনিই ন্যারেটরের বর্ণনা শুনে সেই অনুযায়ী এক্সপ্রেশন দিতে পারেন এবং সেই বর্ণনা যেন অন্য অভিনেতার স্বাভাবিক অভিনয়ে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে।
এই মুভির কাহিনীকার জ্যাক হেল্মের সম্ভবত বিজ্ঞানী এবং ম্যাথমেটিশিয়ানদের নিয়ে এক ধরনের অবসেশন আছে। কারণ সিনেমার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং জায়গার নাম রাখা হয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং ম্যাথমেটিশিয়ানের নাম অবলম্বনে। যেমন হ্যারল্ড ক্রীক নামটা রাখা হয়েছে ফ্রান্সিস ক্রীকের নাম অবলম্বনে, যিনি ডিএনএর স্ট্রাকচারের আবিষ্কারক। হ্যারল্ড ক্রীকের গার্লফ্রেন্ড অ্যানা প্যাসকেলের নামটি এসেছে গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকেলের নাম থেকে। লেখিকা ক্যারেন আইফেল এসেছে প্রকৌশলী এবং আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনার গুস্তাভ আইফেলের নাম থেকে। অধ্যাপক জুলস হিলবার্টের নাম এসেছে জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের না অনুসারে। এখানেই শেষ না, মুভিতে লেখিকাকে খুঁজে বের করার জন্য অধ্যাপক জুলস হিলবার্ট ২৩টি প্রশ্ন সম্বলিত একটি কোয়েশ্চেনীয়ার তৈরি করেন। আর বাস্তবে গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট ১৯০০ সালে আন্তর্জাতিক গণিতবিদ সম্মেলনে তার উপস্থাপন করা ২৩টি গাণিতিক সমস্যার জন্য চিরস্মরণীয় হয়েছেন, যেই ২৩টি সমস্যা সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, পৃথিবী আগামী ১০০ বছর এই ২৩টি সমস্যার সমাধান করতে ব্যাস্ত থাকবে।
ভিন্ন স্বাদের বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনী নিয়ে তৈরি এই মুভিটি আমার খুবই প্রিয় একটি মুভি। এর IMDB রেটিং 7.7। রটেন টমাটোজের রিভিউ অনুযায়ী এটি 73% ফ্রেশ। সমালোচকরা এই মুভির বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীর এবং এতে উইল ফ্যারেলের অভিনয়ের বেশ প্রশংসা করেছেন। উইল ফ্যারেল এই মুভিতে অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন পেয়েছিলেন। সেই সাথে মুভিটাও বেস্ট কমেডি/মিউজিকাল মুভি ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেয়েছিল।