***********************
'পাঠাও' ব্যবহারকারীদের অসম্মান করছি, ভুলেও ভাববেন না। এটা হলো ট্রু কলার নামের অসাধারণ রসবোধসম্পন্ন অ্যাপের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। অথবা লেখাটার নাম হতে পারে...।
থাক, সেই সিদ্ধান্তের আগে একটা কৌতুক বলে নি। কৌতুকটা বেশ পুরোনো, আমিই বলেছি। কিন্তু ওই যে বলে, ভালো জিনিস বারবার ভালো।
দুই বোন - হাসি আর খুশি। হাসি বড়, খুশি ছোট। খুশি বেড়াতে এসেছে বড়বোনের বাসায়। দুলাভাই অফিসে, ফিরতে বেশ রাত হয়।
তো দুই বোন গল্প করতে করতে বেডরুমেই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ প্রায় দুটার সময় দুলাভাই বাসায় ফিরেছে। এরপর বিছানায় শুয়ে অভ্যাসমত জড়িয়ে ধরেছে স্ত্রীকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ (না-কি সৌভাগ্যবশতঃ?) সেটা ছিলো শ্যালিকা। চমকাবেন না। দু বোন উল্টোদিকে মাথা দিয়ে শোয়ায় বেচারা দুলাভাইয়ের ডান-বাম গুলিয়ে গিয়েছিল।
তো আবেগঘন আলিঙ্গনে চমকে জেগে খুশি ফিস ফিস করে বললো: দুলাভাই, আমি খুশি। খুশি।
এবার দুলাভাইও একইভাবে চাপা স্বস্তিমেশানো স্বরে জবাব দিলো: আরে, আমিও তো খুবই খুশি। ভাবতেছিলাম রাজিই হবা কি-না। যাক...!
কৌতুক এইখানেই শেষ। পরের দৃশ্য কল্পনায় যাদের মন উচাটন হয়েছে, তাঁদের ছেড়ে দেই। আর যারা ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, 'এই রে, গাধাটা আবার এসেছে রে বস্তাপচা প্যাচাল পেড়ে জ্বালাতে', তাদের কাছে জানতে চাই, হাসিখুশির মতো নাম বিভ্রাট হয়েছে কখনও?
আমার হয়েছে। অনেক, অনেকবার। আমার নিজের নাম নিয়েই।
ডাক নামসহ বললে আমার নাম তওহিদ মাহমুদ হোসেন সাজু। এই নামের ইংরেজি বানান হচ্ছে Tauheed Mahmud Hussain Shaju. বাংলায় এর বানান্সহ উচ্চারণ হওয়া উচিৎ তাওহীদ (তওহিদ নয়) মাহমুদ হুসাইন (হোসেন নয়)। মুখে বললে লোকে না বাংলায়, না ইংরেজিতে আমার নাম লিখতে পারে। নাম বললে লোকে তিনবার অ্যাঁ...অ্যাঁ...অ্যাঁ... করে রিপিট করতে বলে। লেখ্যরূপে আমার নামের যে বানানগুলো সাধারণ্যে প্রচলিত তা হলো:
তাওহীদ, তহিদ, তৌহিদ, তোহিদ, তেহিদ, তাহিদ, তৈহিদ, তুহিদ, তাউহিদ, এবং ওয়াহিদ। শেষোক্ত নামটি কাকতালীয়ভাবে আমার ড্রাইভারের নামের সাথে মিলে যায়। আমি আপত্তি করি না। এদিক থেকে আমি দুর্দান্ত প্রোলেতারিয়েত।
প্রথম প্রথম গভীর অধ্যবসায় দিয়ে শ্রোতাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম নামের বানান; বাংলাটাই। লোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আমার নামের বানান শুনবে। তুমি কে হে হরিদাস পাল? সুতরাং এরপর হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে জড়িয়ে-মড়িয়ে উচ্চারন করে বলি, 'যা ইচ্ছা লিখে নেন ভাই। আই ডোন্ট মাইন্ড। ইচ্ছে হলে কালাম লেখেন। বিদেশে বলি ওকে।' 'ওকে' শব্দটি দুনিয়ার যে কোন ভাষাভাষী বোঝেন এবং শুদ্ধ উচ্চারণ করেন।
অনেকে আবার ভালবেসে নামের আগে 'মোহাম্মদ' জুড়ে দেন। কেউ কেউ মাহমুদকে শুদ্ধ করে মোহাম্মাদ করে দেন নিজেই। তৌহিদ মোহাম্মদ বা মোহাম্মদ তাওহিদ। আমি আদরের দান গ্রহন করি নির্বিবাদে।
তবে চরম হয়েছিল একবার বাসের টিকেট কিনতে যেয়ে। দু হাজার ছয় কি সাতের ঘটনা। যাব খুলনা। নিভার পোস্টিং তখন ওখানে। গাবতলীতে কাউন্টারে প্রচন্ড ভীড় সেদিন। আমি আর গাড়লের মত আমার পুরো নাম বললাম না। ভাবলাম, এবার ডাকনাম দিয়ে চট করে সারি।
টিকিট লাগবে একটা। ড্রাইভারের পিছেরটা।
কই যাইবেন?
খুলনা।
নাম কন।
সাজু।
কী? কী নাম কইলেন?
সাজু...সাজু...। সা...জু...।
ও...বুজছি।
উনি খসখস করে টিকেটে লিখলেন - "সাধু খাঁ"। গন্তব্য খুলনা। আমি সাধু খাঁ হয়ে খুলনো চলে গেলুম।
আগেই বলেছি, ট্রু কলালের রসবোধ অনন্যসাধারণ। প্রতিদিন আমার একটা 'আমিও খুশি' টাইপ সময় আসে - সকাল নটার দিকে, যখন পাঠাও বা উবার ড্রাইভার আমাকে কল করেন। এ পর্যন্ত দুর্দান্ত যে নামগুলো স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে সেগুলোর কয়েকটা বলি।
অনন্ত জলিল, মানিক ম্যাগনিটো, বাস্টা/র্ড পাঠাও ড্রাইভার, নাছির ভাই ছেলের, বাইঞ্চো/ত পাঠাও ড্রাইভার, সত্যের সন্ধানে নির্ভিক রনি, কু/ত্তার বাচ্চা, উবার বাট/পার ড্রাইভার, কূতায় যাবেন (জ্বি, দীর্ঘ ঊ-কার), পড়শি বুইড়া খাটাশের বাড়ি, মায়াভতী মায়া, অ্যান্টিবায়োটিক সাবের, সানি সি বার্ড, শুষ্ক মেঘ, রমণ কিং (হেহ হেহ), অবুঝ বালিকা এবং সত্যি সত্যিই, ছ্যাঁচড়া বোকা**দা পাঠাও রাইডার।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের যাত্রীরা একটি বিশেষ দলের ব্যাপারে অত্যন্ত জাজমেন্টাল (!)।
নামে কিবা আসে যায়?
যায়, অনেক কিছুই যায়। সেদিন এক সহলেখিকা আফসোস করছিলেন তাঁর নামবিভ্রাট নিয়ে। এই লেখাটা ওঁর চোখে পড়লে আশাকরি দুঃখ কিছুটা প্রশমিত হবে। হয়তো আনন্দে শুকরিয়াও জানাতে পারেন এই ভেবে, 'ভাগ্যিস, ট্রু কলারে নাম ওঠেনি।'
একটা ঘটনা বলি। এটাও আমার ছেলেবেলার, নাহ, ছেলেবেলা না, কিশোরবেলার গল্প। ৯৪'র কথা। এসএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ চলছে।
আমরা ছিলাম কম্পিউটারে চেক করা হতো যে স্টুডেন্ট ফর্ম - খুব সম্ভবত OMR না কি একটা নাম ছিলো, সেটার প্রথম ব্যাচ। একেকটা বক্সে একেকটা অক্ষর লিখতে হতো ইংরেজিতে ক্যাপিটাল লেটারে। হেডস্যার পই পই করে বলে গেছেন, 'খবরদার! ভুল যেন না হয়। পার হেড ফর্ম একটাই।' ভুল হলেই জান কবজ করার জন্য রুমের মধ্যে স্যার-রূপী আজরাইল দন্ডায়মান।
আমার নাম ২০ অক্ষরের, মাঝে দুটো খালিঘর। গুলিটা কানের পাশ দিয়ে গেল। এঁটে গেলো কোনোমতে। সমস্যা বাধল আমার বন্ধুকে নিয়ে। তার পুরো নাম ছিলো: আবুল ফজল মোহাম্মাদ মাসুদুর রহমান ইমন।
মাশাল্লাহ!
মনের মাধুরী মিশিয়ে রাখা নাম। OMR ভেবে তো আর রাখা হয়নি। সুতরাং যা হবার, তাই-ই হলো। 'মাসুদুর' পর্যন্ত আসতে আসতেই বন্ধুবর দেখে কলম চলে গেছে ফর্মের বাইরে। নাম অর্ধেক লেখা, কিন্তু বরাদ্দের ফর্ম তো খতম!
এরপর আর কী। আজরাইল এগিয়ে এসে 'কর্ণধারণ পূর্বক বেত্রাঘাতে মগ্ন হইলেন'। দোস্তো আমার পরীক্ষা দেবে কি, জীবন রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেল। এসএসসি বহুৎ আসবে জীবনে, যদি বেঁচে থাকে।
মাঝে মাঝে পূর্বাচলে হাওয়া খেতে যাই। তো, একবার একটা হোটেলের সাইনবোর্ড পড়তে গিয়ে গাড়ি প্রায় নালায় ফেলে দিচ্ছিলাম। হোটেল সাধারণই। কিন্তু নাম? একদম থ্রিলার গল্পের প্লট।
সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: জামাই বউ মোঃ মুছা মীর মামা হে।
যেহেতু ব্রেইনের গতি আলোর গতির থেকেও বেশি, ওই কয়েক সেকেন্ডে সে কয়েকটা প্রশ্ন অটোম্যাটিক খাড়া করে ফেলল।
জামাই, বউ কি পার্টনার?
কে, কার জামাই?
মোঃ মুছা জামাই, নাকি মামা?
জামাই হলে বউ কে?
মীর মামা কি মামা, নাকি মামাশ্বশুর?
দাঁড়াও হে পথিকবর - মাইকেল বলেছিলেন। এখানে 'হে' বলে কাকে সম্বোধন করা হচ্ছে?
আমার ব্রেইন ক্লগড হয়ে গেল এবং গাড়ি প্রায় ভিড়িয়ে দিচ্ছিলাম আর কি।
কাজেই নামের মাহাত্ম অসীম। সম্ভবত আমার নামেরও। নইলে ফেসবুকে কেন যোগ দেওয়ার আহবান আসবে 'বিড়িখোর কল্যাণ সমিতি' থেকে?
খাবারের নাম নানা দেশে নানারকম। কিন্তু খোদ বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে স্বচক্ষে যে লাঞ্চ মেনু দেখেছিলাম, তাতে ছিল দুটো পরাবাস্তব খাদ্য।
১। চিংড়িসহ ময়লার ঝুঁড়ি (Garbage Can with Shrimp)
২। নাপিতভাজা (The Barber Fry)
অদ্যবদি এই খাবারের রহস্য ভেদ করতে পারিনি। ছবি তুলে রেখেছি। ঠিক করেছি আমার উইলে এই দুটো লিখে যাব ছেলেদের জন্য। রহস্য যে ভেদ করতে পারবে, সম্পত্তি (যদি কিছু থাকে) তার।
আর হে পাঠক, যদি আপনিই হন সে রহস্যভেদী, তো জানান। আপনাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ।
(ছবিটা বনানী আড়ং এর পাশের একটা দোকানে তোলা। পাঞ্জাবি পরিহিত ম্যানিকুইনটার পা/ছায় কেন ফ্যানের বাতাস দেওয়া হচ্ছে, সেটা দোকানে উপস্থিত কর্মচারীটি আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৪৩