সহ ব্লগার কায়েস মাহমুদের সাথে একটি পোস্টে কমেন্ট আদান প্রদান করবার সময়ে এই বিষয়ে পক্ষ্যে বিপক্ষ্যে লেখার জন্য রাজি হয়েছিলাম। অনেকদিন হলো তিনি সম্ভবত সময় করে উঠতে পারেননি। তাই ভাবলাম আমিই শুরু করি।
তবে একটা জিনিষ বলে রাখা ভালো যে, ভারত বা ভারতীয় নাগরিক এদের প্রতি আমার ব্যাক্তিগত কোন বিরুপতা নেই। বরং উল্টো। ভারতীয় জনগণের দেশপ্রেম আমার কাছে মনে হয় বিশ্বসেরা। দেশে মন্দ যাই ঘটুক না কেন, সেটা তারা কোনদিন বহিঃ বিশ্বে ফলাও করে বলে বেড়ান না। বিদ্যার্জনকে তারা ধর্ম জ্ঞান করে, নিষ্ঠার সাথে চর্চা করেন। ফলে সেখান থেকে উঠে আসছে অগুণিত গবেষক, বিজ্ঞানি, প্রকৌশলি এবং চিকিৎসক। ভারতীয়দের ব্যাক্তিগত ভোগ বিলাসের প্রতি কৃচ্ছতা সাধনের ফলেই আজ জি ২০ এর মত একটি জোটে সদস্য তারা। ব্যাক্তিগত পর্যায়ে আলাপচারিতায় আমাদের প্রতি ভারতের সব নাগরিককেই দেখেছি, বন্ধু বৎসল, যা অন্য কোন দেশের নাগরিকের কাছ থেকে অন্তত আমি পাইনি। এ রকম অনেক গুনাবলিতে প্রশংসা ধন্য হতে পারে ভারত এবং ভারত বাসি। যদি ভারতীয় অন্তত তিনটা গুণ ( দেশপ্রেম, শিক্ষায় নিষ্ঠা, কৃচ্ছতাসাধন) আমাদের থাকতো, তবে বাংলাদেশের চেহারা অন্য রকম হতো।
আমাকে পীড়িত করে সেটা হলো, আমার দেশের প্রতি তাদের রাস্ট্রীয় নীতি। যা প্রকারন্তে আগ্রাসনেরই সামিল। আর আমি নিশ্চিত যে, কোন দেশপ্রেমিকই এ ধরণের মনভাবকে সমর্থন করবেন না।
কিন্ত যে ভারত আমাদের স্বাধীনতার সময় কোটি লোককে আশ্রয় দিলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য দিয়ে আমাদের স্বাধীন হতে সাহায্য করলো, তারা কেন আমাদের উপর আগ্রাসি দৃস্টি দিলো?
ভারতের পররাস্ট্র নীতিতে সাধারণ মানুষের দৃস্টিভঙ্গির প্রকাশ নেই। যেটা আছে সেটা সেই ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের প্রতি তাদের উষ্মা। তৎকালিন ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে জহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভ ভাই পাতিল, এরা কোনদিনও চাননি যে, ভারত ভাগ হোক। বিবিসি প্রচারিত লাস্ট ডেইস অফ দা রাজ প্রমাণ্য চিত্রে এর সুস্পস্ট প্রমান আছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান গঠনকে নেহেরু একটি অবাস্তব ও অদ্ভুত রাস্ট্র বলেও উক্তি করেছিলেন।
"লাস্ট ডেইস অফ দা রাজ" লিঙ্ক
Click This Link
তাছাড়া নেহেরুর "ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম" বইটাতে অখন্ড ভারতের একটি গোপন ইচ্ছার কথা আছে। ইন্ডিয়া ডকট্রিন কিংবা নেহেরু ডকট্রিন নামে যে বৈদেশিক নীতির কথা সুচনা করা হয়েছিল, অকংগ্রেসীয় সরকারগুলিও সেটি থেকে বিচ্যুত হননি। হতে পারে সেটি জাতিয় নেত্রিবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে অথবা ভারতের স্বার্থের কথা ভেবে। আর ভারতের চরম মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির মাদারশিপ বলে খ্যাত আর এস এস এর বক্তব্য আরো আতংক সৃস্টিকারি, যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, সমগ্র ভারতবর্ষে অবস্থান এবং শাসন করার একমাত্র অধিকার শুধু মাত্র হিন্দুদের। সেখানে রাম রাজ্য স্থাপন করে তারা চান রামায়ণকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
ভারতের শাসন ক্ষমতায় হিন্দিভাষি উত্তর ভারতীয়দেরই প্রভাব। কোন অজ্ঞাত কারণে এদের বাঙ্গালি বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। এ পর্যন্ত কোন বাঙ্গালি ক্ষমতার শীর্ষ পদে আসীন হতে পারেননি, ব্যাতিক্রম শুধু প্রণব বাবু। আর হিন্দিতে দক্ষতার অভাবই যে প্রধানমন্ত্রিত্ব পদে তার আরোহন অসম্ভব, সেটি তিনি গোপন করেননি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোলকাতার সবচেয়ে শক্তিশালি ভুমিকা থাকলেও, জাতিয় পর্যায়ে বাঙ্গালিদের মুল্যায়ন করা হয় না বললেই চলে। উল্টো হিন্দির আগ্রাসন চালিয়ে খোদ কোলকাতাকে প্রায় হিন্দি অধ্যুসিত বানানো হয়ে গেছে।
যেহেতু বাঙ্গালি অধ্যুসিত বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাস্ট্র, বোধ করি দুই ধারি ভারতীয় বিরুপতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। প্রথমত অখন্ড ভারত গঠনের প্রতি অন্তরায়, দ্বিতীয়ত বাঙ্গালিত্ব।
এজন্য দেখা যায় যে, যুদ্ধবিধবস্ত বাংলাদেশ যখন রিলিফবাহি জাহাজ ভেড়ার কাজে মাত্র ছয়দিনের জন্য কোলকাতা বন্দর ব্যাবহারের অনুমতি চায়, তখন অজ্ঞাত্ কারণে সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করে ভারত। উপরন্ত মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ থেকে লুট করে নিয়ে যায় মুল্যবান সামরিক এবং শিল্প যন্ত্রাংস। বিদেশি গাড়ি, ব্যাংকে রক্ষিত সোনা, তামার ৫ পয়সা ইত্যাদিও বাদ রাখেনি। সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়ে রিলিফ প্রাপ্ত চাল গম তেল নুন, মায় কম্বল্টুকুও ওপারে পাচারে উৎসাহ যোগায় ভারত। এই লুট পাটের তীব্র প্রতিবাদ করার ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল কারাবন্দি হন। তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যাকে ভারত বিরোধিতার কারণে কোন খেতাব দেয়া হয়নি। আর এই লুট পাটের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বীতশৃদ্ধ। অনেক খেদেই তিনি বলেছিলেন, "মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পাইছি চোরের খনি।"
ভারত শাসনের সময় বৃটিশদের একটি কুটবুদ্ধিচালিত নীতির নাম ছিল অধীনতামুলক মিত্রতা। মানে নামে মাত্র স্বাধীনতা। বৃটিশরা প্রস্থান করলেও, ওই একই নীতি স্থাপিত হয়েছিল ভারতের পররাস্ট্র নীতিতেও। ফলে স্বাধীনতার পর মুজিব ইন্দিরা চুক্তি নামে খ্যাত ২৫ বছরের অধীনতামুলক মিত্রতা চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুসারে ভারতের কাছে বেরুবাড়ি হস্তান্তর করলেও, চুক্তি অনুসারে আমরা আঙ্গুরপোতা দহগ্রাম আজ পর্যন্ত পাইনি। এ ছাড়াও মিত্রতার অজুহাতে মাত্র ৪০ দিনের অনুমতি নিয়ে ভারত যে ফারাক্কা বাধ চালু করেছিল, আজ পর্যন্ত তার কুফল ভোগ করছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে যতটুকু দেখেছি, তাতে তাকে ধর্মানুরাগি বলেই জেনেছি। তাই পরাজিত পাকিস্তানিরা মুসলিম বিশ্বে যখন আমাদের নামে মুসলমান বিদ্বেষি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু সেই অপবাদের জবাব দিতেই লাহোরের ও আই সি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের নিষেধকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধুর এই যাত্রাকে ইন্দিরা গান্ধি ভালো ভাবে নেয়নি। মিত্রতার কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা "র" এর সারা বাংলাদেশ ব্যাপি উপস্থিতি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে ৭৫এর ঘটনাবলির আগাম সংকেত দেয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুকে। ( জে এন দীক্ষতঃ লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ড)।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের মানুষ, পিন্ডির পরিবর্তে দিল্লির এই খবরদারি ভালো ভাবে গ্রহন করেনি। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ধবসের অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ ছিল। জিয়া ক্ষমতায় আসার পর, ভারত অনেকটা প্রকাশ্যেই বিরুপ আচরন শুরু করে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, নৌবাহিনী পাঠিয়ে দঃ তালপট্টি দখল। এছাড়াও ইন্দিরার সরাসরি নির্দেশে জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করে ভারত। জে এন দীক্ষতঃ লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ড)। যা রাস্ট্রিয় সন্ত্রাসবাদের সামিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের একটি আচরণকেও বন্ধুসুলভ বলা যায় না। ফারাক্কার পর, ২৫ টি অভিন্ন নদীর উৎসে এক তরফা বাধ তৈরি, সীমান্তে কাটাতারের বেড়া দিয়ে আমাদেরকে বৈরি বলে ঘোষনা, বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে অনিহা, সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, মিডিয়ায় অহরহ বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাস্ট্র বলে অপপ্রচার, বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসিদের রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদি শান্তিবাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা, বাংলাদেশি পণ্য ও টি ভি চ্যানেল্গুলিকে ভারতে প্রবেশে বাধা, সিডর পরবর্তিতে চাল নিয়ে চালিয়াতি, সীমান্তে শত শত কারখানা বসিয়ে ফেন্সিডিল উৎপাদন এবং বাংলাদেশে চোরাচালান করে দেয়া, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসি বাংলাদেশিদের নামে অপপ্রচার চালিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার থেকে বাংলাদেশকে বিতারণের চেস্টা, ইত্যাদি অনেক উদাহারণ দিয়ে প্রমান করা যায়, কেন বাংলাদেশিরা ভারত বিরোধী।
অখন্ড ভারত গঠনে যা যা করার তাই করবে ভারত সরকার এটি স্পস্ট। অন্তত সাময়িক অধীনতামুলক মিত্রতা করতেও তাদের আপত্তি নেই। এই ধরণের মিত্রতার বাধনে ভূটান ও নেপাল বাধা পড়েছে। শ্রীলংকা এ ধরণের মিত্রতায় অনিহা প্রকাশ করলে, তালিম বিচ্ছিন্নবাদিদের উস্কে দিয়ে শ্রীলংকায় রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলার সৃস্টি করে রেখেছে ভারত। আর এই সব কারণেই প্রতিবেশি একটি রাস্ট্রের সাথেও ভারতে সুসম্পর্ক নেই।
স্বাধীনতার সময়েই বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক এবং লেখক এবং রাজনৈতিক সমাজে একদল ভারত প্রেমিক বুদ্ধিজীবি তৈরি করে রেখেছে। যারা শুরু থেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং মিডিয়া জগতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। ফলে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা নিয়েও ওই স্তরে কথা বার্তা হয় সামান্য। তাদের ক্রমাগর ভারত তোষনকারি প্রচারের ফলে, আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য শক্ত জনভিত্তি গড়ে উঠতে পারেনি। এরা সুকৌশলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনভাবকে সেই স্বাধীনতার সময়েই আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে আগাগোড়া বিদ্বেষি মনভাব থাকলেও, বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং প্রভাবশালি মহলের কাছে ভারত একটি মিত্রদেশ হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। যা একসময় আমাদেরকে সিকিমের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য করবে।