দিনকয়েক আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর’ যাচাই ছাড়া প্রকাশ করে সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন বলে স্বীকারোক্তি করেছিলেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। পরের ঘটনা কমবেশি আমরা সবাই জানি। মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়। দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭৮টির মতো মামলা দায়ের করা হয়। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মাহফুজ আনাম বলেছিলেন "ওই খবরগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই না করে ছাপানোর ফলে আমি যথাযথ সম্পাদকীয় বিবেচনাবোধের পরিচয় দিতে পারি নি - আমার এই আত্ম-উপলব্ধিমূলক মন্তব্য থেকে সাংবাদিকতার একটা বিরাট দুর্বল জায়গা উন্মোচিত হয়েছে। .. এখনো তো আমরা রেবের ক্রসফায়ারে মৃত্যুর খবর ওরা যেভাবে দেয় - সেভাবেই ছেপে যাচ্ছি। এটা তো একটা বিরাট ইস্যু - যা গভীরভাবে দেখা দরকার।" ক্ষমতাসীন দল তার কথা অবশ্য গভীরভাবে দেখা তো দুরের কথা হালকাভাবে কানেও তোলেনি। ফলে মাহফুজ আনাম এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে জামিন নিয়ে বেড়াচ্ছেন।
“বনশ্রীতে দুই ভাইবোনের চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড তাদের মা নিজেই ঘটিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন!” গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশেষ পুলিশ বাহিনী রেব সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবী করেছে। আমাদের মিডিয়াও মহোৎসাহে রেবের বক্তব্য প্রচার করেছে। এবার অবশ্য এ দাবী নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন "মামলা হওয়ার আগেই তার সম্পর্কে বলে দেয়া হলো যে তিনি হত্যাকারী। এটা তো কোনভাবেই আইনসঙ্গত না"। গণমাধ্যম বিশ্লেষক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর এ বিষয়ে বলেন "এ ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়া শুধু রেবের বক্তব্যই প্রকাশ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য পক্ষের কোনো ভাষ্য প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।" আরো অনেকেই এখন বলছেন যে, মিডিয়ার এই সৎসাহস ও দায়িত্বশীলতা থাকা উচিত যে কোনো একপক্ষীয় বক্তব্য তারা প্রচার করবে না, যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তার বক্তব্যও থাকতে হবে। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালের মতে রেবের এই মিডিয়া ট্রায়াল বিচারব্যবস্থার ওপর কালো ছায়া ফেলছে। কারণ আদালত ছাড়া কেউই কাউকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করতে পারে না।
সুলতানা কামালের কথা শুনে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার কথা মনে পড়ে গেলো। সম্প্রতি তিনি আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে রাজধানীর বাড়ির মালিক, ভাড়াটেসহ নগরবাসীর সব তথ্য থানায় জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, কোনো বাড়িওয়ালা যদি ভাড়াটিয়াদের তথ্য জমা না দেন এবং এ সময়ের মধ্যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে বাড়িওয়ালাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। ডিএমপি কমিশনার তার এই নির্দেশের স্বপক্ষে ফৌ:কা:বি: ৪২ ধারার ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন- এই ধারার আওতায় জনগণ পুলিশকে সাহায্য করতে বাধ্য। পাঠক লক্ষ্য করুন, সুলতানা কামালের মতের বিপরীতে ডিএমপি কমিশনারের মতে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষমতা তিনি বা তার পুলিশের রয়েছে। তাছাড়া, যে ধারার কথা তিনি বলেছেন সেটা সঠিক হলে ধরে নিতে হয় রাজধানীর সব বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াই অতীতে ফৌজদারী অপরাধে জড়িত ছিলো নইলে অদূর ভবিষ্যতে ফৌজদারী অপরাধে জড়িত হবে। যাহোক, তার দাবী কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা আদালতেই নিষ্পত্তি হবে।
তবে, সুখের বিষয় হলো শাহদীন মালিক এবং অন্য কয়েকজন এবার যেমন রেবের স্বীকারোক্তি প্রচার সম্মেলনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তেমনি ঢাকা নগরবাসীর তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া নামের এক আইনজীবী। অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন এই জ্যোতির্ময় বড়ুয়াই রাঙ্গুনিয়ার কিশোর তাসফিক উদ্দিনকে পুলিশি নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন। ‘নিজের বোনকে ধর্ষণ করেছি’এরকম একটা স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য পুলিশ ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল রাঙ্গুনিয়ার কিশোর তাসফিক উদ্দিনের ওপর। বিষয়টি গণমাধ্যমে জানাজানি হওয়ার পর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ধর্ষককে বাঁচাতেই কিশোর তাসফিককে ফাঁসানো হয়। এরপর সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের কপি যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আদালতে রিট আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রকৃত অভিযুক্তকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।
কোনো সন্দেহ নেই কিশোর তাসফিকের ঘটনায় মিডিয়া যে ভূমিকা নিয়েছিল সেটাই হলো মিডিয়ার কাঙ্খিত ভূমিকা। পুলিশ-রেবের স্বীকারোক্তি প্রচারমূলক সংবাদ সম্মেলনে যোগদান করে নয়, বরং মাহফুজ আনামের দেখানো আত্মশুদ্ধির পথেই সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে মিডিয়া নিজেকে সত্যের পক্ষে জনগনের পাশে দাঁড় করাতে পারে। অন্যদিকে, মুখে কুলুপ এটে নিষ্ক্রিয় বসে থাকা নয়, শাহদীন মালিক, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, সুলতানা কামাল, জ্যোতির্ময় বড়ুয়ারা যে সরব সক্রিয় অবস্থান নিয়েছেন সেটিই হচ্ছে দেশের সকল সচেতন নাগরিকের কাঙ্খিত অবস্থান।
বর্তমান মামলাবাজ ক্ষমতাসীন দল বা স্বীকারোক্তিবাজ রেব-পুলিশের কাছে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আকাঙ্খা করা যে অরণ্যে রোদন মাত্র সেটা অবশ্য আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ ভোর ৪:০৭