আসসালামুআ’লাইকুম। পবিত্র ঈদুল আযহা আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ এই ধর্মীয় উৎসবটি। ঐদিনে ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রিয় পশু কোরবানি দিবেন। মাংস খাওয়া অথবা জাগতিক অন্য কোন কারন নয়, বরঞ্চ তাকওয়া অর্জনই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য।
এক ব্লগার বন্ধুর অনুরোধে, আজ কোরবানির সকল জরুরী বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে বসলাম। আমরা যেন সহিহ-শুদ্ধভাবে আমাদের কোরবানির যাবতীয় কার্যাবলী সমাপ্ত করতে পারি, এটাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। এখানে যা যা বলা হবে, তার সবকিছুই হয়তো সবার আগে থেকেই জানা। তবে যদি একজন মানুষকেও এই লেখার মাধ্যমে উপকৃত করা যায়, তাহলেই এই পরিশ্রম সার্থক বলে ধরে নেব।
### জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখ, ঈদের নামাযের পর থেকে ঐ মাসের বার তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কোরবানি করা যায়।
তবে প্রথমদিন কোরবানি করাই উত্তম।
### জিলহজ্ব মাসের নয় তারিখ ফজরের নামাযের পর থেকে তের তারিখ আছরের নামায পর্যন্ত, প্রত্যেক ফরজ নামাযের সালাম ফিরানোর পর “তাকবীরে তাশরিক” পাঠ করা নরনারী উভয়ের জন্য ওয়াজিব।
পশু :
• একটি উট, একটি গরু কিংবা একটি মহিষ দিয়ে সর্বনিম্ন একজন থেকে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত কোরবানি দেয়া যায়।
• একটি ছাগল, একটি ভেড়া কিংবা একটি দুম্বা দিয়ে শুধুমাত্র একজন কোরবানি দেয়া যায়।
• কোরবানির পশুর বয়স, উট হলে পাঁচ বছর, গরু মহিষের জন্য দুই বছর এবং ছাগল ভেড়া দুম্বার জন্য এক বছর হতে হবে।
• কোরবানির পশু অন্ধ বা খোঁড়া হলে, তা দিয়ে কোরবানি দেয়া জায়েজ নয়।
• শিঙ ভাঙ্গা থাকলে কোরবানি জায়েজ নয়, তবে জন্ম থেকে শিঙ না গজালে তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে।
• জন্ম থেকে পশুর কান না থাকলে কোরবানি জায়েজ নয়, তবে কান ক্ষুদ্র হলে কোন সমস্যা নেই।
• কোরবানির পশুর দাঁত সম্পূর্ণ পরে গেলে তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নয়, তবে অর্ধেকের বেশি দাঁত অবশিষ্ট থাকলে তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে।
• সন্তানসম্ভবা পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না।
লক্ষণীয় :
• ভাগে কোরবানি দিলে, প্রত্যেকের সমান মূল্য (প্রতি ভাগের জন্য) এবং কোরবানির খালেছ নিয়ত থাকতে হবে, নাহয় কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
• কোরবানি দাতাগনের প্রত্যেকের হালাল রুজি হওয়া কর্তব্য।
• শুধু মাংস খাবার নিয়তে অথবা হারাম পয়সা দ্বারা কোরবানি দিলে, তা জায়েজ হবে না।
• কোরবানির নিয়তে পশু কিনে তা অন্য নিয়তে লাগানো মাকরূহ।
• রাত্রে কোরবানি দেয়া মাকরূহ।
• সম্ভব হলে কোরবানিদাতা নিজে কোরবানি দিবেন, এতে অধিক সাওয়াব পাওয়া যায়।
• কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রয় করে সে টাকা গরীব মিসকিনদের দান করা কর্তব্য।
জবাই এর সকল বিষয় :
### যে পশুকে জবাই করা হবে, সেই পশুকে উত্তর-দক্ষিনমুখী করে শোয়াতে হবে এবং যিনি জবাই করবেন, তিনিসহ জবাই এ সহযোগিতা করা সবাই কেবলামুখী হয়ে জবাই করবেন।
জবাই করার ক্ষেত্রে সাধারনত পশুর চারটি রগ (শিরা-ধমনী/ খাদ্যনালী) কাটা কর্তব্য। তবে চারটির মধ্যে তিনটি কাটলেও জবাই শুদ্ধ বলে ধরে নেয়া যায়।
রগসমূহ :
• যে রগ দ্বারা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া হয়।
• যে রগ দ্বারা আহার করা হয়।
• এই দুটি রগের পাশে যে দুটি রগ দ্বারা রক্ত প্রবাহিত হয়।
জবাই এর ফরজ :
• যিনি জবাই করবেন এবং যারা সহায়তা করবেন, তারা সবাই মানসিকভাবে সুস্থ হবেন।
• বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, অর্থাৎ আল্লাহ্র নাম নিয়ে জবাই করা।
• গলদেশ থেকে কর্তন করা (ঘাড়ের দিক থেকে নয়) ।
• নির্দিষ্ট চারটি রগের সবগুলো অথবা অন্তত তিনটি কর্তন করা।
• রক্ত প্রবাহিত করা (জবাই এর মাধ্যমে)।
জবাই এর ওয়াজিব :
জবাই করার সময় পশুর মাথা, জবেহকারীর বামদিকে এবং পা তার ডানদিকে রাখা।
জবাই এর সুন্নাত :
• অজু করে জবাই করা।
• অস্ত্র ধারাল হওয়া।
• জবেহের পূর্বে নিয়ত করা।
কি কি হারাম :
• আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নামে জবাই করা।
• কাফের মুশরিক দ্বারা জবাই করা।
• নাবালক বা উন্মাদের দ্বারা জবাই করা।
• নির্দিষ্ট রগের তিনটির কম কর্তন করা।
কি কি মাকরূহ :
• বিনা অজুতে জবাই করা।
• অস্ত্র ধারাল না হওয়া।
• পশুর মাথা উত্তর দিকে এবং পা দক্ষিণদিকে রাখা (এর বিপরীতটা উত্তম)।
• জুনুব অবস্থায় জবাই করা।
• বিনা ওজরে রাতে জবাই করা।
• কাবামুখী না হয়ে জবাই করা।
• জবাই করার সময় পশুর মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা।
• প্রাণ বের হবার পূর্বেই পশুর চামড়া ছাড়ানো শুরু করা।
• জবেহকৃত পশু লেজ অথবা পা ধরে টেনে একজায়গা থেকে অন্যজায়গায় নেয়া।
লক্ষণীয় :
• বন্দুক দ্বারা শিকার করা পশু প্রাণ থাকতে জবাই না করলে, খাওয়া জায়েজ নয়।
• দাঁত, শিং, নখ ইত্যাদি (ধারাল অস্ত্র ব্যতীত) দ্বারা জবাই করলে হালাল হবে না।
• পশুকে জবাই করার জন্য শোয়ানোর পর তাকে দেখিয়ে অস্ত্র ধার দেয়া নিষেধ।
• কোন জবেহকৃত পশুর পেটের মৃত বাচ্চার মাংস খাওয়া হারাম। কিন্তু জীবিত থাকলে তার মাংস হালাল। তবে তাকেও জীবিত অবস্থায় জবাই করতে হবে।
হালাল পশুর যা যা খাওয়া হারাম :
• দমে মসফুহ, অর্থাৎ জবাই করার সাথে সাথে যে রক্ত প্রবাহিত হয়।
• প্রস্রাবের স্থান।
• পায়খানার স্থান।
• অণ্ডকোষ।
• প্রস্রাবের থলি।
• গুটলি বা গিরা।
• লিঙ্গ।
• পিত্ত।
*** (আশা করি উপরের আলোচনা থেকে আপনারা একটু হলেও উপকৃত হয়েছেন। বিভিন্ন ইসলামী বই থেকে রেফারেন্স নিয়ে এই লেখাটা লেখা হয়েছে। তারপরও ভুলত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। আপনাদের যদি কোন বিষয় নিয়ে সন্দেহ থাকে, তাহলে অবশ্যই এলাকার ইমাম অথবা অন্য কোন আলেমের কাছ থেকে জেনে নেবেন। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নেয়াই এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। সবাই ভাল থাকবেন এবং অবশ্যই অবশ্যই আমার জন্য দোয়া করবেন। ঈদ মোবারক! )