প্রখ্যাত পত্রিকা নিউজউইক তার সা¤প্রতিক সংখ্যাটিতে রাসুলুল্লাহ সা: কে ব্যঙ্গ করে নির্মিত ছায়াছবি নির্মাণের প্রতিবাদে বিক্ষোভরত মুসলমানদের ছবিসহ Muslim Rage শিরোণামে প্রচ্ছদ করেছে। আর ভেতরের পাতায় ইসলাম পরিত্যাগকারী সোমালি বংশোদ্ভুত মুরতাদ লেখিকা আয়ান হিরসি আলী’র ‘The Islamist’ Last Stand; Once again the Muslim street burns with false outrage. But we must hold our heads highশীর্ষক একটা লেখাও জুড়ে দিয়েছে।
প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: কে ব্যঙ্গ করে নির্মিত চলচিত্রের প্রতিবাদে সারা বিশ্বজুড়েই মুসলমানরা ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এর মধ্যে থেকে প্রচ্ছদে পাগড়ীধারী লম্বা দাঁড়িওয়ালা দু’জন মুসলমানের ছবি বেছে নেয়ার মধ্যে সাংবাদিকতার কতটা নৈপূণ্য আছে সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও এর পেছনে যে একটা কুৎসিত উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটা তর্কাতীতভাবে প্রতিয়মাণ হয় কোন পাঠক যখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে মিস হিরসি’র লেখা পড়বেন চলমান বৈশ্বিক ঘটনাকে সামনে রেখে। সেই সাথে একজন ধর্মত্যাগী মুরতাদ হিসেবে ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে তার ইতোপূর্বেকার ভূমিকাকে মনে রাখবেন।
নিউজ উইক অত্যন্ত সুকৌশলে মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতা নামক বর্মের পেছনে আশ্রয় নিয়ে প্রকারান্তরে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর মানহানি করার প্রচেষ্টায় যে চলচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, তাকেই সমর্থন করেছে, যদিও তা প্রচ্ছন্নভাবে। আর সম্মুখে অস্ত্র হিসেবে, দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে আয়ান হিরসি আলী’ কে।
আসলে এরা, এই সব আয়ানরা জাতে ওঠার জন্য, একটুখানি স্বচ্ছলতা আর সামাজিক নিরাপত্তা, সেই সাথে নাম-যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত পেতে যে কোন কাজই করতে, যে কোন কথা বার্তাই বলতে প্রস্তুত, তা তাদের প্রভূরা ভাল করেই জানে। আর জানে বলেই বার বার সুযোগ ও সময়মত তাদেরকেই টেনে আনে।
এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এবারেও সে নিউজউইকে সা¤প্রতিককালে আলোচ্য চলচিত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত মুসলমানদের সমালোচনা করে, তাদের ক্ষোভকে অবজ্ঞা করে নিবন্ধ লিখেছে। তার ভাষায় ‘Once again the Muslim street burns with false outrage. But we must hold our heads high. কোটি কোটি মুসলমানদের অন্তর যখন প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর অবমাননায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তখন হিরসি তাকে ‘ভধষংব ড়ঁঃৎধমব’ বলে অবজ্ঞা করে বলতে পেরেছে ‘ Islam’s rage reared its ugly head again last week!
ইসলাম বিদ্বেষী উক্ত মহিলা তার নিবন্ধে কোথাও বৃহত্তর মানবিক ঐক্যের কথা বলেনি, কোথাও সুস্থ জীবনধারার কথা বলেনি, সহিংসতা বন্ধে বিবেক ও পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কথা বলেনি, বরং একপেশেভাবে মুসলমানদের ধর্মচর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামকে খাটো করা আর মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধিনতার নামে ইসলাম বিরোধিতার কথাই বলে গেছে।
মিশর উক্ত ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর পেছনে যে বা যারা জড়িত তাদের খুজে বের করে শাস্তি বিধানের যে দাবী আমেরিকার কাছে করেছে, হিরসি তারও সমালোচনা করেছে। আমেরিকান সংবিধানে First Amendment এর দোহাই দিয়ে আমেরিকান সরকার বাক স্বাধীনতাকে কি ভাবে হরণ করে? কিভাবে মিশরের দাবীূর কাছে নতি স্বীকার করতে পারে? সে প্রশ্ন তুলেছে। তারা যদি শেষ পর্যন্ত তেমনটা করেই বসে, তবে সেটা যে এক ভয়ংকর রকমের ভূল স্বিদ্ধান্ত হবে, সে কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
অপ্রাসাঙ্গিকভাবেই টেনে এনেছে তার পূর্বসূরী সালমান রুশদীর প্রসঙ্গটিও। ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্ব কর্তৃক ফতওয়ার শীকার হয়ে রুশদীকে কতটা যন্ত্রণাদায়ক জীবন কাটাতে হয়েছে সে কথা আলোচনার পাশাপাশি ১৯৭৯ সালে রুশদীকে হত্যা করার ফতওয়া জারির পর থেকে বিগত ২৩ বৎসরে যে মুসলিম মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি, সে কথাও স্বখেদে উল্লেখ করেছে এভাবে; It is a strange and bitter coincidence that the latest eruption of violent Islamic indignation takes place just as Salman Rushdie publishes his new book Joseph Anton; A Memoir, about his life under the fatwa. A 23 years not much has changed.
আর এর পাশাপাশি ব্রিটিশ সমাজে যেসব বিবেকবান রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি রুশদীর সমালোচনা করেছেন, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধবোধ জিইয়ে রাখার কথা বলছেন, তাদেরও এক হাত নিতে ছাড়ে নি।
মিস হিরসি’র এরকম খেদোক্তি আমাদের মাথা ব্যথার কারন নয়। আমরা বরং বিষ্মিত হই নিউজইউকের মত পত্রিকার বিবেচনাবোধ দেখে। পত্রিকাটি এরকম উত্তপ্ত সময়ে ফলাও করে এরকম একটা প্রচ্ছদ ও নিবন্ধ ছাপতে পারে, সেটাই আমাদের কাছে বিষ্ময়কর। হয়ত তাদের ভাষ্যমতে আবারও সেই বাকস্বাধীনতার কথা আসতে পারে। আসতে পারে কেন? আসবেই। কেননা সেটাই একমাত্র অস্ত্র, যার পেছনে আশ্রয় নিয়ে বিশ্ব আজ ইসলামের দেড়শত কোটি অনুসরাীদের মনে আঘাত দিয়ে চলেছে।
অথচ এই নিউজউইক কিন্তু বাকস্বাধীনতার রক্ষায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি ইউকিলিকসের বেলায়। এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস এ্যসাঞ্জের পেছনে ইঙ্গ-মার্কিন সরকার হন্যে হয়ে ঘুরছে, তার মুখ বন্ধ করার জন্য। পূরো বিশ্বের চাখের সামনেই তাকে নাজেহাল করে কার্যত বন্দী করে রেখেছে একটি দেশের দূতাবাসে। কোথায় রক্ষা হলো তার ব্যক্তি স্বাধীনতা? কোথায় রক্ষা হলো মৌলিক মানবাধিকার আর বাক স্বাধীনতা?
নিউজউইক তাদের কোন সংখ্যায় কিন্তু এ প্রশ্নটি কখনও করেনি। এবং করবেও না, যে আমেরিকা বাক স্বাধীনতার নামে প্রিয় রাসুলুল্লাহর সা: কে ব্যঙ্গ করে চলচিত্র তৈরী ও প্রচার করতে দিতে পারে, সেই একই আমেরিকা কেন ঐ একই বাকস্বাধীনতার নামে উইকিলিকসের অবাধ প্রচার প্রসার ও প্রবাহকে নিশ্চিত নির্বিঘœ করতে দেয় না?
সেই বহুল কথিত ‘উপাস্য’ বাকস্বাধীনতা কোথায় ছিল? যখন সত্য প্রকাশের দায়ে আর্মির সামান্য একজন সৈনিক ব্রাডলি ম্যানিংকে ২০১০ এর জুলাই থেকে আটক করা হলো! এখনও তাকে আটকে রেখেছে, এখনও তার বিচারই শুরু হয়নি, সম্ভবত ২০১৩ এর আগে তা হবেও না। তার বাকস্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য আমেরিকার ২৯০ জনেরও বেশী চিন্তাবীদ-লেখক সরকারের কাছে দাবী জানিয়েও কেন মার্কিন সংবিধানের সেই First Amendment এ দেয়া অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারলেন না? নিউজউইক বাকস্বাধীনতা রক্ষায় সে প্রশ্নটি কখনও করেনি।
সুধী পাঠকের হয়ত মনে থাকতে পারে ইসরাইলি নাগরিক মোরদেশাই ভানুনু’র কথা। এ ব্যক্তিই ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক বোমার অস্তিত্বের কথা সর্বপ্রথম বিশ্বের কাছে ফাঁস করে দেন। ভানুনু কিন্তু একটা কথাও মিথ্যা বলেননি। যা বলেছেন, একশত ভাগ সত্য বলেছেন। কিন্তু তার পরেও মার্কিন মিত্র ইসরাইল তার নিজ দেশের একজন নাগরিককে কারাগারে আটকেছে সেই ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৯ ’এ।
বাকস্বাধীনতার নামে যে আমেরিকা আজ প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: নিত্যই আক্রমণের অবাধ লাইসেন্স দিয়ে চলেছে, সেই আমেরিকাও কিন্তু সেদিন মি: ভানুনুর বাকস্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে আসেনি এই নিউজউইকও, আজ যে নিউজউইক ঐ একই বর্মের পেছনে আশ্রয় নিয়ে সুকৌশলে ইসলাম আর মুসলমানদের আঘাত করে চলেছে!
এ ক্ষেত্রে তাদের মোক্ষম জবাব হলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভংগ। জুলিয়াস আসাঞ্জে কিংবা ভানুনু সবাই নাকি তাদের নিজ নিজ কর্মকান্ডের মাধ্যমে আমেরিনকা বা ইসরাইলের জাতিয় নিরাপত্তার বিঘœ ঘটিয়েছেন, তাই তাদের ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন আসে না।
আহা, মোক্ষম যুক্তি বটে! সত্য প্রকাশের মাধ্যমে ইঙ্গ-ইহুদি-মার্কিন নিরাপত্তা বিঘিœত হয়েছে কিনা, তা জানিনা, তবে, এটা নিশ্চিত জানি যে, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর অস্তিত্বের প্রতি বিন্দুমাত্র অবমাননা চলতে দিলে, তা রোধে কোন পদক্ষেপ না নিলে বা নেবার প্রচেষ্টা না করলে মুসলমান হিসেবে আমার ও আমাদের একাল পরকাল, দুই জীবনে অনন্তকালের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে।
আর নিজের আখেরকে নির্বিঘœ রাখতেই প্রতিটি মুসলমান বিশ্বজুড়ে রাসুলুল্লাহ সা: কে ব্যঙ্গ করার যে কোন অপচেষ্টার প্রতিবাদ করতে বাধ্য। এইসহজ সমীকরণটা যদি পশ্চিমা বিশ্ব বুঝতে না পারেন, তা হলে তাদের বলি, আসুন, ইসলাম বুঝুন, বুঝে দেখুন, কেন মুসলমানদের বুকে তুষের আগুন জ্বলছে। এ আগুন নেভানোতেই বৈশ্বিক শান্তি নিহিত রয়েছে, এ বাস্তবতাটুকু বুঝতে হবে।