সংসদে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী বলেছেন; ‘কোনভাবেই বিশ্বব্যাংক’কে বিশ্বাস করা যাবে না। যারা একটা পয়সা দেয়নি, তারা কিভাবে আমাদের দূর্ণীতিবাজ বলে? এমনকি বি এন পি সরকারের সময়েও তারা যোগাযোগ খাতে কোন অর্থ দেয়নি। তারাই আসল দূর্ণীতিবাজ। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ও ফোবর্স ম্যগাজিন পড়লেই জানতে পারবেন, দূর্ণীতি কোথায় আছে?’
তিনি প্রশ্ন রাখেন এই বলে যে, যেখানে বিশ্বব্যংক পদ্মসেতু প্রজেক্টে কোন টাকাই দেয়নি সেখানে দূর্ণীতি হলো কি করে? এক পর্যায়ে তিনি বলেন ‘বি এন পি’র আমলে দূর্ণীতির কারণে বিশ্বব্যংক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সহায়তা বন্ধ রেখেছে। যোগাযোগের সাতটি প্রকল্পে দূর্ণীতির কারণে বিশ্বব্যংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।’
বক্তৃতা দেবার সময়ে মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রীকে বেশ উত্তেজিত মনে হয়েছে। তিনি এক পর্যায়ে নিজের পরিবারের সদস্যসংখ্যা উল্লেখ করেন, নিজের ফোন নম্বর ও ইমেইল আইডি ষোলকোটি জনগণের জন্য ঘোষণা করে বলেন; তাঁর নাম করে কেউ যদি কমিশন খায় তা হলে যেন তাকে ফোন করে তা জানানো হয়।
২০০৯ সালের ১ শে জানুয়ারি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এর পর থেকে বহু কাংখিত পদ্মাসেতু নিয়ে পানি ঘোলা কম হয়নি। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে আরও হবে এবং তা চলতেও থাকবে।
বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার মন্ত্রী মিনিষ্টাররা বার বার জাতিকে আশা বাণী শুনিয়েছেন। এই ‘হবে-হচ্ছে’ ‘কোন সমস্যা নেই’ ‘টাকার জোগাড় হয়ে গেছে’ এমন সব কথাবার্তা তারা বার বার বলেছেন। মানুষের মনে আশার হিমালয় সৃষ্টি করেছিলেন তারা।
কিন্তু বিধি বাম! আমাদের আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই সেতুকে ঘিরে দূর্ণীতির অভিযোগ উঠে, বিশ্বব্যংক কয়েকবার সরকারের কাছে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়ে তদন্ত করতে বলেছে। আর ওদিকে কানাডার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, যেটি পদ্মাসেতুর সাথে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে খোদ সে দেশের সরকারই তদন্ত শুরু করে।
এখানে লক্ষণীয় দুই দেশের দুই গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে দূর্ণীতির অভিযোগ। দেশদুটির একটা হলো কানাডা, অপরটি মূল প্রকল্পের দেশ; বাংলাদেশ। কারো বিরুদ্ধে দূর্ণীতির অভিযোগ উঠলেই তিনি বা তারা যে সত্যিকার অর্থেই দূর্ণীতি করেছেন, বিষয়টি তা নয়। কিন্তু স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও উন্নত প্রশাসনিক দায়িত্ববোধের দাবীই হলো যে, উত্থাপিত অভিযোেেগর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত হবে।
এ কাজটিই করেছে কানাডা। পদ্মাসেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে দূর্ণীতির অভিযোগে কানাডিয়ান কোম্পানী এসএনসি নাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার পুলিশ দীর্ঘ কয়েকমাস তদন্ত করে। তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে যেমন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তেমনি তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের সাথেও যোগাযোগ করেছে। যোগাযোগ করেছে বিশ্বব্যংকের সাথেও। তদন্তে দূর্ণীতি হয়েছে, এমন প্রমাণ পাবার পরেই তারা উক্ত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে।
পদ্মাসেতু নিয়ে যে আসলেই দূর্ণীতি হয়েছে এবং আরও বড় দূর্ণীতির জাল পাতা হয়েছিল, তা প্রমাণ হয়ে গেছে কানাডার তদন্তেই। বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক পরজয়তো হয়েছে সেখানেই। তারপরেও বাংলাদেশ কোনরকম তদন্ত করেনি বরং জোর গলায় বলেছে, কোনরকম দূর্ণীতি হয়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীবর্গ বলেছেন একই কথা। আর দূদক‘তো মন্ত্রী আবুল হাসেনকে ধোয়া তুলসী পাতা-বেগুনাহ বলে রায় দিয়েছে। অবশ্য দুদকের এ ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। স্বয়ং সরকারপ্রধানই যখন তদন্ত ছাড়াই বলছেন ‘কোনরকম দূর্ণীতি হয়নি’ তখন দুদক ভিন্ন কথা বলে কি করে? এটা কি বাংলাদেশ নয়?
কানাডা আর বাংলাদেশ, দূর্ণীতির বিরুদ্ধে দুই সরকার একই কথা বললেও বাস্তবে তাদের আচরণের এই যে বৈপরিত্য, এটাইতো শেখ হাসিনার সরকারের জন্য বড় কলঙ্কতীলক। এর পরেও বিশ্বব্যংকসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের দূর্ণীতির খবরটি দিনের পর দিন লটকে থাকল, তার তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না বাংলাদেশকে অপমান করার জন্য। সমস্যা হলো, এত বড় অপমানের পরেও কি আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বুঝলেন যে, তারা অপমানিত হয়েছেন বা হচ্ছেন?
আসলে যার জাত নেই, তার আবার জাত যাবার ভয় কিসের? যার মান নেই, তার মান অপমানের ভয়ইবা কিসের? জাত-বেজাত, মান-অপমানের ব্যপারে এতটা নিষ্পৃহ বলেই আমাদের সরকার এখনও বিষয়টি তদন্ত না করে উল্টো বিশ্বব্যংকের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করে চলেছেন।
তারা বিষয়টি নিয়ে এত স্ববিরোধি বক্তব্য দিয়েছেন যে, পূরো বিষয়টিই এখন এক বিরাট হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাত্র গেল সপ্তাহেই উত্তরবঙ্গে এক জনসভায় বলেছিলেন, বিএনপি‘র আমলে দূর্ণীতির বিষয়ে দু‘টি ফাইল বিশ্বব্যংকের কাছে গেছে, তাদের দূর্ণীতির কারণেই তারা পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছে।’ আজ আবার সংসদে বললেন তারা নাকি বিএনপি আমলেও এ খাতে কোন টাকা দেয়নি।
প্রশ্ন হলো, টাকা না দেবার কারণে যদি তার নিজের আমলে সেতু নিয়ে কোন দূর্ণীতি না হতে পারে, তা হলে সেই একইভাবে টাকা না দেবার কারণে বিএনপি আমলেও তো এ খাতে দূর্ণীতি হও কিভাবে? আর তিনি যদি জানেনই যে, বিএনপি আমলে সংঘটিত দূর্ণীতির দুটি ফাইল বিশ্ব্যংকের কাছে গেছে বলেই তারা এখাতে অর্থায়ন বন্ধ করেছে, তা হলে তিনি বিশ্বব্যংকের চিঠিগুলো সংসদে প্রকাশ করে দিলেই তো পারেন। তা কেন করছেন না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনস্তত্ব যারা জানেন, তারা কেউই বিশ্বাস করবেন না যে, এতবড় প্রমাণ হাতে থাকতেও তিনি বিরোধি দলীয় নেত্রীকে সংসদে এক হাত না নিয়ে চুপচাপ বসে তসবীহ জপবেন!