জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ দুটো চড়ুই ঢুকে পড়ে ঘরে। একটু গ্রিলে বসে নাচে। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ডানা তড়পায় দুটো। জানালার কার্ণিশে নেমে দুতিনবার দুলকিচালে এদিক ওদিক হাঁটে। আবার মেঝেতে কয়েক দফা এক্কাদোক্কা খেলা।
আর ফাঁকে ফাঁকে পালক ফুলিয়ে একটা আর একটার পিঠে চেপে বসছে। নেমে আসছে। মহানন্দে আবিষ্কার করছে খাদ্যকণা। সেই সঙ্গে একটানা কুচুক চুকচুক কুচুক চুকচুক বকবকানি। বাইরে এপ্রিলের তপ্ত সকাল।
নচ্ছার চড়ুইজোড়ার ফস্টিনস্টি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রাগে আগুন চোখ। চল্লিশের উপরে উঠতে থাকে তাপমাত্রা। ঘরের ভেতরে লু হাওয়ার হলকা। তাতে চড়ুইদের ছোট ছোট পালক ছোট ছোট পাতার মতো চারপাশ ছড়িয়ে উড়তে থাকে।
ঘরের মাঝখানে বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে প্রবল বেগে। পৃষ্ঠচারী চড়ুই দুতিনবার কুচকুচ বকাবকানি দিয়ে ফুড়ুৎ করে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে উড়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে অন্য চড়ুইটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে পালক গোছায়। চুল আচড়ায়।
এতক্ষণ যথেষ্ট হুড়োহুড়ি হয়েছে। ছাদের মাঝখানে ফ্যানের চারপাশে গোল হয়ে উড়ছে বাতাস। বাতাসের ঘূর্ণি। গ্রীবায় মোহময় মোচড় তুলে চড়ুই একবার ছাদের দিকে তাকায়। ছোট্ট একটা পাক খেয়ে ঘুর্ণির ভেতরে উড়াল।
এই এই বোকার হদ্দ, এদিকে আসিস না, বিপদ হবে! পাখা চেঁচাতে চেঁচাতে হাত নাড়তে থাকে। কিন্তু চড়ুই উড়তে থাকে অন্ধের মতো। কটিতে পীযুগলের কান্ডকীর্তির দর্শক আমি।
প্রচণ্ড গরমে ফ্যানের তলায় বসে গা জুড়িয়ে নেবার তালে আছি। এগারটা বাজলেই লোডশেডিং শুরু হবে। হাতে অনেক কাজ। এর মধ্যে যতটুকু সেরে নেয়া যায়। জোড়াটা ঘর ছেড়ে পালাতেই আমি জানালা দিয়ে সেটার পেছনে চোখ আর মন দুটোকেই পাঠিয়েছিলাম।
কিন্তু কোনো হদিশ পেলাম না। নচ্ছার ছোঁড়া পাখিটা গেল কোথায়? ওটা কি আর একটা মেয়ে খুঁজতে গেল? এটার সঙ্গে খেলা শেষ? ভয় পেয়েছে মেয়ে চড়ুইটি। আমি ফ্যানের ঘূর্ণিবাতাসের সঙ্গে চড়ুইটির ভীতিকাতর চিৎকারের সঙ্গে ঘষটানো আওয়াজ শুনেই সুইচ বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু তার আগেই হালকা একটা ধাক্কা খেয়ে চড়ুইটি ছিটকে গিয়ে পড়েছে এক কোনায়।
ফ্যান তখন তর্জন করছে- কেমন, হল তো? এতবার বলছি, গাধা মেয়ে। আমি ফ্যান বন্ধ করি। চড়ুইটি নিচে পড়ে স্থির হয়ে গুটি মেরে বসে আছে।
মরে গেল নাকি? আহারে! কিন্তু গায়ে হাত ছোঁয়াবার আগেই আমাকে অবাক করে দিয়ে পাখি এক লাফে উড়ে গিয়ে জানালার পর্দার রেলের উপরে জোড়া পায়ে বসে। লেজ নামিয়ে ডানা গুছিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করতে করতে কুচকুচ করতে থাকে পাখি।
বুকের পালক খুঁচিয়ে আচড়ে দেয়। লেজের ছোট্ট ঝাড়টায় দুচারটা ঝাঁকুনি। আমি চোখ কুঁচকে ওকে দেখি। ব্যাপারখানা কী? ছোঁড়াটার জন্য আবার অপেক্ষা করছে মনে হচ্ছে? বোকা বুদ্ধু কোথাকার! আর একটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিল! যাক, এবার চলে যা। তোর সঙ্গী এতক্ষণে আর একটিকে জুটিয়ে নিল বোধ হয় ।
চড়ুই মেয়েটি এ কথায় দুএকবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরটির এ পাশ ও পাশ দেখে। তারপর চুপ করে বসে থাকে পর্দার রেলের ওপর। কী হলো? যা! ঐ তো দরজা খোলা। জানালার পর্দাও তো গোটানো। বাইরে আকাশ। আরো সঙ্গী। চড়ুই মেয়েটি নড়ে না।
লোড শেডিং শুরু হয়েছে। ফ্যান বন্ধ। তপ্ত হয়ে উঠেছে ঘর। আমি আর চড়ুই মেয়ে যার যার জায়গায় চুপ করে বসে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের আর কিছু করার থাকে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:১৫