somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

:: কবি নজরুল ইসলামের আরেক প্রেম : মিস ফজিলাতুন্নেসা

২৫ শে আগস্ট, ২০০৭ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

:: কবি নজরুল ইসলামের আরেক প্রেম : মিস ফজিলাতুন্নেসা - শাহরিয়ার মাহফুজ সুমন


১৯২৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে কবি নজরুল ইসলাম যোগ দেন। সেবার কবি ঢাকাতে দু’দিন থাকেন। তারপর তিনি কৃষ্ণনগরে চলে যান। ১৯২৮ সালে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনেও কবি নজরুল যোগদান করেন। কবি তাঁর স্বরচিত ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটি গেয়ে অধিবেশনের উদ্বোধন করেন। সেবার কবি ঢাকাতে আড়াই মাসের মত ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়েই তিনি মিস ফজিলাতুন্নেসা নাম্নী এক মহিলার প্রেমে পড়েন।

নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার বিয়ে হয়েছিল ১৯২৪ সালে। অর্থাৎ ফজিলাতুন্নেসার প্রতি নজরুলের এই প্রণয়জনিত ঘটনা ঘটে প্রমীলার সাথে বিয়ের চার বছর পর। ভদ্র মহিলার পিতার নাম আবদুল ওয়াহেদ খান। তাঁর অবস্থা ততটা সচ্ছল ছিল না। নিজের প্রবল আগ্রহ এবং অধ্যবসায়ে মিস ফজিলাতুন্নেসা সেকালের মুসলিম নারী হয়েও উচ্চ শিা লাভ করেন। এবং বিলাত গমন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম মুসলিম ছাত্রী হিসাবে এই মহিলা অঙ্ক শাস্ত্রে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

ফজিলাতুন্নেসা সম্পর্কে সৈয়দ আলী আশরাফ লিখেছেন, ‘...তার রং ময়লা ছিল, চেহারায় দীপ্তি ছিল, সৌকর্য ছিল। ৯২ নং দেওয়ান বাজারের বাসায় থাকতেন। কখনও বোরখা পরেননি, সুতরাং বলতে হবে তখনকার দিনের রণশীল ঢাকা শহরের বুকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে পড়াশুনা করা তাঁর দুর্জয় সাহসের পরিচয়।’

ফজিলাতুন্নেসার বিলেত যাবার ব্যাপারে সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিন সাহেবের বিরাট ভূমিকা ছিল। বিলেত যাত্রার প্রাক্কালে তাঁরই উদ্যোগে কোলকাতার সওগাত অফিসে একটি সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে নজরুল ইসলাম তাঁর স্বরচিত গান ওই অনুষ্ঠানে গেয়ে শোনান, গানটি হলো:

চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ার পুবে,
ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
জীবনের ফুল্ল শাখে
থেক না স্বর্গে ভুলে
এ পারের মর্ত্য কুলে
ভিড়ায়ে সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে

কাজী নজরুল ইসলাম ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন ছাড়া আর কাউকে জানতে দেননি। মোতাহার হোসেন ফজিলাতুন্নেসাকে বোন বলে ডাকতেন। মোতাহার হোসেন ও তাঁর বোনকে লেখা নজরুলের ক’টা চিঠি থেকে স্পষ্টতঃই ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ বোঝা যায়। মোতাহার হোসেনের কাছে নজরুলের লেখা চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায় যে ওই চিঠিগুলো তাঁর বোন পড়বে সেই উদ্দেশ্যে-ই লেখা।

কৃষ্ণনগর থেকে ২৫-২-’২৮ তারিখে মোতাহার হোসেনকে নজরুলের লেখা চিঠির শেষাংশ:

‘এ চিঠি শুধু তোমার এবং আরেকজনের। একে সিক্রেট মনে করো। আরেকজনকে দিও এ চিঠিটা দু’দিনের জন্য। কতগুলো ঝরা মুকুল দিলাম, নাও।
Ñতোমার নজরুল।’

কোলকাতা থেকে ১০-৩-’২৯ তারিখে লেখা চিঠিÑ‘আচ্ছা ভাই, আমার সব চিঠিই কি তোমার বোনকে দেখাও? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে, চিঠিগুলো আবার ফিরিয়ে নাও তো?’ নজরুল নিঃসন্দেহে ফজিলাতুন্নেসাকে গভীরভাবে ভালবেসে-ছিলেন। আর সেজন্যেই অল্প হলেও ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও বিনিময়ে সাড়া না পাওয়ার আঘাতজনিত বেদনা নজরুলের কাব্য ও কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। মনে হয় ফজিল্লাতুন্নেসাই একমাত্র মহিলা যিনি নজরুলের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেননি। এবং দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই স্বভাবতঃই তাঁকে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী বলে মনে হয়।

সৈয়দ আলী আশরাফ লিখেছেন: ‘কাজী সাহেবের (মোতাহার হোসেন) কথা থেকে এবং নজরুলের চিঠি থেকেও বোঝা যায় যে এই প্রণয় প্রধানত একতরফা ছিল। মিস ফজিলাতুন্নেসা কতদূর প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তা বোঝা দুষ্কর।’ (নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়/সৈয়দ আলী আশরাফ) ফজিলাতুন্নেসার কাছ থেকে শক খেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে ‘কৌতুকময়ী’ কবিতায় নজরুল বলেছেন:

‘তুমি বসে রবে ঊর্ধ্বে মহিমা শিখরে নি®প্রাণ
পাষাণ দেবী?
কভু মোর তরে নামিবে না প্রিয়ারূপে ধরার
ধুলায়?
লো কৌতুকময়ী! শুধু কৌতুক লীলায়?
দোলাবে আমারে লয়ে? আর সবি ভুল?’

সম্ভবত কাজী মোতাহার হোসেনকে সখী বা সখা হিসাবে এবং ফজিলাতুন্নেসাকে বধূ হিসাবে কল্পনা করে কবি লিখেছেনÑ

‘সখি, বলো বধুয়ারে, নিরজনে!
দেখা হলে রাতে ফুলবনে!’

নজরুল মনে করেন যে ফজিলাতুন্নেসা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে এমন করে কাঁদাতে পারে না, সে তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের প্রিয়া। নজরুলের গানে এই অনুভূতির রূপায়ণ হয়েছে:

‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়া তোমায় আমি
চিনি যেন
তোমার চাঁদে চিনি আমি, তুমি আমার
তারায় চেন।’

নজরুল তাঁর স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। ২৮-৩-’২৮ তারিখে ফজিলাতুন্নেসাকে লেখা নজরুলের চিঠিই এর প্রমাণ: ‘আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ‘‘সঞ্চিতা’’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই।...আমি ুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কি সম্মান করিব?’ কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর ‘সঞ্চিতা’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন। কেন, তা বোঝা কঠিন।

ফজিলাতুন্নেসা নজরুলকে একটা চিঠি লেখেন বেশ কড়া ভাষায় ১৯২৮-এর মার্চ মাসে। ওই সময় প্রাণের বন্ধু মোতাহারকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতে তাঁর বেদনার্ত আত্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটে: ‘...আচ্ছা বন্ধু ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়...?...সত্যিই তো তার সুন্দরের চরণ ছোঁয়ার যোগ্যতা আমার নেই, আমার দু’হাত মাখা কালি। বলো, যে কালি তার রাঙা পায়ে লেগেছিল; চোখের জলে তা ধুয়ে দিয়েছি।...সে যদি আমার কোন আচরণে ুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বলোÑআমি তাকে প্রার্থনার অঞ্জলির মত দুই করপুটে ধরে তুলে ধরতে, নিবেদন করতেই চেয়েছিÑবুকে মালা করে ধরতে চাইনি। দুর্বলতা এসেছিল, তাকে কাটিয়ে উঠেছি। সে আমার হাতের অঞ্জলি, নঁঃঃড়হ যড়ষব-এর ফুল নিবাস নয়।’

ফজিলাতুন্নেসা বিলেত থেকে ফেরার পর নজরুল ও তাঁর ভিতর আর কোন যোগাযোগ ঘটেনি। অর্থাৎ এ প্রণয়পর্বের এখানেই ইতি ঘটে। নজরুলের কবিতা, গানকে ভালভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের তাঁর জীবনের নার্গিস ও প্রমীলা অধ্যায়ের সাথে ফজিলাতুন্নেসা অধ্যায়ও জানতে হবে। এছাড়াও নজরুলের পরিপূর্ণ জীবনকেও সঠিকভাবে জানতে হবে। আর এ জানাবার দায়িত্ব নজরুল গবেষকদের। তাই তাঁরা যেন নজরুলকে খণ্ডিত না করে এবং ুদ্র স্বার্থে তথ্যসমূহ বিকৃত না করে আমাদের সামনে তাঁকে তুলে ধরেন। তাহলেই সত্যিকার অর্থে কবি নজরুলের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হবে।




৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×