পৃথিবীতে অভিবাসন প্রক্রিয়াটি ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তার দিনক্ষণ উল্লেখ করা মুশকিল। তবে সভ্যতার শুরুতেই যাযাবর মানুষ অভিবাসিত হয়েছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, একেক অঞ্চল থেকে দেশ, জলবায়ু, প্রকৃতি, কৃষ্টি, ভাষা ইত্যাদি নানান ভিন্নতার দিকে। আজকাল অভিবাসন কেবল অর্থ আয়ের প্রক্রিয়াধীন বিবেচিত হলেও তারই মধ্যে নানান মাধ্যমের মেধাবী মানুষদের সাক্ষাৎ মেলে। বাঙালি কিংবা ভারতীয় অনেকেই লেখালেখি করেন ইংরেজিতে; কিন্তু ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগিজ, স্পেনীয় কিংবা ইতালিয়ান ভাষায় মোটেই দেখা মেলে না। হয়তো দ্বিতীয় তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসী সন্তানরা সে পথেও এগিয়ে যাবে। ইতালিতে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী কেউ কেউ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিসরের সাগদে আলম, টোগো-র কুসসি উল্লেখযোগ্য।
কুসসি পুরো নাম কুসসি কুমলা এবরি। গভীর কৌতুকরস সমৃদ্ধ লেখক। পেশায় চিকিৎসক। জন্ম টোগো। আফ্রিকান এ লেখকের বিতর্কহীন কল্পনাশক্তির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে তার অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা। ‘যদি তুমি কখনো তোমার ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে না থাকো, তাহলে এ কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, একমাত্র তোমার মা-ই কেবল সুস্বাদু সস রান্না করতে জানেন।’ কুসসি’র মাতৃভূমি টোগো-র প্রচলিত কথা এভাবেই উদ্ধৃত হয় তাঁর লেখায়, ভাষায়। আজ তার পরিচিতি চিকিৎসক হিসেবে নয় লেখক হিসেবে।
সত্তর এর দশকে কুসসি কিছুদিন ফ্রান্সে বসবাস করলেও পাকাপাকি ইতালি চলে আসেন। পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। বর্তমানে তিনি ফাতেবেনে ফ্রাতেল্লি নামের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। মিলান থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে এবরা নামক শহরে বাস করেন তিনি। কুসসি তুলনামূলকভাবে তার স্বল্প লেখালেখিতেই আলোচিত ও খ্যাত। কম লেখার পেছনে প্রধান কারণ, আসলে তার মূল পেশা চিকিৎসা। অথচ ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে তিনি ঋওি ্ কৗই সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। তার পুরস্কৃত এ গল্পগ্রন্থের নাম ছিল ’খৈইূঊৃ ইককৗইগঋৗওঋৗ অী এঅখুঋ’ অর্থাৎ ‘যখন আমি নদী পার হয়েছিলাম’।
পরবর্তীতে ’অুঈইৗইছছঅওুঅ’ অর্থাৎ ‘বিব্রতকর’ প্রকাশের পর সাধারণ ইতালিয়ান পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ গ্রন্থটি ছোটগল্পের সংকলন। এর মধ্যে আচরণে ইতালিয়ান সমাজে অভিবাসীদের প্রতিদিনের বিব্রত হওয়ার কথা ওঠে এসেছে। তাঁর লেখা বড় গল্প ’ীই ওৃেওই ঊঋঐীঅ ঊঋঅ বা ‘ঈশ্বরের নববধূ’ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এখন দ্বিতীয় উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত তিনি।’ ‘মাঝে মধ্যেই আমি রসিকতার ছলে বলি, লেখালেখি আমার পেশা আর শখ চিকিৎসা। আসলে এ কথা সত্য যে, চিকিৎসক পেশা আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ বিষয়ে আমি সৎ ও নিষ্ঠাবান। আমি জানি লেখালেখি আমার প্রাত্যহিক খরচ মেটায় না। কেননা আমি সার্বক্ষণিক লেখক নই। তবে আমি দুটি সমান্তরাল জীবনযাপন করি। যেমন- দিনের বেলায় আমি একজন চিকিৎসক আর রাতের বেলায় লেখক। আমি কখনোই বেশি ঘুমাই না।’
কুসসি’র মতামত
আপনি দু’সন্তানের জনক। আপনার স্ত্রী একজন ইতালিয়ান। এ ক্ষেত্রে মিশ্র দম্পতি হিসেবে আপনার উপলব্ধি কি?
আমার মতে আসলে সব দম্পতিই মিশ্র। এক্ষেত্রে দু’জন মানব-মানবীর মধ্যে পারস্পরিক মিলনের যে রসায়ন তা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ- সর্বদা এ প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ভিন্ন সংস্কৃতির দু’জন তবুও পারস্পরিক জানা ও বোঝার মধ্য দিয়েই একত্রে বসবাস করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে প্রশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পরস্পর ভিন্ন সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পর্কে জানা। আমার দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘যেমন ভাষান্তর করা হয় সেভাবে একে অপরকে জানো এবং বিয়ে করো।’ আমার মনে হয় সব দম্পতিই তা করেন বা করে থাকবেন।
আপনার সন্তানরা কিভাবে বেড়ে উঠুক- এটা চান?
আমরা চাই, চেষ্টা করি আমাদের সন্তানদের এ শিক্ষা দিতে যে, অপরকে শ্রদ্ধা করা, স্বাধীনতা, আইন এর গুরুত্ব, ভদ্রতা, নিজের পছন্দের প্রতি দৃঢ়তা ও অঙ্গীকারবদ্ধতা, দায়িত্ববোধ এবং অন্যান্য মানবিক গুণ যেসবের প্রতি আমরা বিশ্বাসী ও আন্তরিক।
ঘরে আপনারা কি ধরনের রান্না করেন?
আমরা মূলত ইতালিয়ান খাবারই খেতে অভ্যস্ত কেননা তা তৈরি ও পরিবেশন সহজ। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে আফ্রিকান খাবার তৈরি করা হয় অতি অবশ্যই।
টোগোর কোনো স্মৃতি কি আপনাকে তাড়িত করে?
হ্যাঁ। আমার ঘর, একদা যা ছেড়ে আসতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। অথচ অত্যন্ত সাধারণ হলেও তাতে আমার অনেক সুখ-দুঃখ, বিশেষত বেড়ে ওঠার স্মৃতি জড়িত। এ স্মৃতি আমার জীবনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় যা অনেক বিচিত্র বিষয়ে ঠাসা। তা জীবনের এমন এক অধ্যায় যে, জীবনের গতি, স্বাদ, কোলাহল, গন্ধ, শব্দ ও আমোদে পরিপূর্ণ যা ভোলবার নয়।
ইতালিতে কি পেয়েছেন?
প্রথমেই বলব, আমি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছি যার সূত্রে আমার বর্তমান পেশা, সংসার। এখানেই আমি জীবন সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছি। একটা ভাষা পেয়েছি যা দিয়ে আমার ভালোবাসা-ভালোলাগা-অনুভব প্রকাশ করতে পারছি।
সম্প্রতি অভিবাসী সাহিত্য পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সমসাময়িক পাঠক সমাজে এর প্রভাব কি রকম বলে মনে করেন?
আমার মনে হয় এ প্রশ্নে আসলে ‘অভিবাসী লেখক’ বিষয়টিই উচ্চকিত। হ্যাঁ অবশ্যই অভিবাসী হিসেবে এ কথা বলব, যে, এ সাহিত্য স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি। এ সাহিত্যে অভিবাসী চিহ্নটি যতটা শারীরিক বা প্রাকৃতিক তার বেশি আবেগময় ও বুদ্ধিময়তাই পরিলক্ষিত হয়। বাহ্যত অভিবাসী চিহ্নের বাইরেও রয়েছে তার অসংখ্য ইমেজ, সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি ও বিচিত্র আচরণ এর আধার। অভিবাসী সাহিত্যের ধারণার মধ্যে একটা গণ্ডিতে তাকে আবদ্ধ করে ফেলার স্বার্থ, চেষ্টা অব্যহত থাকলেও অতি অবশ্যই তা অভিবাসন প্রসঙ্গে আবদ্ধ থাকবে না বলে আমার বিশ্বাস। আমার দৃষ্টিতে তথাকথিত ‘অভিবাসী সাহিত্য’ ইতালিয়ান সমকালীন সাহিত্যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা উন্নত সৃষ্টির মাধ্যমে মূলধারার সঙ্গে অখণ্ড সত্তায় মিলিত হবে। এখানে অনেক অভিবাসী লেখক আছেন। যেমন- আফ্রিকা, আলবেনিয়া, পোল্যান্ড, বসনিয়া, আরব, দক্ষিণ আমেরিকান। বিভিন্ন দেশের অনেক সাহিত্য কর্মীদের জানি যারা সম্মিলিতভাবে ’ঋঅ ঐঔঅঈীঅ’ নামের একটি ‘অনলাইন ম্যাগাজিন অফ মাইগ্রেন্ট লিটারেচার প্রকল্পে কাজ করছেন। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, আরো সংগঠিতভাবে ব্যাপকস্তরে বর্তমান এ ‘অগ্রসরমান সাহিত্যধারা’কে ক্রমশ : ব্যাপক দৃশ্যমান করে তোলা। কুসসি ইতালিতে ‘অভিবাসী’ লেখকদের ভবিষ্যৎ সাহিত্যকর্ম নিয়ে বরাবরই আশাবাদী।