প্রথম রাত
ঝাঁঝ মেশানো গলায় তারেক বলল-“গাড়িটা আস্তে চালা শালা! প্রথম দিনেই ইঞ্জিনটা বিগড়ে দিবি নাকি!!”
“তুই ছাই বুঝিস গাড়ির? ড্রাইভিংয়ের ড-ও তো জানিস না। খালি গাড়ির মালিক হলে হবে।” বলতে বলতে স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে দিল মিথুন, তারেককে রাগানোর জন্যই বোধহয়!
“ড্রাইভিংয়ের ডি হবে, ড নয়।” পেছনের সিটে বসে আনিকা শুধরে দিল মিথুনকে।
“ঐ হবে একটা। ড্রাইভিং যে ইংরেজি শব্দ সেটা কি করে বুঝলি? এমনও হতে পারে উজবেকিস্তানের ভাষা হতে এসেছে শব্দটা!”
তারেক ধমকে উঠল-“গাড়ি ঘুরা মিথুন!!”
“কেন? তোর কি হলো আবার?”
“এদিকের রাস্তা সেইফ না। সামনে একটা ছোটখাটো জঙ্গল আছে।”
“তাতে কি? বৃষ্টির রাত, লং ড্রাইভ, নির্জন রাস্তা, শূন্যে ভেসে থাকা প্রেতাত্মা, এমন কিছু না হলে জমে!”
“কে বলে লং ড্রাইভ! এটা টেস্ট ড্রাইভ। নতুন গাড়ি কিনেছি বলে তোকে নিয়ে এলাম টেস্ট ড্রাইভে, টেস্ট ড্রাইভ লং ড্রাইভ হলো কি করে?”
“টেস্ট ড্রাইভ শর্ট ড্রাইভ হতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি! টেস্ট ড্রাইভ হলো ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচের...”
আনিকা ওদের কথা শুনছিল না, উইন্ডশিল্ড দিয়ে গাড়ির সামনেটা দেখছিল। হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল সে। “মিথুন...সামনে দেখ...!”
রাস্তাটা বেশ নির্জন, দু’পাশে সারি সারি গাছ। রাস্তার মাঝখানে ধবধবে সাদা শাড়ি পড়া একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। এক চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে তার। আরেকটা চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের গাড়ির দিকে। কেমন অশুভ একটা ছায়া ঘিরে আছে তার চারিদিকে।
ঘুমটা ভেঙে গেল আনিকার।
*** *** ***
ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়া বেশ ব্যস্ত। কেউ এটা সেটা খাচ্ছে, কেউ গান গাইছে, কেউ গল্প করছে, সরগরম একটা জায়গা। তবে আড্ডা দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না।
মিথুন, আনিকা এবং তারেক বসেছিল কোনার দিকের একটা টেবিলে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মিথুন আনিকাকে বলল-“কি হয়েছে? বাসায় ঝগড়া করেছিস?”
আনিকা উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সকালের নরম রোদ এসে পড়ছিল তার চোখে। কেমন বিষণ্ণ একটা চেহারা! মিথুনের কথায় একটু যেন চমকে উঠল সে। নিজেই নিজের মধ্যে এত গভীর ভাবে ছিল, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে খেয়াল ছিল না। ইতস্তত করে সে বলল, “কই না তো!”
“কিছু একটা হয়েছে সেটা আমিও নিশ্চিত।” পরোটায় কামড় বসাতে বসাতে বলল তারেক। অদ্ভুত কোন কারণে সকালে নাস্তা করার সময় পায় না সে কখনোই, তেমন ব্যস্ত না হওয়া সত্ত্বেও। ইউনিভার্সিটিতে এসে ক্যাফেটেরিয়ায় নাস্তা সারে প্রতিদিন। সে আনিকাকে বলল- “তোর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট।”
“নাহ, কিছু হয়নি।” মাথা নেড়ে উত্তর দিল আনিকা।
ব্যঙ্গাত্মক সুরে মিথুন বলল-“বিয়ের প্রস্তাব এসেছে বোধহয় বেচারির। তাই টেনশনে আছে!”
“এতে টেনশনের কি আছে।” মুখ ভর্তি পরোটা নিয়ে বলতে লাগল তারেক-“তোর তো বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড নেই। প্রস্তাব আসলে ঝুলে পড়বি। এমনিতেই বিয়ে করার উপযুক্ত সময় এখন। কবি বলেছে, এখন যৌবন যার...”
আনিকা প্রচন্ড বিরক্ত হলো শস্তা রসিকতায়। বলল- “ধুর! বিয়ে, সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা ছাড়া আর কিছু নেই মেয়েদের জীবনে?”
বিস্ময় হবার নিখুঁত অভিনয়ে মিথুন বলল-“আর কি আছে?”
“এটা সত্য।” তারেক বলল। “এত কষ্ট করে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সিংহভাগ বাঙালি মেয়েরা শেষমেশ কাজ কর্ম বাদ দিয়ে ঘর সংসারই করে।”
আনিকা প্রতিবাদ করল। “সময় আগের মতো নেই, পাল্টাচ্ছে...”
মিথুন জ্ঞান বিতরণ শুরু করল। “কেমন পাল্টাচ্ছে আমি তোকে বলি। সেদিন স্ট্যাটিসটিক্স ডিপার্টমেন্টের ঋতুর বিয়ে হয়েছে শুনলাম। দেখা হতে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ের পর চাকরী করবি? সে বলল, করবে না। তার স্বামী এবং বাবা কেউই চায় না সে চাকরী করুক। শুনে বলেছিলাম, তাহলে তোর বাবার এত পয়সা কড়ি খরচ করে তোকে গ্রাজুয়েশন করানোর কি দরকার ছিল? হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলের জ্ঞান দিয়ে দিব্যি চলা যায় জীবনে। সে বলেছিল, যদি কখনো স্বামীর কিছু হয়ে যায়, তাহলে! চিন্তা করে দেখ, কেমন হিপোক্রেসি! ব্যাপারটা যেন এমন, পৃথিবীর সব ডাক্তার যদি মরে যায়, সেই ভয়ে ডাক্তারিটা শিখে নেই আজই। কিংবা সব মুচি যদি মারা যায়, তাই আজই জুতো সেলাইটা শিখে...”
তারেক বলল-“উহু, বাদ দে। পয়েন্ট থেকে সরে যাচ্ছি আমরা। আনিকার কিছু একটা হয়েছে এবং সেটা বিয়ে নয়, অন্য কোন ঝামেলা। কি সেটা আনিকা?”
আনিকা চোখ কুঁচকে মিথুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য মনে মনে কথা গোছাচ্ছিল। তারেকের কথায় ফিরল ওর দিকে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“তেমন কিছু না। স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে। এত স্পষ্ট, জ্যান্ত, বাস্তব দুঃস্বপ্ন কখনো দেখিনি। তাই একটু থম মেরে গিয়েছিলাম।”
“ধুর, এটা কোন ব্যাপার হলো। রাত শেষ, স্বপ্নও শেষ। কে যেন বলেছে, স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা ঘুমের ভেতর আসে। স্বপ্ন হলো সেই জিনিস, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।”
মিথুন বাঁকা হেসে বলল-“শস্তা কোটেশন। গ্রামারটিক্যালিও ভুল কথা। একই শব্দের অনেক রকম অর্থ হতে পারে। যদি বলি, পড়া তা নয় যা বইয়ের পাতায় থাকে, পড়া সেটা যেটা গাছ থেকে পড়ে। এটার কোন অর্থ দাঁড়ায় না। বাক্যে আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি, যোগ্যতা না থাকলে ব্যাকরণ অনুযায়ী সেটা বাক্য হয় না...”
মিথুনের লেকচার শুনে বিষম খেতে খেতে সামলে নিল তারেক। বলল-“আচ্ছা ভাই মাফ কর। আনিকা, তোর স্বপ্নের কথাটা শুনি।”
আনিকা লম্বা দম নিয়ে বলল-“তোদের সাথে শেয়ার করা উচিত আমাদের। কারণ হলো, স্বপ্নে তোরা দু’জন ছিলি।”
তারেক এবং মিথুন নড়েচড়ে বসল। আনিকা বলতে লাগল, “আমি দেখলাম। আমরা ৩ জন এক বৃষ্টির রাতে তারেকের গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে গিয়েছি কোন এক নির্জন রাস্তায়, রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ এক অশরীরী নারীমূর্তির উদয় হলো। সাদা শাড়ি পড়া, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এতটুকুই দেখলাম। তবে সব কিছু কেমন ভীষণ স্পষ্ট ছিল। খুব ভয় পেলাম!”
শুনতে শুনতে মিথুনের চেহারাটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল, “মহিলার এক চোখ দিয়ে কি রক্ত পড়ছিল?”
ভীষণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল আনিকা। “হ্যা, তুই কি করে বুঝলি?”
“গাড়িটা কি আমি ড্রাইভ করছিলাম? তারেক আমার পাশের সিটে, তুই পেছনের সিটে বসেছিলি?”
“মাই গড! তুই কি করে জানলি এসব মিথুন?”
মিথুনের চেহারায় যেন আষাঢ়ের মেঘ জমেছে। ভারী গলায় সে উত্তর দিল, “আমি এসব জানি, কারণ আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে।”
এবার তারেক সত্যি সত্যি বিষম খেল। কাশতে কাশতে পানি খেয়ে নিল এক গ্লাস। বলল-“এ কি করে সম্ভব?”
মিথুন বলল-“সত্যিই তো, এটা তো অসম্ভব ব্যাপার যে দু’জন একই রাতে হুবহু একই স্বপ্ন দেখেছি!”
আনিকা এতই বিস্মিত হলো যে একদম মূর্তির মতো ঝিম মেরে বসে রইল সে।
দ্বিতীয় রাত
রাস্তার মাঝখানে ধবধবে সাদা শাড়ি পড়া একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। এক চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে তার। আরেক চোখে তাকিয়ে আছে ওদের গাড়ির দিকে। কেমন অশুভ একটা ছায়া ঘিরে আছে তার চারিদিকে। মিথুন এতটাই ভয় পেয়েছিল যে গাড়ি চালানো ভুলে হা করে তাকিয়ে ছিল মহিলাটির দিকে। অন্য সবারও একই অবস্থা। ফলে যা হবার তাই হলো!
প্রচন্ড জোড়ে গিয়ে মহিলার শরীরে আঘাত করল তারেকের নতুন কেনা টয়োটা এলিয়ন গাড়ির বাম্পার। ছিটকে শরীরটা কোথায় পড়ল সেটা দেখার আগেই গাড়িটা চলে এসেছে বেশ দূরে। ব্রেক কষল মিথুন। গাড়ি থেকে নামল ওরা সবাই। ছুটে গেল পেছনের দিকে। মহিলার লাশটা রাস্তার এক ধারে পড়ে রয়েছে।
আনিকা লাশটা দেখেই কান্না জুড়ে দিল। তারেক তখনও প্রচন্ড বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল মহিলাটির দিকে। মিথুন কিছুটা সামলে নিয়ে হাত ধরে নাড়ী পরীক্ষা করল মহিলার। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল-“বেঁচে নেই।”
মাথায় যেন আগুন ধরে গেল তারেকের। দৌড়ে গিয়ে কলার চেপে ধরল মিথুনের। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “শালা বলছিলাম আস্তে চালা, শুনলি না। ফাকিং বাস্টার্ড! গাড়িটা তো তোর না, ফাঁসব তো আমি...বাবা জানলে...”
আনিকা তারেকের হাত ধরে টানতে লাগল। “ছেড়ে দে ওকে তারেক। ওর দোষ না। আমরা তো ভেবেছিলাম...”
ওর দিকে কটমট করে তাকাল তারেক। বলল-“কি ভেবেছিলি?”
“ভেবেছিলাম, ওটা মানুষ না, ভূত!”
“এই গাঁজাখুরী ভূতের গল্প শুনে আস্ত একটা মানুষকে মার্ডার করে দিলি? রাত বিরেতে রাস্তায় মহিলা মানেই ভূত? ননসেন্স রাবিশ দিয়ে কি মগজ ভর্তি হয়ে আছে তোদের? একটা আস্ত মার্ডার...” আর শুনল না আনিকা। দু’হাতে কান চেপে কান্না জুড়ে দিল।
মিথুন বলল-“থাম তারেক! অনেক হয়েছে। যা হবার হয়ে গেছে। বৃষ্টির রাত, রাস্তায় কেউ নেই। কেউ আসার আগেই কেটে পড়ি চল। আমাদের সরে যাওয়া উচিত এই মুহূর্তে।”
“মহিলাকে এভাবে ফেলে রেখে...”
“শি ইজ ডেড। আমরা কোনভাবে আর সাহায্য করতে পারব না তাকে। রাস্তা ফাঁকা থাকতেই কেটে পড়।”
তারেক মাথা ঝাঁকাল। ঠিক আছে চল।
*** *** ***
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল আনিকার। মিথুন ফোন করেছে। আনিকা ফোন রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল-“হ্যালো!”
“তুই কি স্বপ্নটার পরের অংশ দেখছিলি?”
“হ্যা...হ্যা...তুই কি করে বুঝলি?”
“আমিও দেখছিলাম, মাত্র ঘুম ভাঙল আমার।”
“মাই গড, এসব কি হচ্ছে মিথুন। দু’জন এক সাথে একই স্বপ্ন দেখার মানে কি?”
“আমি জানি না আনিকা। আচ্ছা তুই কি দেখেছিস বল তো!”
“দেখেছি, আমরা মহিলাটিকে গাড়ি চাপা দিয়েছি। তারপর ওখান থেকে সরে পরার পায়তারা করছিলাম। তখনই ঘুমটা ভাঙল।”
“আমি এতটা দেখিনি, শুধু দেখেছি, মহিলাটা গাড়ি চাপা পড়েছে। মারা গেছে।”
“এই বীভৎস স্বপ্ন দেখার মানে কি বল তো?”
“জানি না। সত্যি ভাববার বিষয়। কাল কথা হবে সকালে। গুড নাইট।”
*** *** ***
ক্যাফেটেরিয়ায় বসে তারেক প্রায় চিৎকার করে উঠল-“একই স্বপ্ন টানা দু’দিন দু’জন দেখেছিস, তাও স্বপ্নের পরের অংশ? এতো অসম্ভব, অবাস্তব!! স্বপ্ন তো আর টিভি সিরিয়াল নয়!!”
“অবাস্তব নয়, বাস্তব।” সেলফোনে ডুবে ছিল মিথুন। মাথা তুলে কথাটা বলল।
“কি?”
আনিকার দিকে তাকিয়ে মিথুন জিজ্ঞেস করল-“কোন রাস্তায় আমরা গাড়ি চালিয়েছিলাম স্বপ্নে, বলতে পারবি আনিকা?”
“না...তবে...পথঘাট দেখে মনে হলো, গাজীপুরের দিকে হতে পারে কোথাও।”
“হ্যা, গাজীপুরেই। এই নিউজটা দেখ আনিকা।” সেলফোনের স্ক্রিনটা দেখাল সে আনিকাকে। একটা অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সংবাদটা দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল আনিকার। শিরোনামটা হলো-“সড়ক দুর্ঘটনায় গাজীপুরে এক মহিলার মৃত্যু।” নিউজের ভেতরের দিকটা পড়তে পড়তে আরও বেশি অবাক হলো সে। “......মহিলার নাম শারমিন (৩৫) । গতরাতে চোখের অপারেশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সে...”
“মহিলার চোখ অপারেশন হয়েছিল। হয়তো বৃষ্টিতে খুলে গিয়েছিল ব্যান্ডিজ। সেজন্যই রক্ত পড়ছিল চোখ থেকে।”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু ঘটনাটা তাহলে সত্য?”
“তা কি করে হয়, এমন কিছু ঘটলে অবশ্যই আমাদের মনে থাকত! তবে রোড এক্সিডেন্টের ব্যাপারটা সত্যি। তবে সেটা নিশ্চয়ই আমরা করিনি। এটা তো আর ভুলে যাবার মতো কোন ঘটনা নয়! তাহলে এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার মানে কি?”
তারেক কি যেন ভাবছিল। সে বলল-“আচ্ছা বলতো, সে রাতে আমরা কে কোথায় ছিলাম?”
অনলাইন নিউজের তারিখ দেখল মিথুন। তারপর বলল, “১৩ ই জুলাই। আরে সেদিন তো আনিকার জন্মদিন ছিল! আমরা সবাই ওর বাসায় গেলাম, কেক কাটলাম, রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরলাম, মনে নেই তোদের?”
তারেক মাথা দোলাল। “মনে আছে। ১৩ ই জুলাই আমরা আনিকার বার্থ ডে পার্টিতে ছিলাম। তাহলে তোদের স্বপ্নের ব্যাপারটা প্রায় ইম্পসিবল একটা কো ইনসিডেন্ট ছাড়া কিছুই নয়।”
আনিকা বলল, “কিন্তু এত বড় কো ইনসিডেন্ট...”
“হতেই পারে। অসম্ভবের কাছাকাছি ঘটনাও তো ঘটে।”
মিথুন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল তারেককে। সে বলল-“আচ্ছা বলতো, আমাদের স্বপ্নে ৩ জন ছিলাম। অথচ স্বপ্ন দেখছি শুধু আমি আর আনিকা, তুই দেখছিস না কেন তারেক?”
“দু’জনের চেয়ে তিন জনের একই স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা কি বেশি না কম? কাকতালীয় ব্যাপারেরও তো একটা সীমা থাকে! তবে আমার মনে হয়, হয়তো তোরা দুজনেই অনলাইন নিউজটা পড়েছিলি আগে, মনে নেই তোদের। সেখান থেকে আবোল তাবোল চিন্তা এসেছে মাথায়। আমি পড়িনি তাই আসেনি আমার মাথায়। হতে পারে না?”
“পারে, কিন্তু পরপর দু’দিন কেন?”
“প্রথম দিনেরটা ছিল কাকতালীয়। দ্বিতীয় দিনেরটা ছিল ইনডিউসড হ্যালুসিনেশন জাতীয় কিছু। আমরা এখানে বসে বিষয়টা নিয়ে গল্প করছিলাম বলেই দ্বিতীয়বার ঘটল ব্যাপারটা। একে অপরের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিস। এমনকি আজ রাতেও যদি তোরা স্বপ্নটা আবার দেখিস, আমি অবাক হবো না।”
মিথুন লক্ষ্য করল, তারেকের কপাল চিড়ে একটি সূক্ষ্ম ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে।
তৃতীয় রাত
মিথুন বল, “শি ইজ ডেড। আমরা কোনভাবে আর সাহায্য করতে পারব না তাকে। রাস্তা ফাঁকা থাকতেই কেটে পড়।”
তারেক মাথা ঝাঁকাল। ঠিক আছে চল।
ফেরার পথে সবাই গুমোট হয়ে বসে রইল গাড়ির ভেতর। কিছুক্ষণ পর আনিকা বলল-“আমি তো জীবনে কখনো শান্তিতে ঘুমোতে পারব না এই ঘটনার পর।”
মিথুন মাথা ঝাঁকাল। “আমিও পারব বলে মনে হয় না। আস্ত মার্ডার! বাপ রে বাপ!!”
তারেক অনেকটা শান্ত হয়েছে। সে বলল-“ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা ছিল মিথুন। যত ভয়ংকরই হোক না পুরো ব্যাপারটা, এখানে আমাদের দোষ ছিল না। কোন শত্রুতা ছিল না আমাদের ঐ মহিলার সাথে। ইচ্ছে করে কিছু করিনি আমরা। ঘটনাটা ভুলে গেলেই সবার জন্য ভালো হবে।”
“চাইলেই কি আর ভোলা যায়?”
কথাটা শুনেই পাথর হয়ে গেল যেন তারেক। বলল-“গাড়ি থামা মিথুন।”
“কি হলো আবার?”
“গাড়ি থামা!!”
রাস্তার ধারে সাইড করল মিথুন। বলল- “কি হয়েছে বলবি?”
“আচ্ছা, তুই আর আনিকা তো স্কুল লাইফ থেকে বন্ধু তাই না?”
“হ্যা, তাই। কেন?”
“তোরা একবার আমাকে বলেছিলি কেমন করে তোদের বন্ধুত্ব হলো। মনে আছে?”
আনিকা বুঝে গেল তারেক কি বলতে চাইছে। সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না! বিষয়টা আরও জটিল হয়ে উঠবে তাহলে!”
“না, জটিল হবে না। এটাই একমাত্র সমাধান।”
মিথুন চোখ গোল গোল করে তাকাল। “তারেক, তুই নিশ্চয়ই সেটা করতে বলছিস না? যেটা অনেকদিন আগে স্কুলের বারান্দায়...”
“হ্যা, সেটাই। তোকে আর আনিকাকে সেই কাজটাই আবার করতে হবে। আজ আনিকার জন্মদিন। পার্টি পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপর...”
“অনেক বছর আগের কথা , এখন আর...”
“চেষ্টা করে দেখ মিথুন!”
আনিকা আর মিথুন একে অপরের দিকে তাকাল।
(সমাপ্ত)
পুনশ্চ: অনেক বছর আগের কথা। মিথুন তখন স্কুলে পড়ে। তার একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল। ক্ষমতাটা বেশ অদ্ভুত। অনেক মানুষ আছে, যাদের ফটোগ্রাফিক মেমরি থাকে। কোন একটা জিনিস একবার পড়লে কখনো ভোলে না। কিন্তু মিথুনের ছিল উল্টো একটা ক্ষমতা। সে চাইলে যে কোন কিছু ভুলে যেতে পারত। কোন মানুষই কোন ঘটনা ইচ্ছে করে ভুলতে পারে না। মিথুন পারত। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা, সঙ্গে সঙ্গেই ভুলতে পারত সে। যেমন আজ হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে। ফিরে এসে চিন্তা করল, আমি ভুলে যাব বেড়াতে যাবার পুরো ঘটনাটা। অমনি সত্যি সত্যি ভুলে গেল সে। কিছুতেই সে মনে করতে করতে পারল না আজ সারাদিন কি করেছে। স্কুলে ভর্তি হবার পর মিথুন টের পায়, এই ক্ষমতাটা তার একার নয়। আরও অনেকেরই আছে। যেমন, তাদের ক্লাসের এই মেয়েটা, আনিকা। খুব সহজেই যা ইচ্ছে তা ভুলে যেতে পারে সে। বিষয়টা সে প্রথম জানে স্কুলের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ফলাফলের দিন। আনিকার রেজাল্ট খুব একটা ভাল হয়নি। সে দেখল, স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আনিকা বলছে-“আজ আমার রেজাল্ট দিয়েছে, এই ঘটনাটা ভুলে যাব আমি। বাসায় রেজাল্ট নিয়ে কিছু বলারও প্রয়োজন নেই। যদি ভুলে না যাই, বাবা নির্ঘাত ধরে ফেলবে যে আমি মিথ্যে বলেছি। সব ভুলে গিয়ে এখনই আমি বাসায় চলে যাব।” কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে খুলতেই আনিকা উদভ্রান্তের মতো চারিদিকে তাকাল। যেন, কি করে এখানে এসেছে, বুঝতে পারছে না। মিথুন বুঝল ব্যাপারটা। কোন কিছু ভুলে যাবার পর তার সাথেও এমন হয়।
আনিকা চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মিথুন ওর পথ আগলে দাড়াল। আনিকা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে দেখল ওকে। মিথুন জিজ্ঞেস করল-“তোমার রেজাল্ট কেমন হলো আনিকা?”
আনিকা ভীষণ অবাক হয়ে বলল-“রেজাল্ট! আজ রেজাল্ট দিয়েছে?”
আনিকার অভিনয়ে এতটুকু খুঁত নেই। মিথুন বুঝল, এতদিনে একজন বন্ধু পেয়েছে সে, যাকে নিজের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা বলা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৩২