কৃত্রিম অভিকর্ষ বল ব্যাবহার করে, মহাকাশ স্টেশনের দেয়ালে হেলান দিয়ে হাই তুলল কিরান। হাই তোলার সময় মুখের সামনে হাত নিয়ে এলো। তারপর খাঁচায় বসে থাকা কিম্ভূত চেহারার প্রাণীটার চোখের সামনে থাকা হলোগ্রাফিক পর্দায় একটি বহুভুজের ছবি ফুটিয়ে তুলল। প্রাণীটা দেখতে ক্যাঙারুর মতো, উবু হয়ে চেয়ারে বসে আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল বহুভুজের দিকে, কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কিরান বিরক্ত হয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা নাদুস নুদুস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল-
“শালার বসে বসে এই সব ইয়ের কাজ করতে আর কয়দিন ভালো লাগে বলো তো সোয়া! পৃথিবীর আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর আগে এই সব ভীনগ্রহবাসী প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার কি দরকার আছে?”
সোয়ার চেহারা বেশ সুন্দর, কিন্তু হাসলেই কেমন বিচ্ছিরি দেখায়। তার বিচ্ছিরি হাসিটা দিয়ে সে বলল-“দরকার আছে কিরান। এই সব প্রাণীদের যদি বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা না করে পাঠাই, তাহলে কি করে বুঝব এরা মানুষের জন্য বিপজ্জনক কি না! যদি এরা মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান হয়, তাহলে এদের পৃথিবীতে পাঠানোটা ঝুঁকিপূর্ণ!”
“তাহলে পৃথিবীতে না পাঠালেই হয়, কি দায় পড়েছে আমাদের যে নুভিডা গ্রহের এলিয়েনদের বিপদে সাহায্য করব?”
“নুভিডা গ্রহের মহামারীতে ওখানকার বেশিরভাগ প্রাণীই মারা গেছে, যে ক’টা বাকী আছে তাদের না বাঁচালে মহাজাগতিক জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে।”
“সে সব ঠিক আছে, কিন্তু এই বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার বিষয়টা আমি বুঝি না। সিডমার’স টেস্ট করে এদের বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে কতটা নিশ্চিত হওয়া যায়?”
“একশো ভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। সিডমার’স টেস্টের ১১ টি ধাপ আছে, প্রত্যেক ধাপ বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ করে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা সিডমার’স টেস্টে ৭, যদি এর চেয়ে বেশি স্কোর করা কোন নুভিডা গ্রহের প্রাণী পাওয়া যায়, সেটাকে পৃথিবীতে ঢুকতে দেয়া যাবে না!”
কিরান গাল চুলকে বলল, “এখানেই তো আমার খটকা। বিজ্ঞানী সিডমার নিজে একজন মানুষ, সিডমার’স টেস্টে মানুষের স্কোর যদি ৭ হয়, তাহলে ৮ থেকে ১১ পর্যন্ত ধাপগুলো সে কি করে বের করল। নিজের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তার স্কেল কি করে তৈরি করা সম্ভব?”
“সাতের উপরের ধাপগুলো আসলে অনুমান ভিত্তিক ধাপ। তবে এর আগের ধাপগুলো পরীক্ষিত। সিডমার’স টেস্টের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সম্পর্কে সব বিজ্ঞানীরা একমত।”
“কেন যেন আমি একমত হতে পারছি না। এই যে প্রাণীগুলোকে দেখছ, এখন পর্যন্ত নুভিডা গ্রহের ৩০০ প্রজাতির প্রাণীদের সিডমার’স টেস্ট করলাম, কারো স্কোরই দুইয়ের উপরে উঠল না। এদের সবার বুদ্ধিমত্তা কি এতই কম?”
“সিডমার’স টেস্ট তো তাই বলছে। তবে এতে ভালোই হলো আমাদের জন্য। বাকী ধাপগুলো পরীক্ষা করতে হচ্ছে না, সময় বেঁচে যাচ্ছে।”
কিরান অনিশ্চিত ভাবে মাথা নাড়ল কি মনে করে। সেদিন সারাদিন কাজ করে তারা আরও ৫৫ টা নুভিডা-প্রাণীকে পৃথিবীর আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাল। কারোর বুদ্ধিমত্তা স্কোরই ২ এর উপরে উঠল না।
রাতে (পৃথিবীতে বিজ্ঞান একাডেমীর সময় অনুযায়ী মহাকাশের রাত) কেমন একটা খঁচখঁচানী নিয়ে ঘুমোতে গেল কিরান। ঘুম আসল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ঘুমোতে চাইল সে। তারপর হঠাৎ করেই উঠে বসল ধরফর করে। দৌড়ে চলে গেল সোয়ার রুমে। সোয়া তখন গভীর ঘুমে। তার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিল কিরান। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “সোয়া, সোয়া, উঠে পড়ো!”
সোয়া বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল-“কি হয়েছে কিরান?”
“ওঠো, উঠে পড়ো। সিডমার’স টেস্ট ভুল! আমরা ভয়াবহ বিপদে ফেলেছি পৃথিবীকে!!”
“কি? ঘটনা কি?”
“আমার সাথে এসো।”
সোয়ার হাত ধরে টেনে নুভিডা গ্রহের অবশিষ্ট দু’টো প্রজাতির প্রাণীদের খাঁচার সামনে নিয়ে এলো কিরান। “সোয়া, এদের সিডমার’স টেস্ট নাও।”
“কেন? কি হয়েছে বলো তো?”
“আগে নাও না। ভয়াবহ বিপদ সামনে!”
সোয়া কথা না বাড়িয়ে একটা খাঁচার সামনে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন অন করে প্রথম ধাপের সিডমার’স টেস্ট পরীক্ষা করল।
রেজাল্ট-পজিটিভ।
এবার সোয়া দ্বিতীয় ধাপের টেস্ট করল। রেজাল্ট-পজিটিভ!
তৃতীয় ধাপের টেস্ট-নেগেটিভ! স্বস্তির হাসি হাসল সোয়া। কিরানের দিকে তাকিয়ে বলল-“তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল মহাবুদ্ধিমান প্রাণী পেয়েছ বুঝি। অথচ দেখো, এই সামান্য দুই ধাপের উপরেই উঠতে পারছে না প্রাণীগুলো।”
কিরানের চোখে কেমন আতঙ্ক! সে কাঁপা গলায় বলল-“চার নম্বর ধাপ করো সোয়া।”
“কেন? তার কি দরকার? এটা তিন নম্বর ধাপই তো পেরোতে পারল না।”
“তবুও, পরের ধাপগুলো করো।”
“ঠিক আছে।“
চার নম্বর ধাপ-নেগেটিভ।
পাঁচ নম্বর ধাপ-নেগেটিভ।
ছয় নম্বর ধাপ-নেগেটিভ।
সাত নম্বর ধাপ-নেগেটিভ।
আট নম্বর ধাপ-নেগেটিভ।
নয় নম্বর ধাপ-পজেটিভ!
“হোয়াট? পজেটিভ হলো কি করে?” সোয়া চেঁচিয়ে উঠল।
দশ নম্বর ধাপ-পজেটিভ!!
“মাই গড, এটা কি করে হলো কিরান!”
“খুব সহজ সোয়া, অতি বুদ্ধিমান প্রাণীর পক্ষে অতিরিক্ত সহজ কাজগুলো করা অসম্ভব। এত বুদ্ধিমান প্রাণীকে আমরা পৃথিবীতে পাঠিয়েছি, পৃথিবীর অনেক বিপদ সোয়া!”
সোয়া ভয়ার্ত চোখে কমিউনিকেশন মডিউলটির দিকে চেয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে সেখানে সবুজ আলোটা জ্বলছে না। তার মানে পৃথিবী হতে কোন সংকেত আসছে না অনেকক্ষণ থেকে।
কিরান আর সোয়া নিস্পলক চেয়ে থাকল একে অপরের দিকে। তাদের চোখে নির্জলা আতঙ্ক!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৮