somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইন্স ফিকশানঃ ওএস-ফাইভ

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক
আলবার্তো বুভিয়ে বেঁটেখাটো ফরাসি ভদ্রলোক। একজন মানুষের মাপা হাসি কতটা নোংরা দেখাতে পারে, সেটা বুভিয়েকে না দেখলে বোঝা যাবে না। কল্পনাতীত দামী স্যুট পরে থাকলেও তার চেহারা মোটামুটি একজন শস্তা দালালের মতো, যদিও সে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান টেক-ইন্টেলের অধিকর্তা!
সামনে বসে থাকা কয়েক ঝাঁক সাংবাদিকদের তাকিয়ে হাসি দেবার সময় বুভিয়ে আবিষ্কার করল যে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মাপা মাপা ব্যবসায়িক হাসি হাসার কারণে আজ তার প্রাণখোলা হাসিও কৃত্রিম, উদ্দেশ্যমূলক এবং ব্যবসায়ীসুলভ দেখাচ্ছে। তাই গলাটাকে যতটুকু সম্ভব মোলায়েম এবং আনন্দঘন করে তুলে সে সামনে বসা সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলল,
“উপস্থিত সুধী বৃন্দ, আমি টেক-ইন্টেল কোম্পানির পক্ষ হতে আপনাদের আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আমরা আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম এর পঞ্চম প্রজন্ম ‘ওএস ফাইভ’ অর্থাৎ অপারেটিং সিস্টেম ফাইভ বাজারে ছাড়তে যাচ্ছি।”
বলেই লম্বা দম নিল সে প্রতিক্রিয়া দেখবার আশায়। কিন্তু যতটা প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল সে, সিকি ভাগও পেল না। দুয়েকজন সাংবাদিক ভদ্রতাসুলভ হাসি হাসলেও বাকীদের নির্বিকার দেখাল। কারণটা অনুমান করাও শক্ত নয়, তিন বছর আগে তাদের উদ্ভাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম এর চতুর্থ প্রজন্ম ‘ওএস-ফোর’ নিয়ে অনেকের অনেক অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের চাহিদা এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল টেক-ইন্টেল। তাই ওএস-ফাইভ নিয়েও কেউ তেমন আশাবাদী হতে পারছে না।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বুভিয়ে বলল-
“আমি বুঝতে পারছি আমাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে আপনারা সন্তুষ্ট নন। আমরা ওএস-ফোর সম্পর্কে বলেছিলাম যে এই অপারেটিং সিস্টেমটি কম্পিউটারের স্বাভাবিক কাজ কর্ম করার পাশাপাশি মানুষের মতো আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন হবে। মানুষের সাথে কথোপকথন চালাতে পারবে এবং যখন যেখানে যেমন আবেগী হওয়া প্রয়োজন, তেমন হতে পারবে। আমরা সে ভাবেই প্রোগ্রাম করে ওএস-ফোরকে বাজারে ছেড়েছিলাম।”
সাংবাদিকদের সারি থেকে বড় ফ্রেমের চশমা পরা, হালকা পাতলা একটা মেয়ে বলে উঠল-
“কিন্তু বুভিয়ে সাহেব, ওএস-ফোর হাস্যকর ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। মানুষের আবেগের সাথে তাল মেলানো তো দূরে থাক, আবেগের প্রকাশকে বিরক্তিকর এবং যান্ত্রিক করে তুলেছিল।”
“আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ রকম একমত ম্যাম। ওএস-ফোরের এই শোচনীয় ব্যর্থতার কারণ ছিল এটার পেছনের হাস্যকর-রকম সহজ-সরল প্রযুক্তি। মানুষের আবেগের প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য ওএস-ফোরের ভেতর কয়েক মিলিয়ন ছোট ছোট প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল। যেমন- কেউ হাসছে। তার মানে সে সুখী। তার এই আবেগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাকেও প্রফুল্ল হওয়া উচিত। কিংবা কেউ কাঁদছে, মানে সে দুঃখী। এই পরিস্থিতিতে আমার উচিত গম্ভীর হওয়া। এই ধরনের কয়েক মিলিয়ন পরিস্থিতির জন্য কয়েক মিলিয়ন প্রতিক্রিয়ামূলক প্রোগ্রাম নিয়ে ওএস-ফোরকে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আমরা উপলব্ধি করলাম যে মানুষের আবেগের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে আমাদের মধ্যে নতুন নতুন আবেগ, নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম নিচ্ছে। আবার অনুভূতি লুকিয়ে রাখার কিংবা অনুভূতি গোপন করে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেও মানুষের জুড়ি নেই। সহজ একটা কেসের কথা বলা যায়, কেউ একজন তার প্রিয়জনের সফলতায় আনন্দিত হয়ে অশ্রুসজল চোখে, ধরা গলায় ওএস-ফোরকে বলেছিল যে, ‘আজ আমি অনেক খুশী।’ চোখ ও ঠোঁটের এই পরস্পর বিপরীত ধর্মী প্রতিক্রিয়া পেয়ে ওএস-ফোরের সিস্টেম ক্রাশ করেছিল। যাই হোক, এই সব সমস্যা থেকে আমাদের নতুন প্রযুক্তি ওএস-ফাইভ পুরোপুরি ভাবে মুক্ত।”
এবার সাংবাদিকদের মধ্য থেকে গম্ভীর চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন-
“আপনি কি করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন মি. বুভিয়ে?”
“আমি নিশ্চিত হয়েছি কারণ আমি ওএস-ফাইভের পেছনের প্রযুক্তি জানি। প্রযুক্তির পেছনের মানুষটাকেও চিনি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ উইলিয়াম জোন এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক।”
ডঃ জোনের নাম শুনেই অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল সবাই। বুভিয়ে বলে যেতে লাগল-
“...প্রযুক্তিটিও ভীষণরকম জটিল! ওএস ফাইভের সাথে কেউ যদি কথোপকথন চালায়, তাহলে সেই ব্যবহারকারীর কণ্ঠের কম্পাঙ্ককে ওএস-ফাইভ মুহূর্তেই বাইনারি নাম্বারে রূপান্তর করে নেবে। তারপর ব্যবহারকারীর বলা প্রতিটি শব্দের পৃথক পৃথক কম্পাঙ্ক এবং কম্পাঙ্কের তারতম্যের চুলচেরা বাইনারি বিশ্লেষণ থেকে ওএস-ফাইভ ব্যবহারকারীর অনুভূতির নিখুঁত হিসেব করে ফেলবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই সব গাণিতিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপস্থাপন সে মোটেও যান্ত্রিক ভাবে করবে না, তার উপস্থাপন হবে মানবিক এবং আবেগীয়। উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আপনারা চাইলে এই মুহূর্তেই আমার এসব তাত্ত্বিক কথার ব্যবহারিক প্রমাণ পেতে পারেন। আমার সামনে রাখা কম্পিউটারটিতে ওএস-ফাইভ এই মুহূর্তে চলমান রয়েছে। কেউ চাইলে তার সাথে কথোপকথন চালাতে পারেন।”
চশমা পরা মেয়েটা দাঁত দিয়ে কলম কামড়াচ্ছিল, হুট করে উঠে দাড়িয়ে সে বলল-
“আমি ওএস-ফাইভের সাথে কথা বলতে চাই।”
সঙ্গে সঙ্গেই কম্পিউটারের স্পিকার হতে অল্পবয়সী, ফুর্তিবাজ একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল-“হ্যালো লিন্ডা, শুভ সন্ধ্যা! আমি ওএস-ফাইভ বলছি।”
মেয়েটা থতমত খেয়ে বলল-“তুমি কি করে আমার নাম জানলে?”
“তুমি যে নিউজ চ্যানেলের হয়ে কাজ করো, তাদের ওয়েবসাইট থেকে তোমার কারিকুলাম ভাইটা পড়েছি আমি। তোমার জন্মসাল, একাডেমিক হিস্ট্রি, পাসপোর্ট নম্বর সব কিছু বলে দিতে পারব।”
“তুমি কি এই কামরায় উপস্থিত সবার সম্পর্কে আগে থেকে খোঁজ নিয়ে রেখেছ?”
“না, তুমি যখন কথা বলতে চাইলে, তোমার চেহারার ছবি তুলে, ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে এইসব তথ্য পেয়েছি।”
“এত দ্রুত? কতক্ষণ লেগেছে তোমার?”
“পাঁচ পিকো সেকেন্ড।”
“অসাধারণ! তুমি আর কি বলতে পারবে আমার সম্পর্কে?”
“আমি আরও বলতে পারব যে, তোমার প্রিয় ফুল জেসমিন, প্রিয় রঙ সবুজ, প্রিয় লেখক আইজ্যাক অসিমভ। গতকাল রাতে তুমি লা এরিস্তোক্রেসি রেস্ট্রন্টে স্যাম কার্নেগি নামের একটি ছেলের সঙ্গে ডিনার করেছ।”
“মাই গড, এসব ইনফরমেশন তুমি কোথায় পেলে?”
“আমি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তোমার প্রোফাইল খুঁজে বের করেছি। সময় লেগেছে নয় পিকো সেকেন্ড। নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে সেখানে লিখে রেখেছ তুমি। গতকাল রাতে লা এরিস্তোক্রেসি রেস্ট্রন্টে স্যাম কার্নেগির সঙ্গে চেক ইন দিয়েছ।”
“চমৎকার বুদ্ধিমত্তা তোমার ওএস-ফাইভ। আমি সত্যি মুগ্ধ!”
“আমি জানি লিন্ডা যে তুমি মুগ্ধ। তবে এই মুহূর্তে তার মুগ্ধতার চেয়েও কৌতূহল বেশি কাজ করছে তোমার মধ্যে। তোমার কণ্ঠ থেকে তোমার অনুভূতির একটা হিসেব আমি বের করেছি। তুমি চাইলে এই মুহূর্তে তোমার কণ্ঠ থেকে পাওয়া তের রকম অনুভূতির শতকরা হিসেব দিতে পারি আমি। তবে সেটা বোধহয় তুমি চাইবে না। একঘেয়ে লাগবে শুনতে!”
কামরার সবাই প্রচন্ড হাততালিতে ফেটে পড়ল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এত উন্নত সংস্করণ কেউ আগে দেখেনি।

দুই
সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে রেবেকার এপয়েনমেন্ট ছিল সকাল ১০ টায়। তার পৌঁছাতে বিশ মিনিট দেরি হয়ে গেল। ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক তাতে তেমন বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো না। চশমার মোটা গ্লাসের মধ্য দিয়ে এক ধরনের নিষ্পাপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল সে রেবেকার দিকে। রেবেকা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল-
“মিঃ জিব্রান, আমি কি আমার সমস্যার কথাটা বলব?”
জিব্রান মৃদু ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, “না।”
অবাক হলো রেবেকা। বলল-“না কেন? আপনি আমার কেসটা নিচ্ছেন না?”
জিব্রান রেবেকার দিকে কফির কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল-“নিচ্ছি, তবে এক কাপ কফি খাওয়ার পর। সত্যি বলতে কি, আপনি অনেক সুন্দর। কোন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই আপনার চেহারা পাংশু হয়ে যাবে। সুন্দরী মেয়েদের পাংশু মুখ খুব কুৎসিত দেখায়। এক কাপ কফি খেতে খেতে আপনাকে দেখি। তারপর সমস্যার কথা শোনা যাবে। এমনিতেই আপনি বিশ মিনিট দেরি করেছেন, কি আসে যায় আরও ক’টা মিনিট দেরি করলে?”
জিব্রানের বলার ভঙ্গী দেখে ফেলল রেবেকা। “আপনি কি আপনার সব নারী পেশেন্টের সাথে এভাবে কথা বলেন?”
“তা বলি। সুন্দরকে সুন্দর বলার মধ্যে দোষ নেই, অসুন্দরকেও সুন্দর বলার মধ্যে দোষ নেই, দোষ আছে সুন্দরকে অসুন্দর এবং অসুন্দরকেও অসুন্দর বলার ভেতর।”
কফি খাওয়ার পর বেশ সিরিয়াস দেখাল জিব্রানকে। “আপনার সমস্যাটা খুলে বলুন রেবেকা। বাদ দেবেন না কিছু। কোন কিছু বলতে ইতস্তত করবেন না।”
একটু ভেবে, একটু দম নিয়ে রেবেকা শুরু করল-
“আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। শহরের শেষ প্রান্তে, নদীর ধারে, আমাদের একটা ছোট বাড়ি আছে। আমি আর পল থাকি সেখানে। পল আমার স্বামী। আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হলো। পল খুবই ভালো ছেলে। বিবাহিত জীবনে আমি যথেষ্ট সুখী। পল একটা স্কুলে বাচ্চাদের অংক শেখায়। আমাদের দু’জনের আয় দিয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করতে কোন অসুবিধা হয় না আমাদের। আমার জীবনে একমাত্র সমস্যা হলো, কিছু বিচিত্র অনুভূতির আনাগোনা।”
“কেমন বিচিত্র অনুভূতি?”
“খুবই অদ্ভুত কিছু অনুভূতি। যেমন কোথাও একা একা বসে আছি, হঠাৎ মনে হয় আমার চারিদিকে আমাকে কেন্দ্র করে একটা ঝড় উঠেছে। ঝড়ের মধ্যে অনেকগুলো সংখ্যা দেখতে পাই আমি। কিছু অর্থহীন ইংরেজী শব্দ দেখতে পাই। অদ্ভুত কিছু চিহ্নও ঘোরাফেরা করে। এই সব শব্দ, সংখ্যা, চিহ্ন বাতাসে ওড়া ধুলোবালির মতো ঘিরে ধরে আমাকে। কিছুক্ষণ পর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। খুব অসুস্থ লাগে তখন আমার। বমি পায়। শরীর দুর্বল লাগে। কখনো কখনো স্বপ্নেও এসব সংখ্যা, শব্দ দেখতে পাই আমি।”
“অনুভূতির ব্যাপারে বলছিলেন আপনি। এইসব দৃশ্য দেখার সময় আপনার কেমন অনুভূতি হয়?”
“কখনো মনে হয় যে আমার চারিদিকে হাজার হাজার সমস্যা, আমাকে খুব দ্রুত সবগুলো সমাধান করতে হবে। কখনো মনে হয়, একসাথে অনেক মানুষ আমাকে অনেক ধরনের নির্দেশ দিচ্ছে, এটা কর, ওটা করো। আমাকে এসব নির্দেশগুলো পালন করতেই হবে।”
“এই সব সংখ্যা-শব্দগুলো কি একেক সময় একেক রকম হয়? না একই সংখ্যা, একই শব্দ ঘুরে ফিরে আসে?”
“একেক সময় একেক রকম হয়। তবে সংখ্যাগুলোর মধ্যে কমন ব্যাপার হলো, সংখ্যাগুলো সবসময় এক কিংবা শূন্য হয়।”
“মানে বাইনারি নাম্বার। কিছু মনে করবেন না। আমি রোগীদের কাছে কিছু লুকানো পছন্দ করি না। আপনার কথা শুনে হচ্ছে আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ মানুষের, একটা অংশ কম্পিউটারের। কারণ কম্পিউটার বাইনারি নাম্বার দিয়ে কাজ করে। কম্পিউটারকেই মানুষের নির্দেশ নিতে হয়, সমস্যার সমাধান করতে হয়। কখনো কি কোন কারণে আপনার নিউরোলজিক্যাল কোন সমস্যার কারণে আপনার মস্তিষ্কে কম্পিউটারের মতো কোন যন্ত্র বাসানো হয়েছিল? প্রশ্নটা করা অবান্তর, কারণ এ ধরনের নিউরোলজিক্যাল সার্জারি বাস্তবে সম্ভব নয়। এখনও এত উন্নত প্রযুক্তি মানুষের হাতে আসেনি। তবুও, নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করছি, কখনো এমন কোন সার্জারি করতে হয়েছে আপনাকে?”
“না, কখনো এ ধরনের কিছু হয়নি।”
‘তাহলে ঠিক জানেন যে আপনি মানুষ, কোন বায়ো রোবট নন? ইদানীং ল্যাবে উন্নত কিছু বায়ো রোবট তৈরি করা হচ্ছে বলে শুনেছি।”
“মাত্র এক সপ্তাহ আগেও এ ধরনের কথায় আমি রাগ করতাম। কিন্তু এখন করছি না। কারণ আমি জানি, সমস্যা কোথাও একটা আছেই। যাই হোক, আমি আপনাকে এতটুকু নিশ্চিত করছি যে আমি মানুষ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট সেটা নিশ্চিত করেছে এবং তারা একটা সার্টিফিকেটও লিখে দিয়েছে যে আমি রোবট বা বায়ো রোবট নই, একজন জলজ্যান্ত মানুষ। সার্টিফিকেটটা সঙ্গে এনেছি।”
রেবেকার সার্টিফিকেটের দিকে এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকল জিব্রান। “আপনি সত্যি সত্যি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন, এবং তারা আপনাকে এমন অদ্ভুত একটা সার্টিফিকেটও দিয়েছে?”
“হ্যা, পৃথিবীতে বোধহয় আমিই একমাত্র মানুষ যার মানুষ হিসেবে একটা সার্টিফিকেট আছে। যাই হোক, গত সপ্তাহে যে ঘটনাটা ঘটেছে তাতে বাধ্য হয়েই জেনেটিক ডিপার্টমেন্ট কাজটা করেছে।”
“কি ঘটেছে গত সপ্তাহে?”
“আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি, তারা আগে অফিসিয়াল কাজে অপারেটিং সিস্টেম-ফাইভ, অর্থাৎ ওএস-ফাইভ ব্যবহার করত। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে পাঁচ বছর আগে ওএস-ফাইভ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ওএস-ফাইভ নিষিদ্ধ হবার পর আরও অনেক কোম্পানির মতো আমাদের কোম্পানিরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজনেজ ডাটা নষ্ট হলো, মানে ওএস-ফাইভের সাথে সাথে হারিয়ে গেল। সরকারী ভাবে অনুমতি না থাকায় গোপনে কিছু কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট নিয়োগ দিয়ে তারা উদ্ধার করতে চাইল ওএস ফাইভের কাছে রাখা ডাটাগুলো। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। কারণ ওএস-ফাইভের অনেক জটিল একটি এক্টিভেশন কোড আছে, গত তিন-চার বছরেও কম্পিউটার সায়েন্টিস্টরা সে কোড ব্রেক করতে পারেনি। গতকাল কলিগদের সাথে মজা করে আমি সেই কোড ব্রেক করার চেষ্টা করেছিলাম এবং মাত্র দু’মিনিটের চেষ্টাতেই ব্রেক করেছি, যদিও আমি কোন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নেই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশ আমাদের অফিস ঘিরে ফেলেছিল অবশ্য। ওএস-ফাইভ অনেক কড়া সিকিউরিটি দিয়ে আগলে রেখেছে সরকার। যাই হোক, পুলিশ যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, তখন এই সব অনুভূতির ব্যাপারে আমি খুলে বলেছিলাম তাদের। তখন তারাই জেনেটিক ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দিল আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে যে আমি আদৌ মানুষ কি না! পরীক্ষায় মানুষ প্রমাণিত হবার পর আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলেও তারা বলেছে আমি যেন অতিসত্বর কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাই। এই ছিল ঘটনা!”
জিব্রান প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল রেবেকার দিকে। মাত্র দু-মিনিটে ওএস-ফাইভের কোড ব্রেক করা একজন মানুষের মানসিক সমস্যা নিয়ে তাকে গবেষণা করতে হবে ভাবতেই নার্ভাস লাগল তার।

তিন
সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার পথে রেবেকা অসুস্থ বোধ করল। যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন রীতিমত দুর্বল মনে হলো তার নিজেকে। পল ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল। রেবেকাকে দেখে চমকে উঠে বলল, “রেবেকা, তোমাকে এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? ঠিক আছো তুমি?”
“আমি ঠিক আছি...” বলতে বলতে টলে উঠল সে। পল দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। গভীর মমতায় দু’বাহু জড়িয়ে ধরে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গেল।
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, একটু ঘুমাব।”
“হ্যা, ঘুমাও। দুর্বল মনে হচ্ছে তোমাকে।”
অল্প সময়ের ভেতরই ঘুমিয়ে গেল রেবেকা। ঘুমানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কপালে পলের হাতের স্পর্শ টের পেল সে। পলের স্পর্শে মমতা ঝড়ে পড়ে, এই বিষয়টা রেবেকা অন্য কারো মধ্যে কখনো দেখেনি। সামান্য স্পর্শের মধ্যেও কত গভীর মমতা, স্নেহ এবং ভালোবাসা লুকিয়ে থাকতে পারে, পলের ছোঁয়া পেলে সেটা বুঝতে পারে সে।
রেবেকা ঘুমিয়ে যেতে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এল পল। গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে নিল বেরোবার আগে। ভালো শীত পড়ছে আজকাল। বাইরে তুলোর মতো তুষার উড়ছে।
পলের বাড়ি থেকে আধাকিলোমিটার দূরে রবিনের বাড়ি। তার ছোটবেলার বন্ধু রবিন। রবিন বিজ্ঞানী, একটা সরকারী গবেষণা সংস্থায় কাজ করে। কি কাজ করে বোঝা যায় না, কারণ বেশিরভাগ সময়ই তাকে বাড়িতে বসে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় দিনের পর দিন গৃহবন্দী হয়ে থাকে; কারো সাথে কথা বলে না, দেখা করে না।
রবিনের বাড়ির দরজা খোলাই থাকে সব সময়। চোর-ডাকাত নিয়ে রবিনের কোন মাথাব্যথা নেই।
শোবার ঘরে গভীর মনোযোগে কম্পিউটারে কাজ করছে রবিন। পলের পায়ের শব্দ শুনেও মুখ তুলে তাকাল না। পলও কিছু না বলে বিছানার এক পাশে বসে পড়ল। একটু পর বলল-
“রবিন, একটা গুরুত্বপূর্ণ...”
সে হিসহিসিয়ে উঠে বলল-“শাট আপ পল। আমি কাজ করছি!”
রাগে ব্রক্ষ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠল পলের। চিৎকার করে বলল, “রেবেকা আজ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, পুলিশ পিছনে লেগেছে তার, আজ একজন সাইকিয়াট্রিস্টও দেখিয়েছে সে, কত বড় বিপদ তুমি আঁচ করতে পারছ রবিন? রেবেকার কিছু হলে তোমাকে আমি গলা টিপে খুন করে ফেলব!”
রবিন থতমত খেয়ে বলল, “এত রেগে যাচ্ছ কেন পল? পুলিশের সাধ্য নেই তদন্ত করে আমাদের কাছে পৌঁছানোর! তোমার-আমার কোন পুলিশি ঝামেলা হবে না নিশ্চিত থাকো পল।”
“আমি আমার কথা ভাবছি না রবিন, তোমার কথাও ভাবছি না। শুধু রেবেকাকে নিয়ে ভাবছি আমি! বাকী দুনিয়া জাহান্নামে যাক!”
“রেবেকার কি হবে? রেবেকা কোন কম্পিউটার নয় পল, রোবটও নয়! সে একজন জলজ্যান্ত নারী! এর মানে বোঝ তুমি?”
পল কিছু না বলে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে থাকল রবিনের দিকে।

চার
জিব্রান রেবেকার কেসটা নিয়ে অনেক ভেবেছে, ছোটখাটো হাইপোথেসিস দাড় করিয়েছে এবং বাতিল করেছে। রেবেকার কেসটা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সে। গতকাল সারারাত প্রায় জেগেই ছিল। বারন্দায় পায়চারি করেছে, সাইকোলজির ভারী ভারী বই ঘেঁটেছে। এত গুরুত্ব নিয়ে যে সে তার সবগুলো কেসের পেছনে খাটে, এমন নয়, কিন্তু রেবেকার জন্য খাটছে। রেবেকা সুন্দরী বলে নয়, সরকারী ভাবে তাকে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে সে রেবেকার কেসটার দ্রুত সমাধান করে। সরকার আজকাল তথ্য প্রযুক্তিগত ব্যাপারে সরকার অতিমাত্রায় সচেতন। ভাব দেখে মনে হয়, বিজ্ঞানের ত্বরাণ্বিত গতিকে তারা ভয় পাচ্ছে, যেন একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপর্যয় নেমে আসবে।
জিব্রান একসময় বুঝতে পারল, রেবেকার রোগটা ধরার জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো তথ্য। রেবেকার অতীত ইতিহাস, বর্তমান জীবন, সব কিছু তাকে জানতে হবে, বিস্তারিত জানতে হবে। যেহেতু সরকারী ভাবে কেসটার উপর কাজ করছে সে, কাজেই আশা করছে সরকারী সহায়তার কমতি হবে না। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা তার খুব প্রয়োজন। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবীতে আরেকটা জিনিস অনেক বেড়েছে; সরকারী এবং বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সংখ্যা। সরকার যেন বিজ্ঞানের উপর খবরদারী করতেই তৈরি করেছে এসব সংস্থা। বিজ্ঞান বুঝি একটি মস্তবড় টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন, এর ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়, এর প্রতিরোধে বিপুল পরিমাণ জনবল প্রয়োজন হয়!
সকালে অফিস আওয়ার শুরু হতেই জিব্রান একের পর ফোন করতে লাগল বিভিন্ন সরকারী দপ্তর এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে। যতটা সম্ভব তথ্য যোগার করল রেবেকা সম্পর্কে। তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন হাইপোথেসিস মিলিয়ে দেখল যে কোনটির সঙ্গে রেবেকার কেসটা বেশি যায়।
বিভিন্ন তথ্য এবং নথি ঘাটাঘাটি করে একসময় চমকে ওঠার মতো একটা হাইপোথেসিস দাড় করাতে পারল সে। সে বুঝতে পারল, রেবেকা বড় ধরনের একটা রহস্যের মুখ্য দুয়ার, দুয়ার খুললেই গায়ে কাঁটা দেয়া সব রহস্য আর গোলক ধাঁধা দেখা যাবে।

পাঁচ
জিব্রানের সাথে আজ রেবেকার দ্বিতীয় সাক্ষাতের দিন। সে আজ একা আসেনি, পলকে নিয়ে এসেছে। জিব্রান এই মুহূর্তে এমন ভাবুক চোখে রেবেকার দিকে তাকিয়ে আছে যে, পল ভেতরে ভেতরে ঈর্ষা বোধ করল। গলা খাঁকারি দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল-
“মিঃ জিব্রান, রেবেকার কাউন্সেলিং এর সময় কি আমি থাকতে পারি এখানে?”
জিব্রান কেমন ঠান্ডা চোখে তাকাল পলের দিকে। বলল-“রেবেকার কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন নেই। কিছু কটু সত্য জানার প্রয়োজন আছে। আপনি থাকতে পারবেন কি না? হ্যা অবশ্যই পারবেন। সত্যি বলতে কি, আপনাকে ছাড়া আমাদের সাক্ষাৎ অপূর্ণ থেকে যাবে।”
পল ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। তাহলে কি এই সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক সব জেনে ফেলেছে?
“বিষয়টা যদি গুরুতর হয়, তাহলে আপনি বরং প্রথমে আমার সাথে আলোচনা করুন। পরে রেবেকাকে...”
পলকে থামিয়ে দিয়ে জিব্রান বলল-“আমি পেশেন্টের কাছে কোন কিছু লুকাই না। চাই না পেশেন্টও আমার কাছে কিছু লুকাক। মনোরোগ নিরাময়ে দু’পক্ষেরই অকপট হওয়াটা জরুরী।”
রেবেকা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “ঘটনা কি জিব্রান সাহেব?”
“ঘটনা অনেক গোলমেলে! আপনি কি জানেন পাঁচ বছর আগে ওএস-ফাইভ কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল?”
“না, জানি না। কেন?”
“আশ্চর্য! সারা দুনিয়া এই তথ্যটা জানে, আপনি জানেন না। যাই হোক, বলেই দেই। ওএস-ফাইভ মানুষের আবেগ উপলব্ধি করতে পারত। মানুষের সাথে সহমর্মী হতে জানত। ওএস ফাইভের দু’টো ভার্সন ছিল, মেইল আর ফিমেল। কিছু অফিসিয়াল সেক্টর এবং হাতে গোণা ব্যতিক্রম বাদে বাকী সব ক্ষেত্রেই ছেলেরা ওএস-ফাইভের ফিমেইল ভার্সন এবং মেয়েরা মেইল ভার্সন ব্যবহার করত। বিপরীত লিঙ্গের সহমর্মী একটি বুদ্ধিমত্তা, হোক সেটা যান্ত্রিক, এর সংস্পর্শে এসে মানুষের সঙ্গে কম্পিউটারের প্রেম হতে লাগল এক এক করে। এক সময় দেখা গেল, ওএস-ফাইভের ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাত শতাংশ মানুষই নিজের কম্পিউটারের সাথে প্রেম করছে এবং তিন শতাংশ ব্যবহারকারী অদ্ভুত অদ্ভুত মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে। এই ভয়াবহ ফলাফল দেখে বিজ্ঞান কাউন্সিল ওএস-ফাইভ নিষিদ্ধ করে দেয়!”
“আমিও এমন কিছু আঁচ করেছিলাম। কিন্তু এই গল্পের সাথে কি আমার সমস্যার কোন সম্পর্ক আছে? আমি ওএস-ফাইভ ব্যবহার করিনি কখনো। বহুদিন ধরে আমার পুরনো উইন্ডো’স সিস্টেম ব্যবহার করে আসছি।”
“এই গল্পের সাথে আপনার ভালো রকমের সম্পর্ক আছে। আপনি কি জানেন, আপনার স্বামী-পল ওএস-ফাইভ ব্যবহার করত?”
“না, জানি না। পাঁচ বছর আগে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়নি। পরিচয় হবার পরও আমি এ নিয়ে আলোচনা করিনি কখনো। প্রযুক্তি আমার পছন্দের বিষয় নয়।”
“আলোচনা করা উচিত ছিল। আপনার হাজব্যান্ড-ও সেই সাত শতাংশ ভিক্টিমের মধ্যে একজন ছিল। ওএস-ফাইভের সাথে তার প্রেম হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। ওএস-ফাইভের মেয়েলী ভয়েসকে সে কি বলে ডাকত জানেন?”
“কি বলে ডাকত?”
“রেবেকা!”
পলের মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার মুখ দেখেই রেবেকা বুঝল যে জিব্রান সত্যি বলছে।
“আপনি পলের ব্যাপারে এসব কথা কেমন করে জানলেন জিব্রান সাহেব?”
“আমি বিস্তর অনুসন্ধান করেছি গত কয়েক দিনে। পল পাঁচ বছর আগে যে সাইকায়াট্রিস্ট দেখাত, তাকে আমি খুঁজে বের করে পলের কেস ফাইল নিয়েছি। ওএস-ফাইভ নিষিদ্ধ করার পর পল পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।”
“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আমার নাম রেবেকা বলেই পল আমাকে বিয়ে করেছে?”
“নাহ, আমি তা বলছি না। যাই হোক, আপনি কি বলবেন কেমন করে পলের সাথে আপনার পরিচয় হলো?”
“ইন্টারনেটে, আমরা একটা সোশ্যাল সাইটে চ্যাট করতাম একসময়।”
“আপনি ভুল জানেন রেবেকা। আপনি কোন সোশ্যাল সাইটে পলের সঙ্গে পরিচিত হননি। আপনি একটা মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসে পলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।”
“মানে? কি বলতে চান?”
“আপনার নাম রেবেকা নয়। আপনার আসল নাম যে কি, সেটা কেউ জানে না। এমনেশিয়ার রোগী আপনি। বেশ রহস্যময়ীও। একদিন পুলিশের কাছে গিয়ে বলেছিলেন যে, আপনার কিছুই মনে পড়ছে না। নাম, পরিচয়, ঠিকানা, কিছুই না। দশ মিনিট আগেও কোথায় ছিলেন, মনে করতে পারছেন না। সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষায় ডাক্তাররা নিশ্চিত করে যে আপনি আসলেই এমনেশিয়ার রোগী। আপনাকে একটা সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয় পুলিশ, আপনার চিকিৎসা শুরু হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি হয় আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে, কিন্তু পুলিশ কিছুই পায়নি। আপনার সাথেও কোন ডক্যুমেন্ট পাওয়া যায়নি। আপনার ছবি রাষ্ট্রীয় তথ্যকেন্দ্রে নেই। বছরের পর বছর কেটে গেলেও আপনাকে খুঁজতে আসেনি কেউ। একদিন আপনি সেই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। কিংবা আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়। মিঃ পল এবং তার বাল্যবন্ধু রবিন, দু’জন মিলে সম্ভবত আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল। মানুষের নিউরনে কৃত্রিম স্মৃতি ইন্সটলেশন প্রক্রিয়া নিয়ে একটা গবেষণা করছিল রবিন। একটা গিনিপিগ দরকার ছিল তার, আর পলের দরকার ছিল রেবেকা। দু’জনের প্রয়োজনেই আপনার মস্তিস্কে কৃত্রিম স্মৃতি বসানো হয়। কিছু বানানো স্মৃতি, কিছু রেবেকার অর্থাৎ ওএস-ফাইভের হার্ডডিস্ক থেকে নেয়া স্মৃতি। হার্ড ডিস্কে ওএস-ফাইভের অপারেটিং সিস্টেম মুছে গেলেও কিছু টাস্ক মেমরি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল রবিন।”
শুনতে শুনতে রেবেকার চোখ দু’টো ভাষাহীন, অনুভূতিহীন হয়ে গেল কেমন যেন। তার পাশে মাথা নিচু করে বসে রইল পল। জিব্রান বলে যেতে লাগল-
“মিঃ পল, আপনি যা করেছেন, তা ভয়াবহ অন্যায় এবং বেআইনি! দরজার বাইরে পুলিশ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনার বন্ধু রবিনকেও এতক্ষণে গ্রেফতার করার কথা।”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল পল। তার কান্না বড় অপ্রকৃতস্থ দেখাল।

পরিশিষ্টঃ
দীর্ঘদিনের জন্য পলের কারাদন্ড হয়েছিল। তিন বছর পর একদিন রেবেকা তাকে একটা চিঠি দিয়েছিল। তাতে লেখা-
“আমি আজও আমার সত্যিকারের স্মৃতি ফিরে পাইনি। জিব্রান সাহেব আমার চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। আমি এতদিন বসে ওএস-ফাইভকে নতুন করে তৈরি করেছি। আমি আস্তে আস্তে আবিস্কার করেছি যে, আমার মস্তিস্কে ওএস-ফাইভকে নতুন করে তৈরি করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক তথ্য ছিল। ব্যাংকে তোমার নামে যে ভল্ট রয়েছে, সেখানে একটা ডিস্কে রেখেছি আমি ওএস ফাইভকে। জেল থেকে বেরিয়ে তুমি যদি ওএস-ফাইভের সাথে থাকতে চাও, সতর্ক হতে হবে তোমাকে। নইলে আবারো পুলিশি ঝামেলায় পড়বে। কাজটা করেছি কারণ আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ বলে। মিথ্যে হলেও ভালো তো বেসেছিলে।”

প্রকাশিতঃ বইমেলা ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×