somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীঃ জোম্বির ডায়েরি

১৭ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
বাইরে তুষার পড়ছিল। জানুয়ারিতে বেশ ঠান্ডা নামে এখানে। তাপমাত্রা মাইনাসের তিন ডিগ্রি নিচে। আমার গাড়িটা শহরের একটি জঙ্গলের পাশে পার্ক করা ছিল। জায়গাটা লোউজুমু পিকের কাছেই, হারবিন শহরে আসা ট্যুরিস্টরা মাঝে মাঝে এদিকে আসে বটে, তবে আজ বেশ নির্জন জায়গাটা।
আমি মিংলিনের নরম চুলে হাত বোলাচ্ছিলাম, ঠিক তখন ধূপ করে একটা শব্দ হলো গাড়ির জানালায়। মিংলিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল। আমি জানালার দিকে তাকালাম। সেদিকে তাকিয়েই হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল। একটি বীভৎস মুখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে কেমন হিংস্র দৃষ্টি। আঙ্গুলের নখগুলো বড় বড়। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো চোখের মণি। দৃষ্টি অতিরিক্ত রকম বিস্ফোরিত তার। অস্বাভাবিক রকম বড় হয়ে আছে চোখের মণিগুলো। জানালায় দু’টো থাবা দিয়েই সে রাস্তায় হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
আমি দরজা খুলে বাইরে বেরোতে চাইলাম, মিংলিন বাধা দিল। হাত চেপে ধরল আমার।
“বাইরে যেও না রিজভি, বিপদ হতে পারে।”
“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ছেলেটা অসুস্থ, সাহায্য করা উচিত।”
“পুলিশকে ফোন করো, তুমি যেও না!”
“তা তো করবই, কিন্তু ছেলেটাকে তো এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত নয়। অন্তত কোন হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া উচিত।”
আমি মিংলিনের ধরা হাতটা ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটা বেকায়দা ভাবে পড়ে আছে মাটিতে। চোখ দু’টো খোলা, যেন মৃত। আমি পালস দেখলাম ছেলেটার। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে হলো। তবে চোখ দু’টো এতটা বিস্ফোরিত কেন তার, বুঝতে পারলাম না। ভালো করে লক্ষ্য করলাম ছেলেটার চেহারা। লম্বা, জট বাঁধা চুল। গায়ে একটা পুরনো জ্যাকেট। চোখ দু’টোর অস্বাভাবিক দৃষ্টি বাদ দিলে আর দশটা চীনা তরুণের মতোই দেখাবে তাকে। চীনাদের চোখগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ছোট হয় আকারে। আর এই ছেলেটার চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বড়। বীভৎস দেখাচ্ছে সে জন্যই!
আমি ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ালাম। মিংলিন ততোক্ষণে ফোন করেছে পুলিশকে। কান থেকে সেলফোন নামিয়ে আমার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল সে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মিংলিনের দৃষ্টি খুব তীব্র, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“পুলিশ কি বলল?”
“আসছে বলল। কাছেই একটা পুলিশ পেট্রোল টহল দিচ্ছিল, সেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। ৪-৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। আমাদের অনুরোধ করল ততোক্ষণ পর্যন্ত এখানে থাকতে।”
“আচ্ছা!”
“গাড়িতে উঠে বসো রিজভি, আমার কাছে জায়গাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না এখন।”
আসলেই, চারিদিকে তাকিয়ে আমারও সেটা মনে হলো। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। জঙ্গলটাও কাছেই। এই নির্জন জায়গায় কোন বিপদ-আপদ হলে কিছু করার থাকবে না। তবে ভরসার কথা, পুলিশ আসছে।
আমি গাড়িতে ঢুকে মিংলিনের হাতটা তুলে নিলাম হাতে। বললাম- “লং ড্রাইভটা মাটি হয়ে গেল! তোমার আমার ব্যস্ত শিডিউলে এত কষ্ট করে আজকের সময়টুকু বের করেছিলাম...”
“তোমারই দোষ! গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে পারতাম। কি দরকার ছিল এই ভূতটাকে সাহায্য করার?”
“একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে ফেলে রেখে যাই কি করে!”
“অসুস্থ! আমার তো মনে হলো একটা জোম্বি!! চোখগুলো দেখেছ?”
“হ্যা দেখেছি, ইক্সট্রিমলি ডায়ালেটেড পিউপিল! চোখের আকৃতি স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু অনেক বেশি প্রসারিত হয়ে গেছে কোন কারণে।”
“এমন কখনো দেখিনি আমি। কি কারণে হতে পারে?”
“সাইকোলজিক্যাল কারণে, যেমন ভয় টয় পেলে সাময়িক ভাবে এমন হতে পারে। তাও এত বেশি নয়। তাছাড়া ছেলেটার চোখগুলোকে সাময়িক ডায়ালেশনের শিকার বলে মনে হচ্ছে না। একটা রোগ আছে অবশ্য, মিডরিয়াসিস; চোখ অনেক বেশী প্রসারিত হয়ে যায় এই রোগ হলে। অক্সিটসিন হরমোনের কারণে এমন হয়ে থাকে সাধারণত। তবে সে ক্ষেত্রেও চোখগুলো এত বেশি বিস্ফোরিত হবে না!”
একটা গাড়ি এসে থামল সেই মুহূর্তে। পুলিশের গাড়ি। বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছে তারা। নিষ্ঠুর চেহারার দু’জন পুলিশ নামল গাড়ি থেকে। নেমেই হন হন করে এগিয়ে এলো আমাদের কাছে। আমি গাড়ির কাঁচ নামালাম। হাতের ইশারায় দেখালাম তাকে ছেলেটার অজ্ঞান দেহ। ঝুঁকে পরে তাকে দেখেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠল-“সর্বনাশ, এ কি চেহারা!”
পাশের পুলিশ ভদ্রলোক বলল-“স্যার, একে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত।”
“হ্যা, করতে হবে।”
আমাদের এক রকম শুকনো ধন্যবাদ দিয়েই ছেলেটাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল পুলিশ দু’জন। একটু অবাকই হলাম আমি তাদের আচরণ দেখে।
আমিও গাড়ি চালু করে চলে আসতে যাব তখনই লুকিং গ্লাসে একটা লালচে জিনিস দেখতে পেলাম রাস্তায়। নোটবুকের মতো অনেকটা। গাড়ি থেকে নেমে এলাম দ্রুত। মিংলিন বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার কি হলো?”
আমি নোটবুকের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বললাম- “এটা পুলিশের নোটবুক নয়, ঐ ছেলেটার। পুলিশের নোটবুক এমন নয়।”
“আর ঝামেলা বাড়িও না। চলে এসো।”
আমি নোটবুকটা নিয়ে চলে এলাম গাড়িতে। গাড়ি স্টার্ট দিলাম। যেতে লাগলাম দ্রুত। মিংলিনের বোধহয় মন খারাপ হলো। যেচে পরে সাহায্য করা পছন্দ করে না সে। কিন্তু কি করব, বাঙালি রক্ত বইছে আমার শরীরে। এত বছর ধরে চীনে থেকেও বাঙ্গালিপনা ছাড়তে পারলাম না।

দুই
রাত নেমেছে। ঠান্ডার প্রকোপ বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি লাল নোটবুকটি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। মিংলিন পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। কাল তার অফিস আছে সকাল সকাল, তাই আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতি জ্বালিয়ে রাখা বা নিভিয়ে দেয়া নিয়ে মিংলিনের কোন অভিযোগ নেই। আলো কিংবা অন্ধকারে তার ঘুমোতে কোন অসুবিধা হয় না। তাই আরাম করে শুয়ে শুয়ে পড়াশোনা করতে পারি আমি।
নোটবুকের পাতাগুলোতে অনেকগুলো এলোমেলো কথা লেখা। শুরুর দিকে হাতের লেখা কিছুটা পড়ার মতো হলেও যতই সামনের দিকে যাওয়া যায়, লেখা জড়িয়ে যায় ততোই । চীনা ভাষাটা খুব ভালোভাবে শিখেছি আমি এতদিনে। পড়তে, লিখতে, বুঝতে কোন অসুবিধাই হয় না। কিন্তু এই নোটবুকের লেখাগুলো দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে আমার কাছে।
প্রথম দিকের পাতাগুলোতে শুধু ঘুরে ফিরে একটা কথাই লেখা। কেউ তাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কোথায় যেন, কিন্তু সে যেতে চায় না। যেমন একটা জায়গায় লেখা-
আজ মরেই যেতাম। মৃত্যু নিশ্চিত ছিল আমার। হঠাৎই শুনলাম আমাকে মারবে না। বাঁচিয়ে রেখে কোন কাজে ব্যবহার করবে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইঞ্জেকশান থেকে বেঁচে গেলাম। কে এমন মহান ব্যক্তি যে আমাকে বাঁচাল? পরে একটা সন্দেহ দেখা দিল মনে। যেই আমাকে বাঁচাক, যে কারণেই আমাকে বাঁচানো হোক, তারও নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। সেটা তো মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ কিছু হতে পারে। পরে বুঝলাম আমার ধারণাই ঠিক।
এই জায়গাটা পড়ে আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। নোটবুকে লেখা ছেলেটা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছে, ইঞ্জেকশনের হাত থেকেও বেঁচেছে। এর একটাই মানে হতে পারে। ছেলেটা কয়েদী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। চীনে আগে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের গুলি করে মারা হতো। ২০১০ সালে সেটা নিষিদ্ধ করা হয়। এখন লিথাল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অপরাধীকে হত্যা করা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একজন কয়েদীকে কি কাজে সরকার বা সরকারী পক্ষের কেউ ব্যবহার করতে পারে? তাও আবার এমন কিছু যেটা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ?
আমি প্রশ্নগুলো মনের ভেতর চেপে রেখে নোটবুকের পাতা উল্টে গেলাম। পরের পাতায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা নেই। অস্পষ্ট খাপছাড়া সব কথা। যেমন-
খিদে লেগেছে, প্রচন্ড খিদে লেগেছে। কি খাওয়া যায়? মাটি? মাটির ভেতরের কেঁচো? কেঁচো খেয়ে খেয়ে আমি কেঁচো হয়ে গেলে কেমন হয়? পাতালে পাতালে মাটি খুড়ে ঘুরে বেড়াব!
কোথাও শুধু ‘খিদে’ আর ‘শিকার’ শব্দটা লেখা। কোথায় যে কি মানে এসবের কে জানে! শেষের দিকের কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু লেখা,
পালাব পালাব পালাব পালাব......
লেখাগুলো কত আগের বুঝতে পারছি না। তবে নোটবুকের পাতা যেমন জীর্ণ তাতে কয়েক মাস বা কয়েক বছর পুরনো হলেও অবাক হবো না।
আমি নোটবুকটা রেখে ল্যাপটপ টেনে নিলাম। আমি হারবিন ইন্সটিউট অফ টেকনোলজির প্রফেসর। কয়েক বছর আগে সরকারের সাথে ইউনিভার্সিটির হয়ে একটা প্রজেক্ট করেছিলাম। তখন কিছু সরকারী ওয়েবসাইটের এডমিন এক্সেস দেয়া হয়েছিল আমাকে। পুলিশ এবং ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের কিছু ওয়েবসাইটও ছিল তার মধ্যে। পাসওয়ার্ড না বদলালে এখনও আমি তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারব।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের লিস্ট এবং তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হয়েছে কখন এমন কোন তথ্য একটু বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় কি না খুঁজছিলাম আমি। পেলাম না। হয়তো আমাকে যে সব ওয়েবসাইটের এক্সেস দেয়া হয়েছে সেখানে এই তথ্যগুলো নেই। আরও কিছু ওয়েবসাইটে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলাম, যেগুলোতে আমার এক্সেস নেই। আমি হ্যাকিং জানি না। আমাকে পাসওয়ার্ড অনুমান করে ওয়েবসাইটে লগিন করতে হবে। কাজটা সহজ। সরকারী যে ক’টা ওয়েবসাইটের পাসওয়ার্ড আছে আমার কাছে, এগুলোর ভেতর একটি প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই। এক-দু’বারের চেষ্টাতেই আমি লগিন করে ফেললাম কিছু ওয়েবসাইটে। পেয়েও গেলাম কাঙ্ক্ষিত তালিকাটি। ছবি সহ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর নাম এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হবার সময় লেখা আছে সেখানে। কি কারণে মৃত্যুদন্ড পেয়েছিল সেটাও লেখা আছে।
যে ছেলেটাকে আমরা বাঁচিয়েছি তার নাম লি কিয়াং, ছবি মিলিয়ে দেখলাম। ছ’টা খুন করেছে সে। কিছু রাজনৈতিক অপরাধ এবং দুর্নীতির সাথেও তার নাম জড়িত। ২৪ বছর বয়স ছিল তাকে মৃত্যুদন্ড দেবার সময়। এত কম বয়সেই অপরাধের তালিকা বেশ বড় তার। তবে মজার ব্যাপার হলো, তার মৃত্যুদন্ডের সময়ও দেয়া আছে। চার বছর আগের একটা তারিখ। তার মানে পৃথিবীর চোখে সে মৃত। অথচ সে বেঁচে আছে। আমরা নিজের চোখে দেখেছি। পুলিশের আচরণও অদ্ভুত ছিল বেশ। তার মানে কি চীনা সরকার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের দিয়ে বিশেষ কোন কাজ করাচ্ছে? নাকি চীনা সরকারের বিনা অনুমতিতে সরকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি করছে কাজটা? যেহেতু লিমিটেড এক্সেস-সম্পন্ন ওয়েবসাইটে নকল মৃত্যুর তারিখ দেয়া হয়েছে, তাই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই উঁকি দিল মাথায়। কারণ সরকার নিজে কাজটা করলে নকল তারিখ দেখানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। আরও একটা ঘটনা হতে পারে, প্রভাবশালী কোন মাফিয়া তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে ক্ষমতাবলে। চীনে অনেক গোপন কিন্তু ক্ষমতাশালী জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী চক্রের কথা শোনা যায়। লি কিয়াংও হয়তো এমন কোন গোপন চক্রের সদস্য, কে জানে! এই রহস্য সমাধান করা আমার সাধ্য নয়। কাজেই বাঙালি কৌতূহল চেপে রাখলাম নিজের ভেতরেই।
কিছুক্ষণ পর আমি ল্যাপটপ রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পাশে মিংলিন হালকা নাক ডাকছে। আমার দিকে উল্টো ঘুরে শুয়েছে সে। মেয়েদের নাক ডাকার মধ্যে কোথায় যেন একটা অশোভন বিষয় আছে। তবে বিয়ের দু’বছর পর এখন আর খারাপ লাগে না আমার।
বাতি নিভিয়ে, একটা হাত আলতো করে মিংলিনের কোমরে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, ঠিক তখন দরজায় থাবা পড়ল। ঘন ঘন অস্থির থাবা। চোরের মনে পুলিশ পুলিশ। আমি ভয় পেলাম খানিকটা। হতে পারে পুলিশ এসেছে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে। একে তো সরকারী পর্যায়ের কিছু গোপন তথ্য জেনে ফেলেছি, তার উপর সরকারী ওয়েবসাইটে অনধিকার প্রবেশ করেছি। আমার আইপি এড্রেস ট্র্যাক করে ফেলা অসম্ভব নয়। আবার পুলিশ না হয়ে চীনা কোন গোপন সন্ত্রাসী চক্রও হতে পারে, যেটার সাথে লি কিয়াং জড়িত। তাদের সদস্য সম্পর্কে জেনে ফেলেছি দেখে আমাকে চুপ করাতে এসেছে।
মিংলিনও ধরমর করে উঠে বসেছে শব্দ শুনে! দু’জনেই কিছু না বলে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গেলাম। কি হোলে চোখ রাখতেই বুকটা ধক করে উঠল! পুলিশ নয়, সেনাবাহিনী এসেছে। সেনাবাহিনীর একজন অফিসার দরজায় অস্থির ভাবে থাবা দিচ্ছে। পেছনে দু’জন সৈনিক হাতে বন্দুক বাগিয়ে দাড়িয়ে আছে। অফিসারটি বাঁজখাই গলায় বলল-
“ড. রিজভি আহমেদ, অনুগ্রহ করে দরজাটা খুলুন।”

তিন
দরজা খুলতেই অফিসারটি অস্থির গলায় বলল-
“দ্রুত চলুন আমাদের সাথে। হারবিন শহরে বড় মাত্রার একটি ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। সবাইকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা।”
চারিদিকে তাকিয়ে অনেক মানুষের ছোটাছুটি দেখতে পেলাম আমি। সেনাবাহিনীর বড় বড় অসংখ্য ট্রাকও দেখতে পেলাম, যেগুলো মানুষ বোঝাই করে তাদের নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। আমাদের প্রতিবেশী ওয়াং জিন এবং লি জেইকেও দেখতে পেলাম ভীরের ভেতর। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু মহিলা বিলাপ শুরু করে দিয়েছে এর মধ্যে।
আমার সন্দেহ হলো। বললাম-“আমি যতদূর জানি, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করেনি, যার মাধ্যমে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া যায়।”
অফিসারটি অধৈর্য্য গলায় বলল, “জানতাম আপনার মতো কিছু মানুষ এই প্রশ্নগুলো করবে। এই ভিডিওটি দেখুন। আমাদের হাতে সময় খুব কম। যে কোন মুহূর্তে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যেতে পারে।”
আমি দেখলাম ভিডিওটা। প্রফেসর ঝাং ওয়েকে দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে। ঝাং ওয়ে চীনের সবচেয়ে খ্যাতিমান সিসমোলজিস্ট, মানে ভূমিকম্পবিদ। বহুদিন ধরে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে সে। কয়েক বছর আগে একবার ভূমিকম্পের ঠিক তিন মিনিট আগে সে সরকারকে জানিয়েছিল যে ভূমিকম্প হতে পারে, সেবার রিখটার স্কেলে সারে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সরকার তিন মিনিটে কোন পদক্ষেপ নিতে না পারলেও প্রফেসর ঝাং ওয়ের দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়েছিল। তাকে প্রায় ন্যাশনাল হিরো বানিয়ে দিয়েছিল মিডিয়াগুলো। তাই এখন তার কথার গ্রহণযোগ্যতা আছে সবার কাছে। ভিডিও ক্লিপটিতে ঝাং ওয়ে বলে যাচ্ছে-
“আমি প্রফেসর ঝাং ওয়ে বলছি। আমি প্রায় নিশ্চিত, আজ মাঝরাতের দিকে হারবিন শহরে কোন এক সময় বড় মাপের ভূমিকম্প হবে। সবাই এই ভিডিওটি দেখামাত্র সেনাবাহিনীর সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন।”
ভিডিও দেখা শেষ হতেই সেনাবাহিনীর অফিসারটি বলল-“আপনি টিভি অন করলে এই ভিডিওটি টিভিতেও দেখতে পাবেন। এখন অনুগ্রহ করে আমাদের সাথে চলুন।”
আমি মিংলিনের হাত ধরে ছুটতে লাগলাম সেনাবাহিনীর পেছন পেছন। ট্রাকগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। ঠেসেঠুসে আরও কিছু মানুষ ঢুকানো যাবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু সময় বাঁচানোর জন্যই বোধহয় আমাদের ট্রাকে ওঠানোর ঝামেলা না করে নিজেদের আর্মার্ড কারে বসাল। চীনার সেনাসদস্যদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত চলাচলের জন্য এই ধরনের গাড়িগুলো ব্যবহার করে। আমাদের আর্মার্ড কার ট্রাকের পেছন পেছন ছুটতে লাগল।
ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলছে। রাস্তার স্পিড ব্রেকারেও স্পীড না কমিয়ে ছুটে চলছে গাড়িগুলো। ঝাঁকি খেয়ে ভেতরের মানুষগুলো আর্তনাদ করে উঠল। সেনাবাহিনীর লোকেরা পাত্তা দিল না সেটা। তাদেরকেও ভূমিকম্পের ভয়ে কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাল। আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। গাড়িতে কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই গম্ভীর এবং কিছুটা আতঙ্কিত। মিংলিন আমার হাতের উপর নখের চাপ বসিয়ে দিয়েছে। নার্ভাস মনে হলো তাকে। আমি কিছু বললাম না।
গাড়িটা একটা খোলা মাঠে আসতে বুঝতে পারলাম আমাদের এখানেই নিয়ে আসা হয়েছে। মাঠটা অনেক বড়। মাঠের মেঝে কংক্রিট দিয়ে তৈরি। ধারণা করলাম, নির্দিষ্ট মাত্রার, যেমন ৮ কিংবা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে মাঠের মেঝে। মাঠের আশেপাশে বড় বড় গাছ কিংবা বাড়িঘর নেই। হারবিন শহরে এই ধরনের কোন মাঠ আছে বলে জানতাম না। সরকার বোধহয় বহুদিন ধরে পরিকল্পনা করেই এই মাঠটা তৈরি করেছে। কি আশ্চর্য, আমরা কেউ জানতাম না এই ব্যাপারে!
গাড়িগুলো যখন মাঠ হতে দু’শো মিটার দূরে তখন অনুভব করলাম ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কা। সামনে-পেছনের ট্রাকগুলো থেকে অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। গাড়ি যেভাবে ঝাঁকি খেল অনুমান করছি রিখটার স্কেলে সাত কিংবা আট মাত্রার ভূমিকম্প এটা। আনুমানিক ১৫-১৬ সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা মাঠের ভেতর। আমাদের পেছনের একটা ট্রাক উল্টে গেছে ততোক্ষণে। হতাহতের সংখ্যা জানি না, তবে উল্টে যাওয়া ট্রাক থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে মানুষ। তীব্র চিৎকার এবং আহাজারি শোনা গেল আকাশে বাতাসে। অন্য গাড়িগুলো ঠিকঠাক মতো মাঠে এসে পৌঁছল তার মধ্যেই। আমরা আর্মার্ড কার থেকে নামলাম না। এই গাড়িগুলো অনেক শক্ত-পোক্ত করে বানানো হয় সাধারণত। ভেতরে থাকাই বেশি নিরাপদ।
শহর থেকে দূরে খোলা মাঠে আছি বলে আমাদের তেমন ক্ষতি না হলেও দূরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পেলাম কিছুটা। দূরের একটি বহুতল ভবন খসে পড়ল দেখতে দেখতে। এক এক করে নিভে যেতে লাগল শহরের বাতিগুলো। ভূমিকম্পে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ বোধহয় বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। আসার সময়ও পথঘাট বেশ অন্ধকার দেখেছি। এখন অবশিষ্ট সংযোগগুলোও বন্ধ হয়ে গেল।
পুরো দেড় মিনিট জুড়ে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঝালাপালা হলো কান। বেশ বড় বড় কিছু ঝাঁকি এবং পুরোটা সময় জুড়ে তীব্র কাঁপুনি অনুভব করলাম আমরা। ভয়াবহ দেড় মিনিট থেমে যেতেও কিছুক্ষণ আতঙ্কে কেউ নড়াচড়া করতে পারল না কেউ।

চার
ভোর হতে আমরা শহর দেখতে বেরুলাম। শহরে সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক কিংবা ইন্টারনেট পেলাম না আমরা। আর্মিদের কাছে রেডিও ছিল, সেখানে শুনলাম আট দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে রাতে। হারবিন শহরের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ ধ্বংস হয়েছে পুরোপুরি। চীনের অন্যান্য কিছু জায়গাতেও ভূমিকম্প হয়েছে।
আমাদের বাড়িটার অর্ধেকের বেশি ভেঙে পড়েছে দেখলাম। ভাঙা বাড়ির ভেতর যাওয়া নিরাপদ নয়। তবে আমাদের গাড়িটা অক্ষত আছে মোটামুটি। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। পেট্রোল আছে ভালোই। এখান থেকে ৯৭ কিলোমিটার দূরে ফুয়া শহরে যাব ভাবলাম। সেখানে মিংলিনের ভাই থাকে।
যেতে যেতে মিংলিন বলল-“চীনে তো এতবড় ভূমিকম্প হয়নি বোধহয়!”
বিষণ্ণ মুখে উত্তর দিলাম-“হয়েছে মিংলিন। ১৯৭৬ সালে চীনের তাংসানে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সেবার।”
“তাই নাকি! এবার কত মানুষ মারা গেল?”
“খুব কম হবার কথা। যেহেতু আগে ভাগে জানা গেছে।”
“প্রফেসর ঝাং ওয়ে বোধহয় নোবেল পেয়ে যাবে!”
“আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু কথা হলো কি করে সে ভূমিকম্পের কথা জেনে গেল আগে ভাগে।”
প্রফেসর ঝাং ওয়ে প্রতিভাবান মানুষ নিঃসন্দেহে। কয়েক বছর আগে যখন সে ভূমিকম্পের তিন মিনিট আগে পূর্বাভাস দিতে পেরেছিল, তখনকার কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। পরদিন টিভিতে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিল সে। কি করে সে পূর্বাভাস দিয়েছিল ভূমিকম্পের, সেটা তখন ব্যাখ্যা করে বলেছিল-
“...ঘটনা আসলে একদম সহজ। আমার বাসার পেছনে কিছু বড় বড় গাছ আছে। মৌমাছিদের দু’টো চাক দেখেছিলাম সেখানে। একদিন বিকেলে দেখলাম, কোন কারণ ছাড়াই মৌমাছিরা চাক থেকে বের হয়ে উড়ে যাচ্ছে কোথায় যেন। প্রথমে অবাক হলাম। পরে মনে হলো এটা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নয় তো! কারণ কেঁচোদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। ভূমিকম্পের আগে আগে তাদের গতিবিধি অনেক সময় বদলে যায়। যেভাবেই হোক, প্রাণীদের সার্ভাইভাল ইন্সটিংক প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগমন টের পেয়ে যায়। তাই আমি মেটেওরলজি ডিপার্টমেন্টে জানালাম আমার আশঙ্কার কথা এবং আমার আশঙ্কা তিন মিনিট পর সত্যও হলো। আমরা এখন পশু-পাখিদের উপর গবেষণা করছি এবং চেষ্টা করছি ভূমিকম্পের সাথে তাদের গতিবিধির কতটুকু সংযোগ আছে তা খতিয়ে দেখতে।”
এর কিছুদিন পর একটা কনফারেন্সে ঝাং ওয়ের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। বেশ লম্বা-চওড়া মানুষ সে। চোখগুলো খুব তীক্ষ্ণ। চেহারায় মেধার চেয়ে ধূর্ততা বেশি ফুটে উঠেছে। করমর্দন এবং হালকা আলাপচারিতা ছাড়া আলোচনা এগোয়নি আর।
মিংলিন বোধহয় আমার মনের কথা পড়তে পারল। জিজ্ঞেস করল-
“তুমি তো বোধহয় ঝাং ওয়ের সাথে পরিচিত হয়েছিলে একবার। না?
“হ্যা, একটা কনফারেন্সে দেখা হয়েছিল কয়েক বছর আগে।”
“কিসের কনফারেন্স ছিল সেটা?”
“ হিউম্যান মিউটেশনের উপর। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার সোসাইটি আয়োজন করেছিল কনফারেন্সটির...” হঠাৎ করেই একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়। বজ্রপাতের মতো পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি গাড়ি ব্রেক করে দাড়িয়ে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে। মিংলিন আমার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল।
“কি হলো রিজভি?”
“আমি ধরে ফেলেছি ব্যাপারটা মিংলিন। পুরো প্রসিডিয়ারটা ধরে ফেলেছি।”
“কি ধরে ফেলেছ?”
“ঝাং ওয়ের ব্যাপারটা। ঝাং ওয়ে নিজের ক্ষমতাবলে একটা অমানবিক কাজ করেছে।”
“কি করেছে?”
“খুলে বলি। আমি যে কনফারেন্সে ঝাং ওয়ের সাথে দেখা করেছিলাম, সেটা ছিল বিশেষ ধরনের ভাইরাসের প্রভাবে হিউম্যান মিউটেশনের উপর। আফ্রিকার বিভিন্ন ছোট ছোট দ্বীপে মাঝে মাঝে এই ভাইরাসটি দেখা যায়। এর গতি প্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি। এনএফ-ওয়ান ভাইরাস বলা হয় এটাকে। এর ভিক্টিম খুবই কম। হাতে গোণা কয়েকজন। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নষ্ট করে দেয় ভাইরাসটি। ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ তীব্র পরিমাণে ক্ষুধা অনুভব করে। ক্ষুধা ছাড়া মস্তিষ্কের অন্য কাজগুলো ভাইরাসটি অবদমিত করে রাখে। ঘ্রেলিন এবং লেপ্টিন নামক হরমোন দু’টোর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় শরীরে। ফলে তীব্র ক্ষুধা ছাড়া অন্য কাজগুলো ভুলে যায় মানুষ। চোখের ডায়ালেশনও অনেক বেড়ে যায়। মানুষ মোটামুটি জন্তুতে পরিণত হয়। যাই হোক, আমার ধারণা প্রফেসর ঝাং ওয়ে এই ভাইরাসটি জোগাড় করেছে কোনভাবে এবং ইঞ্জেক্ট করেছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ভেতর। তারপর তাদের ছেড়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংরক্ষিত খোলা জঙ্গলে।”
“কি করে বুঝলে? আর এতে করে লাভটাই বা কি?”
“সেদিন আমরা যেখানে অসুস্থ ছেলেটাকে পেয়েছিলাম, তার পাশেই একটা জঙ্গল ছিল মনে আছে? জঙ্গলের একটা অংশ কয়েক বছর ধরে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা। তাছাড়া সেখানে একটা মেটেওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টও আছে, কয়েক বছর আগে ঝাং ওয়ে সেখানে সরকারী অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে ডিপার্টমেন্টটি। আসলে সারা দেশেই সে কিছু মেটেওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছে, যেগুলোর বেশিরভাগই কোন না কোন জঙ্গলের কাছে। দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাতে পারছ না?”
“না, পারছি না। কি বোঝাতে চাও তুমি?”
“বোঝাতে যাই, ঝাং ওয়ে কিছু মানুষের মধ্যে এনএফ-ওয়ান ভাইরাসটি ইজেক্ট করেছে। যাদের শরীরে ভাইরাসটি ঢুকেছে, তাদের বোধশক্তি হয়ে গেছে প্রায় পশুর মতো। পশুর মতো ক্ষুধার তাড়নায় বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শিকার করে খেত তারা। বছরের পর বছর এভাবে থাকতে গিয়ে তাদের পশুর মতোই সার্ভাইভাল ইন্সটিংক জন্মেছে। যেহেতু মানুষের মস্তিষ্কটি অনেক বেশি বিকশিত, তাই সার্ভাইভাল ইন্সটিংকও অনেক বেশি নির্ভুল। ঝাং ওয়ে এই সব মানুষদের আচার-আচরণ থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্পর্ক আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। যে ছেলেটাকে আমরা বাঁচিয়েছিলাম, সে নিঃসন্দেহে এনএফ-ওয়ান ভাইরাসের ভিক্টিমদের একজন। ভূমিকম্প হবার ঠিক আগের দিনই সে সেনাবাহিনী সংরক্ষিত এলাকা থেকে পালাল, এটাও হয়তো এক ধরনের সার্ভাইভাল ইন্সটিংক।”
“ঝাং ওয়ে তাহলে সত্যিকারের মানুষ ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ভাইরাসটির ভিক্টিম বানায়, যাতে করে তারা বাকী মানুষকে ভূমিকম্পের আগমনী বার্তা দিতে পারে?”
“হ্যা, ঠিক তাই। তবে সে শুধু মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ধরে নিয়ে যায়।”
“মানে?”
সেদিন রাতে কি করে লি কিয়াং এর ফাঁসির তথ্য ইন্টারনেট থেকে বের করেছি, বুঝিয়ে বললাম মিংলিনকে। সে বেশ অবাক হলো। বলল-
“তোমার কথা সত্য হলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন এসে যায়, সেটা হলো- বিষয়টা কি মানবিক? কতগুলো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করে তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে মানবতার কল্যাণে। ক্ষুদ্র সংখ্যক মানুষের অধিকার বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচানোটাকে কোন চোখে দেখা হবে?”
“সেটাই তো বার্নিং কোয়েশ্চান। এজন্যই ঝাং ওয়ে এত গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছে। চীনা সরকার হয়তো তাকে এই গবেষণার অনুমতি দেবে না, এমনটা ধরে নিয়েই সে গোপনে নিজের ক্ষমতা এবং পরিচিতি ব্যবহার করে কাজটা করেছে। তবে প্রশাসনিক কোন ক্ষমতাশালী মানুষেরও সহায়তা নিচ্ছে সেটা নিশ্চিত।”
“তবে যত যাই বলো, এই কথাগুলো কিন্তু শুধু তোমার হাইপোথেসিস মাত্র। পুরোপুরি সত্য কিনা সেটা জানার কিংবা যাচাই করার উপায় নেই।”
“ঠিক বলেছ। সেই চেষ্টা করাও নিরাপদ নয়।”

পাঁচ
১০ বছর পর।
লোকটার চেহারা পাথরের মতো কঠোর এবং নির্লিপ্ত। আমাকে প্রথমে জরিপ করল ঠান্ডা চোখে। তারপর জিজ্ঞেস করল-
“আপনি সত্যিই একটা ষোল বছরের কিশোরকে খুন করেছেন?”
ঘটনাটা সত্য। আমি, মিংলিন আর আমাদের সাত বছরের মেয়ে লিসা; তিন জন ফিরছিলাম একটা সিনেমা দেখে। হঠাৎ করেই গাড়িটা এলো, নিয়ন্ত্রণ হারাল, মিংলিন আর লিসাকে পিষে দিল দেয়ালের সাথে। আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। গাড়ি থামিয়ে ভেতর থেকে এক লাজুক চেহারার কিশোর বের হয়ে এলো। বুঝলাম ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তার, হয়তো বাবার গাড়ি নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ড্রাইভে বের হয়েছে, আর পিষে দিয়েছে আমার জীবনটাও। কিশোরটির চোখে স্পষ্ট ভয় ছিল। কি করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কি হলো আমার, এলতোপাথারি মারতে লাগলাম, উন্মাদের মতো পেটাতে থাকলাম ছেলেটাকে, শক্তির শেষ বিন্দুটা খরচ না হওয়া পর্যন্ত থামলাম না। হলফ করে বলতে পারি, মিংলিন আর লিসার মৃত্যু যতটা নৃশংসভাবে হয়েছে, ছেলেটার মৃত্যু তার চেয়ে কোন অংশে কম নৃশংস হয়নি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম,-“হ্যা, আমি সত্যি খুনটা করেছি।”
জাজ ভদ্রলোক খস খস করে কি যেন লিখে চলল। তারপর দু’জন পুলিশ আমাকে নিয়ে গেল হাজতে। আমার চেতনা কোন কাজ করছিল না। আমি যেন বোধশক্তিহীন পশুতে পরিণত হয়েছি।
গভীর রাতে এলো ঝাং ওয়ে। মাথায় লম্বা হ্যাট। সেই ধূর্ত চেহারা, এত বছরে একটুও বদলায়নি। নিচু গলায় সে আমাকে বলল-
“রিজভি সাহেব, আপনাকে আমি বাঁচাতে পারি মৃত্যুদন্ড থেকে। যদি আমার সাথে কাজ করতে রাজি হন।”
আমি নাকমুখ কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠলাম-“জাহান্নামে যা তুই শয়তান।”
কথাটা বাংলায় বলেছি না চীনা ভাষায়, মনে নেই। তবে আমার চোখমুখে ফুটে ওঠা ভাবে নিঃসন্দেহে আমাকে পশু পশু দেখাচ্ছিল।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৫২
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×