ড. রায়হান তার মোটাসোটা শরীরটা নিয়ে নাচতে নাচতে বললেন-"ইউরেকা ইউরেকা!"
শুক্রবার সকালে চেচামেচির শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। দেখি পাশের বাসার পিএইচডি ধারি জীনত্ত্ববিদ ড. রায়হান তার বাসার সামনের বাগানটাতে নেচে বেড়াচ্ছেন আর চেচাচ্ছেন ইউরেকা ইউরেকা বলে। তার হাতে একটা কাগজ।
আমি তার কাছে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম-"ড. রায়হান‚ কি হয়েছে?"
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে গালে চুমু খেয়ে ফেললেন। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই তিনি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন-"বুঝলেন বাপ্পী সাহেব‚ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ মানুষটির ডিএনএ-র মডেল আবিস্কার করে ফেলেছি। এই যে আমার হাতে‚ দেখুন।"
আমি তার বাহুডোরে হাঁসফাঁস করতে করতে বললাম-"এই মডেল দিয়ে কি হবে?"
"কি হবে মানে? আমি এখন যে কারো ডিএনএ-র গঠন বদলে দিয়ে তাকে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষে রূপান্তর করে দিতে পারব। আমার গবেষণা কাজে লাগালে দুনিয়া জুড়ে শুধু শুদ্ধ মানুষের ছড়াছড়ি হবে।"
"বাহ ভালো তো! প্রথম শুদ্ধ মানুষটি কে হতে যাচ্ছে?"
তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন-"আমি নিজে। আম হিসেব করে দেখেছি‚ গড়পড়তা মানুষের ডিএনএ-র বেশিরভাগই‚ প্রায় ৮৫%-ই মানুষকে দিয়ে ভালো কাজ করাতে চায়‚ মহান কাজ করাতে চায়। কিন্তু ১৫% চায় মানুষকে খারাপ বানাতে‚ মানুষকে দিয়ে আজেবাজে-গর্হিত সব কাজ করাতে। এই পনের পার্সেন্ট ডিএনএ বদলে দিলেই মানুষ মোটামুটি ১০০% শুদ্ধ মানুষে পরিণত হবে।"
"ঠিক আছে! এক কাজ করুন‚ আজ থেকে কাজে লেগে যান। শুদ্ধতম মানুষ হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করুন।"
"জ্বী অবশ্যই‚ কয়েক মাস সময় দিন আমাকে। আমার ডিএনএ বদলাতে যা সময় লাগে‚ তারপরই আপনার সাথে দেখা হবে।" বলেই ঝড়ের গতিতে চলে গেলেন ঘরের ভেতর।
তারপর কতগুলো দিন কেটে গেল। রায়হান সাহেবের কথা আমি প্রায় ভুলেই গেছি।
মাস দুয়েক পর দু'জন চশমা পড়া রাগী চেহারার ভদ্রলোক এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ল। আমি দরজা খুলতেই একজন বলল-"আমার নাম তপু। আর উনি হলেন ড. তন্ময়। আমরা আসলে আপনার প্রতিবেশী ড. রায়হানের সহকর্মী। মাসখানেক হলো ড. রায়হান অফিসে আসছেন না। খোঁজ নিতে এসেছিলাম আমরা। কিন্তু অনেকক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পরও ড. রায়হানের বাড়ির দরজা খুলছে না কেউ। আপনি কি বলতে পারবেন ড. রায়হান কোথায় আছেন?"
আমি বললাম-"আমার সঙ্গেও তার দেখা হয়নি বহুদিন। হয়তো দরজা বন্ধ করে গবেষণা করছেন কিছু একটা নিয়ে। প্রায়ই এভাবে গৃহবন্দী হয়ে থাকেন তিনি।"
"তার সঙ্গে আপনার শেষবার দেখা হয়েছিল কখন?"
"মাস দুই আগে। পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষের ডিএনএ আবিস্কার করে ফেলেছেন বলে দাবী করেছিলেন তখন!"
"তাই? এ সম্পর্কে তো আমাদের কিছু বলেননি তিনি! যাই হোক‚ চলুন আরেকবার গিয়ে দেখি দরজা খোলেন কিনা উনি।"
আমি গায়ে একটা শার্ট চাপিয়ে দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে গেলাম ড. রায়হানের বাসায়। কলিংবেল টিপলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে। কেউ দরজা খুলল না। কি মনে হতে হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল ভারী দরজাটা। আমরা তিনজন পায়ে পায়ে ভিতরে ঢুকলাম।
দিনের বেলাতেও ঘরটা অন্ধকার। জানালার পর্দাগুলো টেনে রাখা। এ ঘর ও ঘর খুঁজতে লাগলাম আমরা। কোথাও নেই তিনি। কিচেনে‚ বেডরুমে‚ বাথরুমে‚ বসার ঘরে‚ বারান্দায়...কোথাও বাদ রইল না খোঁজাখুঁজি।
ঘরের শেষ মাথায় ল্যাবরেটরি মতো একটা ঘর আছে। পায়ে পায়ে সেখানে ঢুকলাম তিনজন। আবছা অন্ধকার একটা রুম‚ কেমিক্যালের গা গুলানো গন্ধ। গা ছমছম করতে লাগল কেন যেন।
তন্ময় নামের ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলল-"এখানেও তো নেই তিনি!"
কথা শেষ হতে না হতেই কে যেন দ্রুতগতিতে সরে গেল আমাদের পেছন দিকে। তিনজন একসাথে পেছন ফিরলাম ঝড়ের গতিতে। আশ্বস্ত হলাম একটা মোটাসোটা ইঁদুরকে ত্রস্ত পায়ে ছুটতে দেখে।
তপু বলল-"আচ্ছা এটা কি?" বলেই কোণে পরে থাকা একটা কাগজ তুলে নিল। ঝুঁকে পরে দেখতেই চিনে ফেললাম! বললাম-
"আরে এটাই তো সেই ডিএনএ মডেল‚ ড. রায়হানের আবিস্কার করা শুদ্ধতম মানুষের ডিএনএ।"
"এ সম্পর্কে সে কিছু বলে গিয়েছে আপনাকে?"
"শুধু বলেছে যে কোন মানুষের ১৫% ডিএনএ বদলে দিলে সে শুদ্ধ মানুষে পরিণত হবে।"
পাশ থেকে ড. তন্ময় কাগজের উপর ঝুঁকে পরে বলল-"এই ডিএনএ মডেলটা পরিচিত ঠেকছে না তপু?"
তপু কি যেন ভাবছে গম্ভীর ভাবে। বলল-"কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে পড়ছে না কি এটা! কিন্তু আমি ভাবছি‚ মানুষের ডিএনএর সাথে ৮৫% মিল আছে ইঁদুরের ডিএনএ-র। শুদ্ধ মানুষ হবার জন্য রায়হান যদি কারো ডিএনএ ১৫% বদলে দেয়..."
তন্ময় উত্তেজিত হয়ে বলল-"ঠিক লাইনে চিন্তা করছ তপু! মনে পড়েছে‚ এই কাগজটায় তো ইঁদুরের ডিএনএ-র ছবি!!"
আমি মাঝখান থেকে বললাম-"তার মানে দাড়াচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষের ডিএনএ আর ইঁদুরের ডিএনএ একই?"
"যদি ড. রায়হানের গবেষণা সঠিক হয়‚ তাহলে একই!"
আমি ভয়াবহ চমকে উঠে বললাম-"ড. রায়হান বলেছিলেন যে তিনি নিজের ডিএনএ-র গঠন বদলে শুদ্ধ মানুষের ডিএনএ-তে রূপান্তর করতে যাচ্ছেন! তার মানে কি..."
তপু কান চেপে বলল-"নো নো! প্লীজ ডোন্ট সে দ্যাট!"
তন্ময় অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-"মাই গড!"
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম-সেই মোটাসোটা ইঁদুরটা দৌড়ে চলে যাচ্ছে টেবিলের নিচ দিয়ে!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৫