"৩৭ নম্বর রোগী কে? ভিতরে যান।"
আজ রোগী তেমন নেই। চেম্বার প্রায় ফাঁকাই বলা যায়।
এসিস্ট্যান্টের ডাক শুনে লালপেরে শাড়ী পড়া একজন অসম্ভব রকমের রূপবতী মহিলা উঠে দাড়াল। দীর্ঘদীন বিলেতে থাকলে চেহারায় যেমন একটা ফর্সা ফর্সা ভাব চলে আসে, মহিলাটির চেহারায় তেমন একটা ভাব আছে । মহিলার বয়স ত্রিশের কোঠায়। চকলেট রংয়ের ফ্রেমের চশমাটা বেশ মানিয়ে গেছে তার চেহারায়। তার চোখ দু'টো যেন তৈরিই হয়েছে চকলেট রংয়ের ফ্রেমে বাঁধা পড়ার জন্য। মহিলাটি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে সায়কায়াট্রিস্ট জিব্রান সাহেবের চেম্বারে প্রবেশ করল। সায়কায়াট্টিস্ট জিব্রান সাহেবের কামরাটা বেশ সাজানো গোঁছানো। সৌখিন মানুষ জিব্রান। সৌখিনতার বেশ কিছু চিহ্ন রয়েছে ঘরে। কিছু দামী তৈলচিত্র ঝুলছে দেয়ালে। ফ্লাওয়ার ভাসে কিছু তাজা রজনীগন্ধা রাখা হয়েছে। হালকা ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে কামরাটা।
মহিলাটি কামরায় ঢুকে একটু ইতস্তত করতে লাগল। যেন কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
রেজস্টার ফাইলে মহিলাটার নাম দেখল জিব্রান। বলাকা চৌধুরী। একটু ভ্রু কুঁচকাল সে। এই ধরণের নাম আগে তেমন শুনেছে বলে মনে পড়ল না তার। অবশ্য আজকাল অনেক ব্যতিক্রমধর্মী নাম চোখে পড়ে তার। আরেকটা তথ্য দেখে সে অবাক হল। মহিলার বয়স বত্রিশ। অসম্ভব রূপবতী। কিন্তু অবিবাহিত। বাঙালী মেয়েরা এত বয়স পর্যন্ত সাধারণত অবিবাহিত থাকে না।
"বসুন মিস বলাকা।"
জিব্রানের কথা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়েই বসে পড়ল বলাকা। আশেপাশে তাকিয়ে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজল। জিব্রান একটু চিন্তিত হল। বলাকা কি এনশিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে?
"আপনি কিছু খুঁজছেন মিস বলাকা?"
"একট কঙ্কাল....।"
"কঙ্কাল?"
ভ্রু কুঁচকে ফেলল জিব্রান। কঙ্কাল খুঁজছে সে? ডাক্তারদের চেম্বারে কঙ্কাল থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয়, তবে কঙ্কাল খোঁজাটা কিছুটা অস্বাভাবিক। এমন সময হঠাৎ তার মনে পড়ল, বলাকা কি দেয়ালে ঝুলানো তৈলচিত্রের কথা বলছে?
বাঁ দিকের দেয়ালে একটা তৈলচিত্র ঝুলছে। একটা ঘোড়ার উপর একজন অশ্বারোহী। অশ্বারোহীর হাতে বল্লম। যেন শিকার করতে বেড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হল, ঘোড়া এবং অশ্বারোহী উভয়ই কঙ্কাল। এমনকি ঘোড়ার পায়ের কাছেও কিছু হাড়-গোড় পড়ে আছে।
জিব্রান হেসে বলল, "ওহ আপনি ঐ ছবিটার কথা বলছেন? এটা সালভাদর দালির আঁকা একটা বিখ্যাত ছবি-'ক্যাভালো মেটাফিস্কো'। সালভাদর দালির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী। ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। আসলে আমি ছবি টবির কিছু বুঝি না তেমন। তবে আমার উড বি ওয়াইফ সুজাতা বেশ বোঝে। ওই ছবিগুলো কিনেছে।"
সুজাতার কথা শুনে বলাকার চোখের পাতা একটু কেঁপে উঠল। বিরবির করে বলল,"..হবু স্ত্রী...সুজাতা...।"
সেটা শুনে জিব্রান বলল, "জ্বী, সুজাতা- তার সাথেই আগামী মাসে আমার বিয়ে হচ্ছে।"
বলাকার তেমন প্রতিক্রিয়া হল না।
"তো বলাকা, আপনি কেমন আছেন?"
"ভাল।"
"আপনার কোন একটা সমস্যা আছে। আপনি আমার কাছে এসেছেন...?"
বলাকার ভিতর এতক্ষণ একটা ছন্নছাড়া ভাব ছিল । হঠাৎ করেই সেটা গায়েব হয়ে গেল । অনেক আত্মবিশ্বাসী দেখাল তাকে। বিষয়টা লক্ষ্য করল জিব্রান। এটা ডিসোশিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিস-অর্ডারের সিম্পটম। বলাকার সমস্যাটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। "আমার সমস্যাটা হল স্বপ্ন। আমি স্বপ্নে যা দেখি, সেটা বাস্তবে হুবহু ফলে যায়।"
জিব্রান হতাশ হল। এই সমস্যা নিয়েও এ যুগে কেউ সায়কায়াট্রিস্টের কাছে আসে।
"আপনি প্রিমনিশনের কথা বলছেন?"
জিব্রানের মনোভাব বুঝতে পেরে বলাকা বলল, "এত সহজ ভাববেন না। বিষয়টা অনেক জটিল। আমার স্বপ্নের প্রতিটি লাইন হুবহু ফলে যায়। এবং স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে আমি হাতে ভবিষ্যতের কোন জিনিস দেখতে পাই।"
"ভবিষ্যতের জিনিস? সেটা কেমন?"
"একটা ঘটনা বলি। একবার আমি স্বপ্নে দেখি যে আমার মামা মারা গিয়েছেন। মানুষ তার লাশের পাশে কান্নাকাটি করছে।লাশের পাশে একটা কাগজ। সেটা হাতে নিয়ে দেখি, একটা ডেথ সার্টিফিকেট। স্বপ্ন এতটুকুই। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার হাতে সত্যি সত্যি একটা ডেথ সার্টিফিকেট। মামার নাম লেখা তাতে। তারিখটা ঠিক এক বছর পরের। 19th June, 2009. মৃত্যুর কারণ লেখা-Suffocation. আমি এই সার্টিফিকেট কাউকে দেখায়নি। কিন্তু ঠিক এক বছর পর ১৯ জুন আমার মামা মারা যায়। কজ অব ডেথও মিলে যায়। শ্বাসকষ্ট । সবচেয়ে মজার ব্যাপার, মামার আসল ডেথ সার্টিফিকেট আর স্বপ্নে পাওয়া ডেথ সার্টিফিকেট হুবহু মিলে এক।"
জিব্রান প্রচন্ড বিস্মিত হলেও সেটা চেহারায় প্রকাশ করল না।
জিব্রান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, "এমন ঘটনা কি আপনার সাথে
এরপর আর হয়েছে?"
"হ্যা হয়েছে।"
"কখন?"
"অনেকবারই হয়েছে। আরেকটার কথা বলি। একবার স্বপ্ন দেখি, আমার এক শিক্ষক
রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তার কোয়ার্টজ ঘডির রিস্টওয়াচের ডায়াল ভেঙে
চুরচুর হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার হাতে একটা ঘড়ি। ডায়াল ভাঙা।
সেখানে সময় দেখাচ্ছে, ৫:১৭ । এর কিছুদিন পর সত্যিই আমার সেই শিক্ষক রোড
এক্সিডেন্টে মারা যান। তার হাতঘড়িতে তখনও সময় দেখাচ্ছে- ৫:১৭।"
"স্ট্রেঞ্জ!"
জিব্রান কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল। তারপর বলল,
"মিস বলাকা, আপনার স্বপ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভূত মনে হলেও এর ব্যাখ্যা আছে।"
"তাই?"
"হ্যা, আমি বলছি। শুনুন। আপনার যেটা হয়েছে সেটা হল- স্লিপ এনশাইটি ডিসঅর্ডার। অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা থেকে আপনি আবোল-তাবোল স্বপ্ন দেখছেন। আপনার অবচেতন চাইছে আপনি স্বপ্নগুলো বিশ্বাস করুন। আপনি করছেনও। আপনার সচেতন মনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সে আপনাকে দিয়ে কিছু কাজ করাচ্ছে। আমার ধারণা, আপনার মামার আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট ছিল, কিংবা আপনাদের পরিবারের কেউ শ্বাসকষ্টে মারা গিয়েছেন। আপনার অবচেতন মনের কাছে সে তথ্য ছিল।
আপনার মামা শ্বাসকষ্টে মারা যাবেন, এটা অবচেতন মন ধারণা করে নিয়েছিল। সম্ভবত কোন এক অলস সময়ে আপনাকে দিয়ে সে ডেথ সার্টিফিকেটটা টাইপ করিয়ে নিয়েছে কম্পিউটারে...আপনার মামার মৃত্যুর পরেই! কিন্তু আপনাকে সে বিশ্বাস করিয়েছে যে ডেথ সার্টিফিকেটটা আপনার হাতে এসেছে একবছর আগে।"
"আমি কিভাবে ডেথ সার্টিফিকেট টাইপ করব? আমি তো ডাক্তার নই!"
"আগেই বললাম, আপনি টাইপ করেছেন মামার মৃত্যুর পরে, আগে নয়। মামার ডেথ সার্টিফিকেটটা দেখেই আপনি টাইপ করেছেন।"
"আপনি যেটা বলছেন, সেটা কি আপনি নিজে বিশ্বাস করছেন?"
"বিশ্বাস-অবিশ্বাস করার চেষ্টাই করছি না আমি। আপনার সাথে কি ঘটেছে সেটার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতের কোন বস্তু বর্তমানে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কাজেই এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। এই ব্যখ্যাটা ধরে নিলে কিন্তু আমরা দ্বিতীয় ঘটনাটাও ব্যাখ্যা করতে পারি। আপনার শিক্ষকরে মৃত্যুর পরেই আপনি হুবহু এক রকমের দেখতে আরেকটা ঘড়ি কিনে শিক্ষকের ঘড়ির সময়ের সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন। কাজটা আপনাকে দিয়ে করিয়েছে আপনার অবচেতন মন। তাই আপনার মনে নেই। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় পেশেন্টদের একই সাথে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারও হয়। অর্থাৎ আপনার মধ্যে এখন একই সাথে দু'টো ব্যক্তি বাস করছে। একজন চাইছে আপনি স্বপ্নে ভবিষ্যত দেখার বিষয়টা বিশ্বাস করুন, আরেকজন মনেপ্রাণে এই ঘটনাগুলো বিশ্বাসও করছে। অবশ্য, আরো সময় নিয়ে কয়েক সেশন কাউন্সিলিং না করে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। তবে যতটুকু মনে হয়-এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।"
"ভবিষ্যতের জিনিস বর্তমানে আসতে পারবে না, এমনটা মনে হল কেন আপনার? আপনি কি স্টিফেন হকিংয়ের ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমে-Arrow of Time এর কথা পড়েননি?"
"পড়েছি। এরো অফ টাইম এখনো একটা থিওরি মাত্র। তাছাড়া একা আপনার ক্ষেত্রে এরো অফ টাইম প্রযোজ্য হবে না।"
"আপনার ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারছি না।"
"কোন অসুবিধা নেই। আপনার আসলে কাউন্সিলিং এর দরকার। আপনি এক কাজ করুন। আগামী সোমবার আসুন....।"
বলাকা স্মিত হাসল।
"জিব্রান সাহেব, আমি আসলে আপনার কাছে কাউন্সিলিং কিংবা মেডিকেশনের জন্য আসিনি।"
"তাহলে?"
"আমি এসেছি আপনাকে একটা বিপদ থেকে বাঁচাতে।"
জিব্রান অবাক হল- "মানে?"
"গতকাল রাতে আমি স্বপ্ন দেখি, সুজাতা নামের একটা মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে হচ্ছে। কাজী সাহেব আপনাদের বিয়ে পড়াচ্ছেন। হঠাৎ সুজাতা উঠে দাড়িয়ে আপনার বুকে একটা লম্বা হাতলওয়ালা ছুরি ঢুকিয়ে দিল। আপনি সাথে সাথে মারা গেলেন....!"
জিব্রান জোরে জোরে হো হো করে হেসে উঠল।
"সত্যি বলছেন? তা এবার কোন 'ভবিষ্যতের বস্তু' পাননি?"
বলাকা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। "আমি জোক করছি না জিব্রান সাহেব। সত্যি সত্যি আমি দেখেছি এমন একটা স্বপ্ন। আর হ্যা, ঘুম থেকে উঠে কি পেয়েছি জানেন? রক্তমাখা একটা পেইন্টিং-সালভাদর দালির আকা। আর একটা ফটো। যেখানে আপনি আর সুজাতাকে দেখা যাচ্ছে।"
জিব্রান একটু থতমত খেয়ে গেল। "আমি কি দেখতে পারি পেইন্টিং আর ফটো?"
"অবশ্যই, পেইন্টিংটা বাইরের ঘরে রেখে এসেছি।
আর ছবিটা এখনই দিচ্ছি, আপনি পিয়নকে ডেকে পেইন্টিংটা আনান।"
জিব্রান পিয়নকে ডেকে পেইন্টিংটা নিয়ে আসতে বলল। বলাকা ততক্ষণে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করেছে।
"এই যে দেখুন।"
জিব্রান দেখল। ফটোতে একটা অনুষ্ঠানে সত্যিই জিব্রান আর সুজাতাকে দেখা যাচ্ছে। সুজাতার মুখের একটা পাশ শুধু বোঝা যায়, অবশ্য তাতেই স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে সুজাতাকে। আর জিব্রানের পরনে একটা নীল পাঞ্জাবী। অথচ কোন নীল পাঞ্জাবী নেই ওর। সুজাতার পরনের শাড়ীটা কি রংয়ের স্পষ্ট বোঝা যায় না। লাল কিংবা গোলাপী হতে পারে। আশ্চর্য, এমন ছবি তো কখনো তুলেছে বলে মনে পড়ে না! তাহলে? ভবিষ্যতের ছবি? তা কি করে হয়?
পিয়ন পেইন্টিংটা নিয়ে এসেছে। সেটা দেখে তো আরও অবাক হল জিব্রান। এটা আরেকটা ক্যাভালো মেটাফিস্কো। তবে রক্তে রাঙা। ছবিতে ঘোড়ার মুখটা রক্তে ঢেকে গিয়েছে। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল জিব্রান। রক্তটা কি ওরই? ল্যাব টেস্ট করে দেখতে হবে। হঠাৎ কি মনে করে সুজাতা আর ওর ফটোটা হাতে নিয়ে দেখল ও। ফটোতে কোথাও বড়সড় একটা খুঁত আছে। কোথায়?....হ্যা, ধরতে পেরেছে জিব্রান। সুজাতা শাড়ীর আঁচলটা ফেলেছে ডান কাঁধে, অথচ মেয়েরা শাড়ীর আঁচল রাখে বাম কাঁধে।
"বলাকা, আপনার ফটোর একটা বিষয়...."
বলতে গিয়ে থেমে গেল জিব্রান। বলাকা নেই কামরায়। জিব্রান হাক ছাড়ল- "আব্দুল, আব্দুল।"
এসিস্ট্যান্ট আব্দুল এসে দাড়াল- "জ্বী স্যার?"
"পেশেন্ট কই গেল?"
"উনি তো এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন স্যার!"
"শীট!"
সেদিন রাতে ল্যাব টেস্টের রেজাল্ট পেল জিব্রান... হ্যা,পেইন্টিংয়ে লেগে থাকা রক্তটা জিব্রানেরই ছিল।
দু'দিন পর। জিব্রান চেম্বারে বসে আছে। রাত ন'টা বাজে। এতক্ষণ কখনই সে অফিসে থাকে না। আজকে আছে কারণ তার এক বন্ধুর আসার কথা অফিসে।
গত দু'দিন জিব্রান অনেক ভেবেছে বলাকার ব্যাপারটা নিয়ে। বলাকা তাকে সাবধান করতে চাচ্ছিল। অর্থাৎ বলাকা চাচ্ছিল যাতে ও সুজাতাকে বিয়ে না করে। জিব্রান এক ধরণের দ্বিধায় ভুগছে। একটা স্বপ্নের প্রেক্ষিতে পাঁচ বছরের একটা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু অতিপ্রাকৃত কিছু যদি নাও থেকে থাকে, তাহলেও জিব্রানের উচিত বিষয়টা ইনভেস্টিগেইট করে দেখা। বিশেষ করে পেইন্টিং আর ফটোর ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দরজা নক হল এমন সময়।
"কাম ইন।" জিব্রান বলল।
ছয় ফুট লম্বা খুব শার্প চেহারার এক যুবক ঢুকল কামরায়।
"আরে পূরব? কতদিন পর তোকে দেখলাম! কেমন আছিস?"
পূরব জিব্রানের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।
"ফর্মালিটি বাদ দে তো জিব্রান, আগে এক কাপ কফি খাওয়া। তারপর বল কি অবস্থা।"
"আব্দুল, দু'কাপ কফি পাঠিয়ে দাও।"
পূরব খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে জিব্রানকে দেখতে লাগল। বলল,
"কি ব্যাপার বল তো? সুজাতাকে নিয়ে কোন সমস্যা?"
জিব্রান চমকে উঠল, "কিভাবে বুঝলি?"
"তুই এনগেইজমেন্ট রিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলি অনেকক্ষণ ধরে। তাই বললাম। তাছাডা চোখের নিচে কালসিটে, দু'আঙুলের ফাঁকে সিগারেটের ছাই- বোঝাই যায় গতরাতটা সিগারেট ফুঁকেই কাটিয়ে দিয়েছিস। ঝেডে কাশ তো, বল কি টেনশন?"
"আরে দোস্ত, তোর ডিডাকশন পাওয়ার দেখি আগের মতই আছে। আচ্ছা বল তো, আমাকে দেখে আর কি কি বুঝতে পারলি?"
পূরব এক মূহুর্ত চিন্তা না করে বলল,
"অনেককিছুই বুঝতে পারছি! এই যেমন- তোর গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে আজ সকালে, বাসে করে অফিসে এসেছিস।"
"কিভাবে ধরলি?"
"তোর চকচকে পালিশ করা জুতোর উপর একটা ধুলোমাখা স্যান্ডেলের ছাপ দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র লোকাল বাসেই এমনটা হয়।"
জিব্রান এবার অবাক হল না। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে, তার এই বন্ধুটির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। ও বলল,
"ঠিক বলেছিস দোস্ত। বুঝতে পারছি, তোকে দিয়েই হবে।"
"কি হবে?"
জিব্রান জবাব দেওয়ার আগেই আব্দুল কফি নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়ে জিব্রান বলল,
"শোন, সমস্যাটা খুলে বলছি তোকে। দু'দিন আগে, বলাকা চৌধুরী নামের একটা পেশেন্ট আসে আমার কাছে....."
পুরো ঘটনাটা বলে গেলে জিব্রান। একবারও বাধা না দিয়ে শুনল পূরব। দশ মিনিট পর জিব্রান থামল। পূরব বলল,
"তার মানে, বলাকা তোকে স্বপ্নের প্রমাণ হিসেবে একটা পেইন্টিং আর একটা ফটো দিয়েছে?"
"হ্যা।"
পূরব ভ্রু কুঁচকে সিলিং এর এক কোণায় তাকিয়ে ছিল। বলল, "তোর অফিসের সিকিউরিটি ক্যামেরাটা চালু আছে?"
"হ্যা, চালু তো থাকার কথা।"
"বলাকা যেদিন অফিসে এল সেদিনও চালু ছিল নিশ্চয়ই? ওর সাথে কনভারসেশনের ভিডিওটা দেখা তো।"
"ওহ,ভাল কথা মনে করেছিস!"
ভিডিও বের করতে করতে আধাঘন্টার মত লেগে গেল। খুব মনোযোগ দিয়ে পুরো ভিডিওটা দেখল পূরব।
"হ্যা হয়েছে, এবার ফটো আর পেইন্টিংটা বের কর।"
জিব্রানের হাত থেকে ফটোটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পূরব। তারপর মুচকি হাসল।
"বেশ বুদ্ধি আছে বলাকার, মানতেই হবে।"
"মানে?"
"কিছু না, পেইন্টিংটা কই?"
"ঐ তো, দেয়ালের সাথে ঠেস দেওয়া।"
পেইন্টিংয়ের খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল পূরব, ঝাড়া দশ মিনিট পর হাসিমুখে উঠে দাডিয়ে বলল- "তোর বলাকা একটা ফ্রড।"
"হোয়্যাট?"
"ইয়েস, ইউ হার্ড দা রাইট ওয়ার্ড।"
"কি বুঝলি এই ছবিগুলো দেখে?"
"বলছি, তার আগে ভাবীর সাথে কথা বলা দরকার।"
"ভাবী?"
"আরে ব্যাটা তোর হবু বউ, সুজাতা।"
"ওহ, তাই বল।"
পরের দিন বিকেলেই সুজাতার সাথে কথা হল পূরবের।
*** *** ***
পরদিন রাত। জিব্রান আর পূরব বসে আছে অফিস-কামরায়। জিব্রান বিরক্ত হয়ে বলল,
"কি হল, কিছু বলছিস না কেন?"
"বলছি, আগে স্কেচ দু'টো দেখ।"
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে পূরব পেন্সিল দিয়ে আঁকা দু'টো স্কেচ বাড়িয়ে দিল। বলল, "চিনতে পারিস মেয়ে দু'টো কে?"
জিব্রান স্কেচ দু'টো দেখল। "পারব না কেন, একটা সুজাতা আর একটা বলাকা। তুই একেছিস? ভাল হয়েছে। কিন্তু কি জন্য দেখাচ্ছিস এটা?"
"এই দেখ..." বলে একটা ইরেজার তুলে নিল পূরব। বলাকার স্কেচে ভ্রু দু'টো সামান্য পাতলা করে দিল। ঠোঁটের পাশে একটা তিল আঁকল। তারপর পেন্সিল দিয়ে কপালে কয়েকগাছি চুল টেনে দিল। মুছে দিল বলাকার চশমা। তারপর সেটা জিব্রানের দিকে বাড়িয়ে দিল।
"এবার চিনতে পারিস?"
বিস্ময়ে জিব্রানের চোয়াল ঝুলে পড়ল, "হলি কাই! আই জাস্ট কান'ট বিলিভ ইট!!"
স্কেচে বলাকার এখন যে চেহারাটা ফুঁটে উঠেছে সেটা পুরোপুরি সুজাতার সাথে মিলে যায়।
"পূরব,এটা কিভাবে....?"
জিব্রানকে থামিয়ে দিল পূরব। "দাড়া, আরো আছে।"
ল্যাপটপটা বের করে বলাকা যে ছবিটা জিব্রানকে দিয়েছিল সেটা ওপেন করল।
"ফটোশপের কিছু কেরামতি দেখ। প্রথমেই তোর নীল পাঞ্জাবীকে সাদা করে দিলাম, এবার মিরর ইমেজ করে দিই এটাকে....এবার দেখ তো চিনতে পারিস কি না?"
"মাই গড। এটা তো দু'মাস আগে আমার এক কাজিনের বিয়ের অনুষ্ঠান...কিন্তু সুজাতা তো ওখানে ছিল না!"
"না ছিল না, সুজাতার বেশ ধরে বলাকা গিয়েছিল ওখানে!"
"বলাকা? কিন্তু কেন?"
"বলছি, আগে সালভাদর দালির পেইন্টিংটা দেখ। যেটাতে তোর রক্ত লেগে আছে।"
পেইন্টিংটা ডেস্কের উপর বিছিয়ে দেয়া হল। পেইন্টিংয়ের কোনা থেকে পাতার মত দেখতে একটা বস্তু তুলে নিল পূরব।
"এটা কি বল তো?"
"কি? পাতা বা কাগজ হবে হয়ত!"
"নাহ, এটা তেলাপোকার পাখার ভাঙা অংশ।"
"হোয়াট?"
"হ্যা। এ থেকেই বোঝা যায় যে পেইন্টিংটা দুয়েকদিনের মধ্যে আঁকা হয়েছে এবং আঁকার সময় একটা তেলাপোকা উড়ে এসে পেইন্টিংয়ের উপর পড়েছিল।"
"তার মানে তুই বলতে চাস সব কিছুই করেছে বলাকা?একটা ভুয়া গল্প ফেঁদে নাটক করেছে?"
"এক্স্যাক্টলি!"
"তাহলে পেইন্টিংয়ে আমার রক্ত এল কিভাবে?"
"গুড কোয়েশ্চন। গতমাসে তুই রেড ক্রিসেন্টের একটা ক্যাম্পেইনে চিটাগাং গিয়েছিলি, মনে আছে?"
"তো?"
"ওখানে তুই এক ব্যাগ রক্ত ডোনেট করেছিলি,রাইট?"
"হ্যা, কিন্তু সে রক্ত সুজাতার কাছে যাবে কি করে?"
"আমি গতকাল সেই ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ভলান্টিয়ারদের একটা তালিকা কালেক্ট করেছি। এই দেখ।"
একটা নামের লিস্ট বাড়িয়ে দিল পূরব।
তালিকার একটা নামের উপর আঙুল ঠেকাল- "বলাকা চৌধুরী"।
একের পর বিস্ময়ের ধাক্কায় জিব্রানের নার্ভগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। "কিন্তু বলাকা এসব কেন করবে বল তো?"
"মিলিয়ন ডলার'স কোয়েশ্চান
। এর উত্তর একমাত্র বলাকাই দিতে পারবে।"
বোবা দৃষ্টিতে পূরবের দিকে তাকিয়ে রইল জিব্রান।
*** *** ***
আজ জিব্রানের বিয়ে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবেন একটু পরেই। ওয়াশরুমে এল জিব্রান। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলের সিঁথি ঠিক করে নিল। এখনি শেরওয়ানী পাগড়ী পড়তে হবে ওকে।
হঠাৎ আয়নার পিছনে দৃষ্টি পড়ল ওর।
সুজাতা!
"আরে সুজাতা, তুমি এখানে?"
সুজাতা কোন কথা বলল না।
"কিছু বলবে সুজাতা?"
সুজাতা জবাব না দিয়ে শাড়ীর আঁচল থেকে ডানহাতটা বের করল। লম্বা হাতলওয়ালা একটা ছুরি সুজাতার হাতে।
"সুজাতা! তোমার হাতে..."
খুব দ্রুত ছুরিটা চালাল সুজাতা...সেকেন্ডের ভগ্নাংশে জিব্রানের মনে হল- "তবে কি বলাকার স্বপ্নই ঠিক ছিল?"
জিব্রানের কাঁধে বিঁধে যাওয়ার আগ মূহুর্তে একটা শক্ত হাত ছুরিটাকে ধরে ফেলল। হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে পূরব। সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল, "বার বার একই ছদ্মবেশ নেওয়া নিরাপদ নয় মিস বলাকা। আর এটেম্পট টু মার্ডারের দায়ে পড়েছেন, লম্বা সময়ের জন্য জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন।"
*** *** ***
বিয়ের এক সপ্তাহে পরের কথা। এবার আর নকল নয়, আসল সুজাতার সাথে জিব্রান আর পূরব বসে আছে। সুজাতা বলল,
"পূরব ভাই, বলাকা কি পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছে?"
"আজ সকালেই দিয়েছে। ঘটনা একটু জটিল। ট্রায়াঙ্গল লাভ স্টোরি।"
"কি রকম?"
"লম্বা কাহিনী ভাবী! সংক্ষেপে বলি-বলাকা আপনার ইউনিভার্সিটিতেই পড়ত। আপনার চেয়ে সিনিয়র কিন্তু জিব্রানের চেয়ে জুনিয়র ছিল সে। একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিল বলাকা। পাগল ছিল ছেলেটার জন্য। কিন্তু ছেলেটা ক্রাশ খেয়েছিল আপনার উপর। আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেন...।"
পূরবকে বাঁধা দিল সুজাতা, "কি নাম ছিল ছেলেটার?"
"ইশমাম।"
সুজাতার মুখটা পাংশু হয়ে গেল। জিব্রান উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, "আর ইউ ওকে সুজাতা?"
পূরব বলল, "ভাবীর আপসেট হওয়ার কারণ আছে। ইশমাম ছেলেটা ভাবীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছিল!"
"হোয়্যাট?"
"হ্যা!"
"তারপর?"
"বলাকা ইশমামকে হাড়িয়ে পাগল হয়ে গেল। ঠিক করল, সুজাতাকেও শান্তিতে থাকতে দেবে না। সুজাতা জিব্রানকে ভালবাসে, ওদের বিয়ে হতে যাচ্ছে- এ কথা জানতে পেরেই সে বাকী নাটকটুকু সাজায়। সুজাতা সেজে জিব্রানের কাজিনের পার্টিতে যায়, জিব্রানের রক্ত জোগার করে।
তারপরের ঘটনা আমাদের জানা। তবে একটা কথা মানতেই হবে, সুজাতা আর বলাকার চেহারায় প্রচুর মিল। আর বলাকার প্ল্যানটায় কিছু খুঁত থাকলেও প্রচুর নাটকীয়তা ছিল।"
"বলাকার উদ্দেশ্য কি ছিল? আমাকে হত্যা করা?"
"না, বিয়েটা ভেঙে দেওয়া। সুজাতাকে কষ্ট দেওয়া। গল্প শুনিয়ে বিয়ে ভেঙে দিতে না পেরে সে চেয়েছিল সুজাতা সেজে জিব্রানকে হত্যা করে খুনের দায় সুজাতার ঘাড়ে চাপানো।"
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জিব্রান বলল,
"আসলেই, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।"
"ভাবী, আজকে তাহলে যাই আমি। জিব্রান, চলি দোস্ত!"
পূরব বিদায় নিয়ে চলে এল, সুজাতা আর জিব্রান তখনও বিস্মিত হয়ে ভেবে চলেছে!
*** *** ***
একমাস পর। জিব্রানের কামরায় নতুন একটা রোগী বসে আছে। পরনে লুঙ্গী-গেঞ্জী। পাগল কিসিমের লোক।
"ডাক্তার সাব, আমার সমস্যা হইল গিয়া আমি মানুষের মনের কথা বুঝবার পারি। আপনারা যারে কন থট রিডিং! আপনার মনে এখন কি চলতাসে কমু?"
(সমাপ্ত)
ড. জিব্রান সিরিজের অন্যগল্পগুলো-
ভয়
শয়তানবিদ্যা
পিশাচিনী
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২১