রাত কত গভীর হলে রাতের শব্দেরা ঘুমিয়ে পড়ে, জানতে ইচ্ছে করে। কত রাত জেগেছি, জানালার পাশে বসে চাঁদ খসা দেখেছি, কখনো নৈশব্দ দেখিনি। শব্দেরা মস্ত বড় গুবরে পোকা হয়ে আমার মগজ খুবলে বেড়ায় এই সব রাতে। পুরোটা রাত চিন্তার গলি-ঘুপচিতে সেই গুবরে পোকাদের যন্ত্রণা ভীত-কৈশোরের মতো ছোটাছুটি করে।
অনেক দিন ঘুমিয়ে পরার আগে তার কণ্ঠ শুনি না। আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধুলো জমেছে। ছোপ ছোপ মরিচা এখানে সেখানে। জঞ্জাল জমেছে। রাতের শব্দেরা মস্ত গুবরে পোকা হয়ে সে সব জঞ্জালে বসতি গড়েছে বহুদিন আগে। গুবরে সভ্যতার বিস্তার হচ্ছে যত, আমার রাতঘুম মিইয়ে যাচ্ছে ততোই। আমার চোখে ঘুম, তবু হৃদয় জেগে আছে বলে, গুবরে পোকার কথোপকথন শুনতে পারছি। একটি ভরাট কন্ঠওয়ালা গুবরে পোকা, কাষ্ঠ-গলার একটি পোকাকে বলছে-
“ওহ, একেই বলে স্বর্গ! ভদ্রলোকের মস্তিষ্ক ভরা জঞ্জাল, যত্রতত্র আমরা বসত-বাড়ি তৈরি করতে পারছি।”
“এসব জঞ্জাল নয় বন্ধু, এর নাম কষ্ট!”
“কষ্ট? কষ্ট কি?”
“কষ্ট হলো মস্তিষ্কে এক ধরনের উত্তেজনা। এক ধরনের ...একটা কিছু! একে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।”
“এখানে এত কষ্ট কেন?”
“কারণ মস্তিষ্কটি যার, সে একটি মেয়ের কথা ভাবছে এখন। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, মেয়েটির কণ্ঠ শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। মেয়েটি ঘুমোচ্ছে এখন।”
“মেয়ে কি জিনিস?”
“মেয়ে এক রকমের প্রাণী। ভদ্রলোক যে গোত্রের প্রাণী, মেয়ে হলো তার বিপরীত গোত্রের। একই রকম মস্তিষ্ক দু’জনেরই। অথচ শরীর আলাদা, মস্তিষ্কের উত্তেজনার ধরন আলাদা। বিষয়টা একটু জটিল।”
“আমাদের মধ্যে কেন মেয়ে নেই? তোমার কথা শুনে আমারও ইচ্ছে করছে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে।”
“সেটা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে মেয়ে-ছেলে আলাদা কোন ব্যাপার নেই। সত্যিকার গুবরে পোকার মধ্যে হয়তো আছে। আমাদের মধ্যে নেই।”
‘কেন নেই?”
“কারণ আমরা হলাম কল্পনার গুবরেপোকা। তুমি-আমি-এখানের সব গুবরে পোকাগুলো ভদ্রলোকটির কল্পনা।”
“তার মানে বলতে চাও, আমি যে তোমার সাথে কথা বলছি, সেটাও সত্য নয়, সেটাও এই মস্ত বড় মস্তিষ্কটির কল্পনামাত্র?”
“হ্যা আসলেই তাই। আমরা তৈরি হয়েছি মস্তিষ্কটির কিছু ক্ষতিকর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। আমাদের কাজ এটাকে বিরক্ত করা...”
আমি চোখ বন্ধ করে এই সব কথোপকথন থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছি, পারছি না। মনে হচ্ছে আমার চিন্তা আমাকেই নিয়ন্ত্রণ করছে। মস্তিষ্কের যেখানে কষ্ট থাকে, সেখানকার প্রশাসনিক কাজে বোধহয় আমার কোন ক্ষমতা নেই।
গুবরে পোকাদের চিৎকার বেড়ে গেছে। আমা শরীর ঘুমিয়ে পড়েছে, তবু হৃদয় কি ভীষণ রকম সজাগ! আমি কি ঘুমিয়ে আছি? জেগে আছি? বেঁচে আছি? স্বপ্নে আছি? না বাস্তবে আছি?
কে জানে!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৬