বাউল সাধক লালন শাহ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম ।
লালন ফকিরের জন্ম ও জাত নিয়ে অনেক মতভেদ আছে । যে বিষয়ে লালন গবেষকেরা এখনো পর্যন্ত একমত হতে পারেন নি । এই প্রশ্ন তাঁর জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল । লালন শাহ নিজেও তার জাত ধর্ম বিষয়ে জানাতে আগ্রহী ছিলেন না ।
অনেকের মতে তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । কথিত আছে যৌবনের শুরুতে ধর্মপরায়ণ লালন পূন্যলাভের আশায় একদিন সঙ্গী-সাথী নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান । গঙ্গা স্নান শেষে বাড়ী ফেরার পথে আকস্মিকভাবে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । ধর্মমতে লালনের অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়, সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে মৃত ভেবে মুখাগ্নি করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় । লালনের দেহ নদীর জলে ভাসতে ভাসতে কালিগাঙ্গের পাড়ে এসে পরে, একজন মহিলা তাঁকে দেখে নদী থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যান । যার সেবায় লালন সুস্থ্য হয়ে ওঠেন । এই মহিলাই ছিলেন মুসলিম ধর্মের অনুসারী লালনের পালকমাতা ফকিরাণী বিবি ।
বসন্ত রোগে লালনের মুখমন্ডলে গভীর ক্ষত ও এক চোখ নষ্ট হয়ে গেলেও, সুস্থ্য লালন নতুন জীবন ফিরে পেয়ে ফেরেন তাঁর প্রিয় গ্রামে, মায়ের কাছে । সন্তানকে জীবিত দেখে তাঁর মা আনন্দে আত্মহারা। স্ত্রী তাঁকে ফিরে পেয়ে সৃষ্টিকর্তাকে জানায় কৃতজ্ঞতা । কিন্তু সকল আনন্দ কিছুক্ষণের মধ্যে হারিয়ে যায় । কারণ লালন জীবিত ফিরেছে শুনে গ্রামের সমাজপতিরাসহ দলে দলে লোক তাঁকে দেখতে আসে । তাঁরা সাফকথা জানিয়ে দেয়, লালনের অন্তুষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, এছাড়া সে মুসলমান বাড়ির জল খেয়েছে, তাই তাঁকে আর এই সমাজে থাকতে দেয়া যাবে না । সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করা হয় । বিচ্যুত করা হয় মা ও স্ত্রীর কাছ থেকে । দারুন এক কষ্ট আর মর্মবেদনা নিয়ে লালনকে চলে যেতে হয় সমাজচূত হয়ে। লালনের সাথে তাঁর স্ত্রীও গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজের শাসন, লোকচক্ষুর ভয়, ধর্মের বেড়াজাল তার পায়ে শিকল পরিয়ে দেয় । এই দুঃখ যন্ত্রনা সইতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয় ।
যে ধর্মের জন্য গঙ্গা স্নানে যাবার ফলে লালনের জীবন বিপন্ন হতে চলেছিল, যে ধর্মের অজুহাতে তাঁকে সমাজপতিরা সমাজচ্যুত করেছিল, সেই ধর্মের নামে ভন্ডামির বিরুদ্ধে লালন আজীবন লড়াই করে গেছেন । মূলত: এখান থেকেই লালনের ভাবনার বিকাশ ঘটে । সমাজ বিচ্যুত লালন মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে এসে দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার প্রাণ পুরুষ । সিরাজ সাঁইকে গুরু হিসেবে গ্রহন করে লালন হয়ে উঠেন ফকীর লালন সাঁই ।
গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন।
সেই সময় লালন জাত-পাত,ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগানোর জন্য গান গেয়েছেন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে । লালন ফকিরের গান "লালন গীতি" বা "লালন সংগীত" নামে প্রসিদ্ধ । বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলাসহ বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে । বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর প্রায় সহস্রাধিক গান সংগৃহীত হয়েছে | মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন তাঁর হারামণি গ্রন্থে তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন।
সব ধর্মের মানুষের সাথে লালনের ভাল সম্পর্ক ছিল। সকল ধর্মের মানুষ তাঁকে আপন বলে জানতো। যার কারনে সকল ধর্মের মানুষই লালনকে তাদের ধর্মের ভেবেছে । মুসলমানের সাথে তাঁর আহার-ব্যবহার থাকায় মুসলমানরা ভাবতো তিনি মুসলমান, বৈষ্ণব ধর্মেও মত পোষণ করতে দেখে হিন্দুরা তাঁকে বৈষ্ণব মনে করতো । প্রকৃত পক্ষে লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তাই আজও সারা পৃথিবী থেকে বাউলসহ বিভন্ন জাত/ধর্মের মানুষেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালন শাহের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।
লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ধারনা পাওয়া যায় যে, তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না । ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর । তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না । তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোনও মূল্য ছিল না । তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে বলেছেনঃ লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।
বাউল সম্রাট লালন সাঁই কারও বিপদ দেখে বসে থাকতে পারতেন না । সেই সময় কুমারখালী থেকে প্রকাশিত “গ্রামবার্তা পত্রিকা’র” সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতন আর জুলুমের কথা তার পত্রিকায় প্রকাশ করতেন, তাই তার উপর হামলার জন্য জমিদার লাঠিয়াল বাহিনী পাঠায়। এই খবর পেয়ে লালন তাঁর শিষ্যদেও নিয়ে পাল্টা লাঠি হাতে জমিদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৮৯০সালের ১৭ অক্টোবর (বাং ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক)শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাঙলা আর বাঙালীর হৃদয়ের মানুষ বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন শাহ্ মৃত্যু বরণ করেন। যেদিন তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, ঐ দিনও সারারাত আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদেও সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।
লালন জীবদ্দশায় বলে গেছেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন কোন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী দাফন করা না হয় বরং যে ঘেও উনি বাস করতেন, সেই ঘরেই দাফনের কথা বলেন।