ধানমন্ডি থেকে বাসায় ফিরবো। বেশ দারুন ঠান্ডা বাতাস। ভাবলাম, বাসে করে গিয়ে এই আমেজ নষ্ট করার মানে হয় না। সময়-অর্থকড়ির বিসর্জন দিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলাম।
খুঁজতে খুঁজতে হয়রান! অবশেষে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ভাড়া দিয়ে পেলাম একটা।
প্যাডেলে দুটো চাপ দিয়েই গান ধরলেন চালক।
“কতদিন দেখিনি তোমায়………….”
গান শুনে বুকের ভেতর কেমন কেমন করে উঠলো। পুরনো সব প্রেমিকাগুলো মনের জানালায় একবার করে উঁকি মেরে গেল। বললাম, “গাইছেন যখন, একটু জোরেসোরেই গান!”
বেচারা আর স্বাভাবিক ভাবে গাইতে পারলেন না। একটু পর পর হেসে উঠেন। তারপরেও দুই-চার লাইন গাইলেন। বললেন, এটুকুই পারি।
দেখলাম উচ্চারণ অনেক ভালো।
[এরপরের কথোপকথন গুলো সরাসরি তুলে দেই।]
আমি: বিয়ে করসেন?
রিকশাচালক: নাহ।
আমি: তাহলে ভাড়া এত বেশি নেন কেন?
রি:চালক: মা-বাবা আছে না! তাদের ভরণ-পোষন করে করে ট্রেনিং নেই আর কি।
আমি: হুম!
রি:চালক: বিয়ে তো চাইলে করাই যায়। এতদিনে ২-৪ বাচ্চার বাপ ও হইতে পারতাম। কিন্তু পোলাপানের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার!
আমি: পড়ালেখা কতটুকু করেছেন?
রি: চালক: পড়সি ক্লাস ৫ পর্যন্ত। এরপর বয়স্ক স্কুল থেকে ক্লাস ৮ পর্যন্ত পড়সি।
আমি: ছেলেময়ে যাই হোক, অবশ্যই পড়ালেখা করাবেন। যে ভাবেই হোক।
রি:চালক: জি! নিজের জীবন গেলেও পড়াবো।
আমি: হুম! পড়ালেখা করলে মানুষের মনের চোখ খুলে চায়। অনেক বড় স্বপ্ন দেখার সাহস চলে আসে।
রি:চালক: আমি এই ক্লাস ৮ পর্যন্ত পড়ে সেটা টের পাইসি। আমার ছেলেকে আর্কিটেক্ট বানাবো।
আমি: ???
রি: চালক: আমি নিজেও আর্কিটেকচার নিয়ে পড়ালেখা করতেসি টুকটাক!
………………………………..
এবার ঘটনাটা খুলে বলা যাক।
একবার এক যাত্রী উঠে উনার রিকশায়। রিকশাচালকের কাছে মনে হলো কোন আর্টিস্ট।
তাই প্রশ্ন করলেন, Classification of Drawing নিয়ে।
যাত্রী মহোদয় বেশ অবাক হলেন, প্রশ্ন করলেন উনার কি কাজ এটা দিয়ে।
রিকশাচালক জবাব দিলেন, উনি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। বিল্ডিং এর ছবি। আর্কি নিয়ে বেশ আগ্রহ আছে।
নেমে যাওয়ার সময় ঐ যাত্রী ৫০০ টাকা দিলেন। বললেন, একটা স্কেচবুক আর নানা ধরনের পেন্সিল কিনে নিতে। তারপর ছবি এঁকে তার সাথে দেখা করতে।
রিকশাচালক; তার নাম সারোয়ার, তাই করলেন।
ছবি দেখে সেই যাত্রী বললেন, আপনার আঁকা-আঁকির সাথে আর্কিটেক্টদের ড্রয়িং এর অনেক মিল আছে। আমি আপনাকে সেটা আরো ভালোভাবে শিখাবো।
সেই রিকশার যাত্রী ছিলেন একজন শিক্ষক, আর্কিটেক্ট।
সারোয়ারের ভাষায় একজন পরশপাথর।
শুরু হলো অন্য যাত্রা । plan-section-elevation এর যাত্রা!
যাত্রী সারোয়ার, ঐ শিক্ষক চালক।
রিকশাচালক সারোয়ার আর্কিটারচার ছাড়াও পড়েন অর্থনীতি, ইংরেজী সাহিত্য, গণিত। সপ্তাহে ৩ দিন গিয়ে পড়েন।
সেই শিক্ষক সারোয়ারকে এমন ভাবে শেখান যেন, তিনি সহজেই বুঝতে পারেন।
হুমায়ূন আহমেদ, সুনীলের লেখা তার ভালো লাগেনা। পড়েন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যকদের অনুবাদ। পল্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে কেনেন সেই সব বই।
তার ভাষায়, “এই সব লেখা এক একটা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি, এসব পড়লে অনেক কিছু জানতে পারবো!”
……………………………………
প্রশ্ন করলাম, আপনার বন্ধুদেরকে পড়ালেখা করার কথা বলেন না?
বললেন, সবাইকেই বলি। কেউ কেউ এড়িয়ে যায়। কেউ কেউ শোনে।
যেমন একজন আছে গার্মেন্টেসে চাকরি করে। তাকে ক্লাস এইটের পড়াগুলো শিখিয়েছি। সে এখন ভালো অংক করতে পারে। জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতিও পারে। সুডোকু, পাজল বেশি পছন্দ করে। আরেক রিকশাচালক সে গল্পের বই অনেক পছন্দ করে। আরেকজন কমিকস বই পড়ে শুধু।
……………………………
জানালেন, Auto Cad শেখার ইচ্ছা আছে। বললাম, তাহলে তো কম্পিউটার লাগবে।
দাম? ৩০-৪০ হাজার। পুরোন অবশ্য ১৫-২০ এ পাবেন।
আমি বললাম, সমস্যা নেই! আপনার আত্নবিশ্বাস আপনাকে পথ দেখাবে।
এতকাল যখন দেখিয়ে আসছে, সামনের দিনেরও জ্বালানী এটাই।
নামার সময় একটা কার্ড দিলাম। ঠিক এক সপ্তাহ পর রাতে যেন আমাকে ফোন দেন।
……………………
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আর্কিটেকচার পড়ে একজন সারোয়ার কি হতে পারবেন জানিনা। Auto Cad শিখে উনার জীবনের কতটুকু সচল হবে সেটাও জানিনা।
কিন্তু, অন্য আর দশজনের চেয়ে কিন্তু একজন সারোয়ার আলাদা। আত্নবিশ্বাস, প্রতিজ্ঞা একজন মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার একটা নমুনা এই সারোয়ার।
……………………………
আমি ভাবছি ঐ শিক্ষকের কথা! যিনি কিনা এক পরশ পাথরের ভূমিকা পালন করছেন।
আমরা যদি আমাদের ব্যাসার্ধের মধ্যে যে সব সুবিধাবঞ্চিত মানুষ আছে তাদের জন্য নিজের সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য করি, তাহলে কিন্তু চারপাশে এক দারুন পরিবেশ গড়ে উঠবে।
শিক্ষা ব্যাপারটা যেন মোমবাতির মত। দেখুন, নিজে শিক্ষা পেয়ে সারোয়ার সাহেব তার আশেপাশের মানুষ গুলোকে সেটা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ক্লাস ৩ পাস একবন্ধুকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সেই বন্ধু এখন অবসর সময়ে গণিত অনুশীলন করে।
......................
আপনার বাসার যে ছেলে বা মেয়েটি কাজ করে সে কি লিখতে পড়তে পারে? বাসার দারোয়ান?
তাদের পড়ালেখা করার ব্যবস্থা করে দিন আজকেই!
প্রত্যেকটা মানুষ অমিত সম্ভাবনার আধার! সুতরাং কোন পেশার কোন মানুষকেই অবহেলা করা উচিত নয়।
.................
আপনিও পরশ পাথর হয়ে জ্বলে উঠছেন তো?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১১ দুপুর ১২:২৬