কনকনে হাড় কাঁপানো জার আর ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন রাত। ঘরের টিনের চালে টুপটুপ করে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ে সারা রাত। আয়েশা কুণ্ডলী পাকিয়ে তাঁর বাবার বুকের সাথে লেগে ছোট্ট ছোট্ট দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। আয়েশা মনে করে পৃথিবীতে সে একমাত্র একজন আর তাঁর বাবাও পৃথিবীতে একজনই। ছোট্ট আয়েশার ছোট্ট পৃথিবীতে একমাত্র বাবার একমাত্র মেয়ে! বাবার কাছে তাঁর শত সহস্র বায়না আর বায়না। বাজান আমার জন্য লজেস আনিও। বাজান আমার জন্য চুড়ি আনিও। বাজান আমার জন্য আলতা আনিও।
আয়েশার বাবা মোস্তফা সকালে গঞ্জের বাজারের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পুকুর পাড় ধরে ফসলি জমির আইল দিয়ে যখন হেটে যান, আয়েশা পুকুর পাড়ে ততোক্ষণ দাড়িয়ে থাকে যতোক্ষণ তাঁর বাবাকে দেখা যায়! পুকুর পাড়ে আয়েশা তাঁর ছোট্ট ছোট্ট হাত উড়িয়ে বাবাকে ডাক দেয় “বা - জা - ন”। সন্ধ্যায় যখন মোস্তফা বাড়ি ফেরেন পুকুরে গোসলের সময় কেরোসিনের কুপি হাতে আয়েশা দাড়িয়ে থাকে, ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার পিঠে ৫৭০ সাবান ঘষে দেয়। সারা দিনের গল্প করে। বাজান, আজকে ভুলু ঘেউ করে ফকির বিডিরে দৌড়ানি দিছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে আয়েশা হাসে। পুকুর ঘাটে কেউ নেই তারপরও বাপে ঝিয়ে কানে কানে ফিস ফিস করে কথা কয়, গোপন কথা! - পাছে কেউ আবার শোনে! বাজান, দাদীজান আম্মারে নিয়া এত্তোগুলান মোয়া বানাইছে, সব চাঙ্গে উঠায়ে রাখছে। দাদাজান সকালে চা খাইছে, আমারেও চা দিছে। বাজান, আমিতো মুড়ি দিয়া চা খাই। আয়েশার বয়স পাঁচ। সময় ডিসেম্বর, ১৯৭০।
ভৈরব বাজারে মোস্তফার কেরোসিন তৈলের দোকান। ১৯৭১ মার্চ মাস থেকেই নদী পথে গানবোট নিয়ে বাজারে বাজারে পাক হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে সহস্র সহস্র নিরপরাধ নিরহ মানুষ হত্যা করে দুঃখিনী মেঘনা তিতাস নদীতে কতো কতো লাশ ফেলে দিয়েছে, তার হিসাব নেই। কেউ কাউকে চেনার অবস্থা ছিলো না। জানার অবস্থা ছিলো না। কবর দেওয়ার অবস্থাও ছিলো না। দুঃখিনী মেঘনা আর তিতাস সহ সমগ্র দেশের শত শত নদীর বুকে ঠাই হয়েছে এমন কতো লাশের, জানা নেই। আশ্চর্য বিষয়, মেঘনা নদীর পানিতে ভাসমান একটি মস্তক বিহীন লাশের হাতে গামছায় বাঁধা ছিলো লাল ফ্রক জামা আর ছোট্ট ছোট্ট হাতের লাল সবুজ কাঁচের চুড়ি। সেই অভাগা লাশটি আর কেউ নন, তিনি ছোট্ট আয়েশার ছোট্ট পৃথিবীর একমাত্র বাজান মোস্তফা।
সময় থেমে থাকে না। টানা নয় মাস যুদ্ধের পর একদিন দেশ স্বাধীন হয়। অনেকে যার যার বাড়ি ফিরে আসেন, অনেকে আর কোনো দিনও বাড়ি ফিরে আসেন না। জীবন হয়তো চলতে থাকে কিন্তু আয়েশার জীবন থেমে থাকে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আয়েশা অক্লান্ত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে দূর পথে ও পথের প্রান্তে “তাঁর বাজান ফিরে আসবেন - এই পথ ধরে”। আজ আয়েশা বৃদ্ধ হয়েছেন, চুল সাদা হয়েছে, দৃষ্টি মলিন হয়েছে। - আজও তিনি ঘোলা চোখে এক বুক ব্যথা নিয়ে পথের প্রান্তে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর বাজান ফিরে আসবেন। দীর্ঘশ্বাস ।।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৭