(এক)
মেঘনা নদীর বুকে গঞ্জের বাজারে আড়তদার, ছোট বড় মাঝারি দোকানি সহ ক্রেতা বিক্রেতার খুবই ব্যস্ত দিন কাটে। সন্ধ্যার সাথে সাথে বাজারে জ্বলে উঠে কুপি, ভোমা কুপি, হারিকেন, হ্যাজাক বাত্তি আবার কোথাও কোথাও মশালও। দৈত্যাকৃতির বোয়াল মাছ আইড় মাছ দেখে তব্দা লেগে তাকিয়ে থাকতে হয় এতো বড় মাছ হয়? এইগুলো মাছ নাকি অন্য কিছু? বাজারে সারি সারি আড়ত মহাজনি ঘর আর দোকান। নারকেল ও গুড়ের আড়তের পরের গলি পান সুপারি সাদাপাতা খয়ের জর্দা আর তামাকের আড়ত। এই দিকে আসলেই জর্দা তামাক আর সাদা পাতার ঘ্রাণে মাথা ভনভন করতে থাকে। তামাকের ঘ্রাণ! তামাকের নেশা! দূর দূরান্ত বাজার থেকে আসা দোকানদার’রা কাপড়ের পোটলা করে টাকা পয়সা নিয়ে গঞ্জের বাজার হতে পান সুপারি সাদাপাতা তামাক জর্দা বাজার করে গয়না নৌকা করে ফেরত যান। দুনিয়ার এমন কিছু নেই যা গঞ্জের বাজারে পাওয়া যায় না। সময় - ১৯৬৯, ভৈরব বাজার, ভৈরব বাজার জংশন।
শক্ত সামর্থ্য মানুষ রহিমুদ্দি আর কলিমুদ্দি গয়না নৌকা থেকে সুপারির ঝাকি আড়তে নামায়। আবার পণ হিসেব সুপারি বিক্রির পর ঝাকি ঝাকি সুপারি ভাটি অঞ্চলের বাজারের যাত্রীর গয়না নৌকাতে উঠিয়ে দেয়। রহিমুদ্দি কলিমুদ্দি দুুই ভাই, তাদের বাড়িতে বউ বাচ্চা, মা বাপ, ভাইবোন বেবাক মানুষ নিয়ে বড় পরিবার বড় সংসার। দুই ভাইয়ের দুই বউই মাশাল্লাহ সুন্দরী, বাড়ি ঘরের রান্না সহ সকল হাতের কাজ দৌড়ের উপর করে। সুখি সংসার। অসুখ অশান্তির কোনো কারন নেই। রহিমুদ্দি আর কলিমুদ্দির কর্তা আড়তদার মনিলাল বাবুর মুখে সব সময় পান থাকে, পান মুখে সব সময় হাসি। মনিলাল বাবু হাসি খুশি দরাজ দিলের মানুষ। বেতন ছাড়াও টাকা পয়সা দুই হাতে বিলান। তারপরও একদিন রহিমুদ্দি আর কলিমুদ্দি গঞ্জের বাজার হতে কওয়া নেই বার্তা নেই গায়েব। গায়েব বলতে উধাও!
গঞ্জের বাজার হতে প্রতি বছর দশ বিশজন গায়েব হয়! কেউ জানে না এরা কোথায় যায়! এদের বাচ্চাগুলো হয় অনাথ আর বউগুলো হয় বেওয়া! মা বাপ ভাইবোন সহ বউ বাচ্চা বছরের পর বছর রহিমুদ্দি কলিমুদ্দির জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষার আর শেষ হয় না। মসজিদে শিরনি মানত করে। উঝা তাবিজ তুলা রাশির জাতক দিয়ে আয়না পড়া কিছুই বাদ যায় না। তারপরও রহিমুদ্দি কলিমুদ্দির আর খোঁজ মিলে না। ষাঁড়ের মতো শক্তি গায়ে আস্ত জোয়ান মর্দ কিভাবে গায়েব হয় এর কোনো কুল কিনারা হদিস আর হয় না। দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর যায় যুগের যুগ রহিমুদ্দি কলিমুদ্দি নিখোঁজ। ১৯৭১ আর ১৯৭৪ এর পর সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ ও পরিবার পরিজন তাঁদের নিখোঁজ মানুষ খোঁজ করা ছেড়ে দেন। তারপরও কেউ আশা ছাড়ে না, ঘোলা চোখে মাটির পথ পানে চেয়ে থাকেন দুঃখিনী মা আর চিরো দুঃখিনী বউ - যদি মানুষটা ফিরে আসে পুরোনো বাড়িতে পুরোনো সংসারে!
(দুই)
১লা জুন, ১৯৯১ শনিবার। কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া। সামার সাহেব এসেছেন তিন সপ্তাহের একটি বিশেষ ট্রেইনিংয়ে। শেরাটন সুবাং হোটেল এন্ড টাওয়ার্স (বর্তমান - হোটেল ডোরসেট গ্রান্ড সুবাং) এর ১০১১ নম্বর স্যুটে হয়েছে তাঁর থাকার ব্যবস্থা। দশম তলার এগারো নম্বর স্যুট। অত্যন্ত মূল্যবান ইরানের পুরু কার্পেটে মোড়ানো স্যুট। বিশাল জানালা। ডানলোপিলো ব্রান্ডেড মূল্যবান মেমোরি ফোম কিং সাইজ বেড ম্যাট্রেস আর আর হাঁসের পালকের বালিশ! সামার সাহেবের জীবনে এই প্রথম ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা। এতো আরামদায়ক বিছানা আর বালিশে অর্ধরাত ঘুম না হওয়ার পর সামার সাহেব কম্বল গায়ে দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে রাত পার করেন। রবিবার ভোর হতেই তিনি প্রায় ২০ কিলো পাড়ি দিয়ে মসজিদ ইণ্ডিয়া হতে দুইটি তুলার বালিশ সংগ্রহ করেন। কারণ সোমবার হতে ট্রেইনিং! আর এতো আরামদায়ক বিছানা আর বালিশে আর যাইহোক ২৮-৩০ দিন অঘুমা করে শরীরের উপর অত্যাচার সহ্য করা সত্যি সত্যি কঠিন বিষয়।
ট্রেইনিংয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইউএনএইচসিআর এর সাথে বার্মা থেকে আসা রিফিউজিদের নিয়ে ফিল্ডওয়র্কে সামার সাহেবের ঈগলের চোখ আরোও তীক্ষ্ণ হয়। শত মানুষের ভিড়ে লুঙ্গি পরিহিত লিকলিকে শরীরে কাঁচাপাকা বাবরি চুল আর দাড়িতে প্রায় ষাটোর্ধ্ব বয়সের দুইজন পাশাপাশি দাড়িয়ে সাথে রোহিঙ্গা পরিবার। লিকলিকে দুর্বল শরীর হলেও বোঝা যায় কোনো এক কালে কালশে তামাটে রঙের এই শরীর ছিলো বেশ মজবুত, ছিলো শক্তি। সেই শক্ত সামর্থ্য মানুষ আজ বয়সের ভার আর দুঃখতাপে ন্যুব্জ! সামার সাহেব এগিয়ে যান। অনেক কাছে প্রায় মুখোমুখি দাড়িয়ে দুইজনকে হতবাক হত বিহ্বল করে দিয়ে বলেন - আপনি রহিমুদ্দি আর আপনি কলিমুদ্দি?
আত্মকথা: সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পটি লেখা হয়েছে। গল্প এখানেই শেষ নয়। তারপরও গল্পের প্রয়োজনে গল্প এখানেই শেষ করতে হয়েছে। বাইশ বছর! অনেক অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর! প্রায় দুই যুগ পর তাদের কেউ চিনবেন - খোঁজে পাবেন এটি সত্যি সত্যি বিস্ময়কর! তাই হয়তো গল্পের নামকরণ - পালাবে কোথায়?
উপসংহার: বাংলাদেশে প্রচুর নারী পুরুষের - বাচ্চা সহ ও বাচ্চা ফেলে সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। কেনো এমনটি হয়েছে তার ব্যাখ্যাতে না যাই। তবে এটি সত্য এই দেশে পুরুষ যেমন সংসার ছেড়ে পালিয়ে যান ঠিক তেমনই নারীও কম নন। প্রচুর নারী সংসার ছেড়ে পালিয়েছেন। হয়তো পাশের গ্রামে, হয়তো পাশের জেলাতে, নতুন শহরে অথবা পালিয়ে গিয়েছেন দেশ হতে দেশান্তরে। যেমনটি গল্পের রহিমুদ্দি আর কলিমুদ্দি। বিশেষ করে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, কলিকাতা আর বার্মা কি পরিমান বাংলার মানুষ হজম করে নিয়েছে তা যেমন তেমন রূপকথাকেও হার মানাবে।
উৎসর্গ: হাসান কালবৈশাখী ভাইকে তাঁর পোস্টে ১৩ নং মন্তব্যে কথা দিয়েছিলাম - মানুষ পালিয়ে যাওয়া ও হারিয়ে যাওয়া বিষয়ে আমি লিখবো। আশা করি কথা রাখতে পেরেছি। গল্পটি তাই হাসান কালবৈশাখী ভাইকেই উৎসর্গ করছি।
ছবি: সুলতান আবদুল সামাদ বিল্ডিং। পুরাতন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট ভবন। কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ। নির্বাচিত পোষ্টে “উক্ত লেখাটি” স্থান দেওয়াতে সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।