ঊর্দু ও আমাদের অবস্থান
আমার দুই সহপাঠী ছিল, যাদের অরিজিন নিয়ে বলতে গিয়ে তারা বলতো তাদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্থান ও ইরান থেকে এসেছিল। আর সেটা নিয়ে তাদের গর্বের সীমা ছিল না। একটু খুলে বলি...
প্রথম জন... তার দাদা নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় বাড়ি করেছেন, কিন্তু তিনি যুবা বয়সে রাজশাহী বা নাটোর থেকে নারায়নগঞ্জে ব্যাবসা করতে এসেছিলেন। আমরা বললাম যে তাহলে তোদের বাড়ী উত্তরবেঙ্গে? না, তার দাদার বাবা এসেছিলেন মূর্শিদাবাদ থেকে। কিন্তু সেটাও তাদের বাড়ি না বা অরিজিন না। তার প্রপিতামহের বাবা এসেছিলেন আফগানিস্থান থেকে, আর তার বাবা এসেছিলেন ইরান-তুরান জাতীয় কোন এক চুলা থেকে। চুলা কথাটা রাগ করে বলা, কারন সে তাই ক্লেইম করতো। আমরা ইতিহাস ঘেটে প্রমান করে দিয়েছিলাম যে ইরান থেকে আফগানিস্থানে এক পুরুষ কাটিয়ে এই দেশে আসার কোন নজির সেই তিন হাজার বছর আগে আর্যদের পরে আর নেই। আমরা এও প্রমান করে দিয়েছিলাম যে তার পূর্বপুরুষ দারিদ্রের জন্য এই দেশে এসেছিল, আর এখানে এসেও খুব সুবিধা করতে পারে নি, মানে খুব একটা পয়সা কামাতে পারেনি বলে ইরান বা যেখান থেকেই এসে থাকুক না কেন, ফেরত যেতে পারে নি। তাই এই দেশে রয়ে গেছে। তার ইরান থেকে আসা আভিজাত্যের মুখে আমরা নির্দয়ভাবে চুন কালি মেখে দিয়েছিলাম বলে তার কি রাগ।
দ্বিতীয় জন... সে তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস নিয়ে খুব একটা ব্যাখ্যার মধ্যে যায় নি, কিন্তু প্রথমজনের ইরানী আভিজাত্যের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আফগানিস্থান পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়, কারন ততক্ষনে সে বুঝে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে তার আভিজাত্য কল্কে পাবে না। সে আর বিস্তারিক ইতিহাস বর্ননায় যায়নি কারন তার বর্তমান আভিজাত্য নিয়েও আমরা টানাটানি শুরু করে দিতে পারি এই ভয় তার মধ্যে ছিল।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মিক্সড জাতিগুলোর মধ্যে বাঙ্গালী অন্যতম। কারন এক সময় এইখানে সম্পদ ছিল অঢেল। আর্যদের থেকে শুরু করে ইংরেজ ও তার পরে পাকিস্তানিরা পর্যন্ত। অন্যরা কেউ রয়ে গিয়েছে, কেউ চলে গিয়েছে, কিন্তু ক্ষতি খুব বেশি একটা করে নি, কিন্তু শেষ দুইটা জাতি(পাকিস্তানিদের আলাদা জাতিস্বত্বা বলা যায় কি না জানি না) ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশী। আর্যরা ভারতবর্ষে এসে ভারতীয় হয়েগিয়েছে, গ্রীকরা এসে কিছু রয়ে গিয়েছে, কিছু চলে গিয়েছে, মুসলমানরা এসেও রয়ে গিয়েছে। তার পর এসেছে মুঘলরা, এরা এসে শুধু রয়েই যায় নি, পুরো ভারতবর্ষকে এক করে দিয়েছে। আর বৃটিশরা সেই জড়ো করা ভারতবর্ষকে দুইটা ভাগ করে রেখে গিয়েছে, তাও আবার ধর্মের ভিত্তিতে। এমনি সেই বিভক্তি যে ভারতের আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠির নিজেদের মধ্যেই ছড়িয়ে পরেছে সেই সাম্প্রদায়িক বিভক্তি। বাঙ্গালী পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান দুই ভাগে বিভক্ত। আর পাকিস্তানিদের কথা তো মুখে আনার মতো না। তারা যেহেতু ইরান-আফগানিস্তান-আরবের বেশী কাছে, তাই তাদের ধর্ম বেশী খাঁটি, আভিজাত্যে অনেক উন্নত। আর আমরা বাঙ্গালীরা যেহেতু হিন্দুর জাত, তাই আমারা মুসলমান হয়েও অনভিজাত, নিচু জাতির মুসলমান (এই ব্যাপারটা হিন্দুদের মধ্যেও আছে, যারা যতো পশ্চিমের, তাদের হিন্দুত্ব ততো বেশী খাঁটি)।
আবার বাংলায় ফিরে আসি... সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রথম বাংলায় মুসলমানদের আগমন, ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর হাত ধরে। লক্ষন সেন ভয় পেয়ে পালিয়ে না গেলে হয়তো মাত্র সতরো জন ঘোড়াচোরের এই দলটাকে আটকে দিতে পারতেন, বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। যদিও আমাদের ইতিহাস বলে মহাবীর ইখতিয়ারুদ্দীন মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলা দখল করেছিলেন। ইসলামের কি অনন্য শক্তি। ইতিহাস যাই বলুক না কেন, সত্য হলো সেই থেকে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের শুরু। তার পর থেকে শাসকদের সাথে সাথে অন্যান্য পেশাজীবিদেরও আসা শুরু হয় বাংলায়। কেউ এসেছিল চলে যাবার জন্য, কেউ থেকে যাবার জন্য, কিন্তু বাংলা সবাইকেই আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু যারা আসেছিল, তারা কি সবাই বাংলাকে আপন করতে পেরেছিল?
ইসলাম আমাদের জন্য খারাপ ছিল না ভাল, সেই তর্কে যাব না, কিন্তু ইসলামের প্রচারক হিসেবে আমাদের দেশে আসা সাধু-সন্তরা দেশটাকে আপন করে নিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। কিন্তু গোল বাঁধে মূলত পেশাজীবিদের নিয়ে। তাদের বেশিরভাগই সাধারনের সাথে মিশে গেলেও একটা বড় অংশ মিশে যেতে পারেনি। মুঘল আমলেই মূলত এদের আগমন। এদের অরিজিন মূলত ইরান-তুরষ্ক, কিন্তু মুঘলদের সাথে সাথে আগমন বলে এরা এমন একটা ভাষায় কথা বলে যেটা তাদের মূলভাষাটাকেও ধরে রাখবে, আর এদেশের মানুষের সাথেও আলাপ চালাতে পারবে। ঠিক এইখানেই উর্দূ ভাষাটার জন্ম। এর উদ্ভাবক মূলত মুঘল সৈন্যরা, কিন্তু এই ব্যাবসায়ী শ্রেণী এটাকে খুব আপন করে নেয়। একটা কথা অনেকেই হয়তো মানতে চাইবে না, ভারতের(বাংলার না কিন্তু) মানুষ মুসলমান ধর্মটাকে গ্রহন করে নি, তাই তাদের মধ্যে ইসলাম গ্রহন করা মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম, মূলত পশ্চিম থেকে আগত জনগোষ্ঠীই ভারতের মূল মুসলমান জনগোষ্ঠীর বড় অংশ। সেই কারনে উর্দু হয়ে গেল ভারতে মুসলমানদের ভাষা। তারা যেখানেই যায়, উর্দুতেই কথা বলে। তা সে বাংলাদেশেই হোক আর দক্ষিন ভারতেই হোক।
ঢাকায় মুঘলদের আগমনের সাথে সাথে এই অভারতীয় বনিকরাও চলে আসে তাদের সাথে সাথে। সেই সময়ের মুঘল ঢাকা মূলত অবাঙ্গালী ও অভারতীয় বনিকদের একটা শহর, সেখানে সবাই মূলত উর্দুভাষী। সময়ের সাথে সাথে অনেকে চলে গেলেও অনেকেই রয়ে গেল ঢাকায়। তারা ঢাকাবাসী, বাংলার অন্য অংশের সাথে তাদের কোন সংযোগ ছিল না। হয়তো দু'শ বছর ধরে ঢাকায় আছে, কিন্তু মনে প্রাণে তখনো ইরানী, যদিও ইরানের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই নেই, ইরানী ভাষাটা পর্যন্ত এখন আর বলতে পারে না, এখন উর্দুই ভরসা। এরা যে শুধু মুঘলদের সাথে আসা মুসলমান বনিকদেরই উত্তরপুরুষ, সেটা কিন্তু না, বিভিন্ন সময় অন্যানরাও এসেছে। আর্মেনিয়ানরা এসেছে, ফ্রেঞ্চরা এসেছে, চাইনিজরা এসেছে, ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে হিন্দু বনিকেরা এসেছে। কিন্তু কখনোই তাদের স্বকীয়তা হারায় নি।
এই শ্রেণীটা বাংলার জন্য কখনোই ভাল কিছু করে নি। তারা সব সময়ই তাদের ব্যাবসায়ীক স্বার্থটাকেই বড় করে দেখেছে। ঢাকার নবাবরাই তার সবচেয়ে বড় প্রমান। তারা যেহেতু ঢাকার শাসক ছিল, প্রজাদের সর্বোচ্চ সমীহ আদায় করার জন্য তারা তাদের মুর্খ করে রাখার জন্য কোন বিদ্যালয় পর্যন্ত স্থাপন করে নি। মীর জাফর, জগৎ শেঠ, রাজভল্লভ, যাদের আমরা সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের প্রধান কারন বলে মনে করি(সত্যিই তাই), তারাও মূলত ঢাকা কেন্দ্রীক অবাঙ্গালী ব্যাবসায়ী। তারা তাদের ব্যাবসায়ীক স্বার্থটাকে বড় করে দেখেছিল বলেই ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। অথচ রাজকোষের অর্থের জোগান কিন্তু তারাই দিত। সিরাজের রাজকোষের শুধু না, সেই সময়ের মূর্শিদাবাদের সবচেয়ে বড় করদাতা ছিল মীর জাফরের পরিবার।
ঢাকা থেকে রাজধানী মূর্শিদাবাদে চলে যাবার সাথে সাথে বড় বড় ব্যাবসায়ীরাও চলে যায় ঢাকা থেকে। কিন্তু যেসব ব্যাবসায়ীর যাবার সাধ্য ছিল না(মূলত আর্থিক কারনে-মানে তাদের পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থান ছিল না যে ঢাকা থেকে চলে গিয়ে মূর্শিদাবাদ বা অন্যকোথাও বসতি স্থাপন করতে পারবে) তারাই রয়ে গেল ঢাকায়। আর সেই সাথে স্থানীয় বাঙ্গালীরাও ততোদিনে খানিকটা উঠে এসেছে। বৃটিশ ঢাকা হয়ে গেল মূলত একটা ছোট্ট বানিজ্যিক শহর। ঢাকা থেকে তখন বরিশাল, যশোর অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। রেল আসার পর চট্টগ্রাম। কিন্তু ঢাকা যা ছিল, তাই রয়েগিয়েছিল অনেক দিন, সেই ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত। ঊনিশ শতকের শেষাশেষি এসে ঢাকার বানিজ্যিক ঠিক না, তবে প্রশাসনিক গুরুত্ব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই যে অবাঙ্গালী ঊর্দুভাষী বনিক শ্রেণী, তাদের কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় নি। তারা তখনো ঊর্দুতেই কথা বলে, ঢাকার বাইরে যে একটা জগৎ আছে, তার সাথে কোন সংস্রব নেই। বৃটিশরাও তাদের কোন বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেয় নি, আর মুসলমান বলে তারাও বৃটিশদের সাথে খুব একটা মাখামাখি করে ক্ষমতার ভাগ নেয় নি, যদিও ঢাকার নবাবরা মুসলমান ছিল। তারা নিজেদের ঢাকা নিয়েই সুখে ছিল।
বৃটিশরা যখন হিন্দু মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করে দিয়ে গেল, পাকিস্তানি ইসলামী সরকার ক্ষমতায় এলো, সাথে এলো পাকিস্তান থেকে মুসলমান ব্যাবসায়ীর দল, তখন সম্ভবত ঢাকার আদিবাসী বনিকেরা(বলা ভাল অবাঙ্গালী ঢাকাইয়ারা) খানিটা স্বস্তি পেল। একটা কারন অর্থনৈতিক, আরেকটা কারন মুসলমান হিসেবে খানিকটা গুরুত্ব পাওয়া। বৃটিশরা তো তাদের খানিকটা উপেক্ষাই করতো, আর তারাও বৃটিশদের কাছে ঘেষতো না। মুসলমান হিসেবে তারা দেখলো পাকিস্তান রাষ্ট্রটা তাদের জন্য খুবই ভাল, উপরন্তু পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র... বৃটিশরা সাম্প্রদায়িকতাটা ভাল করেই মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মে ঢাকার উর্দুভাসী আদিবাসীরা খুব একতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পাকিস্তানকে আপন করে নেয়, যেটা তারা আগের চারশ বছরেও পারেনি, মানে বাংলাকে আপন করতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা তো আর পুরো বাংলা না, তাই পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই যখন পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলস শুরু হয়ে যায়, তখন এই উর্দুভাষী ঢাকাইয়ারা তাদের বিরোধীতা করে। তাদের রাষ্ট্র পাকিস্তান, আর পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন তারা সমর্থন করেনি। আর ব্যাপারটা যখন পাকিস্তান ভাঙ্গার পর্যায়ে চলে যায়, তখন তারা সরাসরি সরকারি পক্ষ অবলম্বন করে বাঙ্গালীদের শত্রুতে পরিনত হয়। তারা যদি আগের চার শ' বছরে বাংলাকে আপন করে নিত, তাহলে তারা এভাবে বাঙ্গালীদের আন্দোলনের বিরোধীতা করতে পারতো না বা যে কোন কারনেই হোক না কেন পাকিস্তানকে সমর্থন জানাতো না। যেটা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় থিতু হয়ে বসা তাদের সমসাময়িকরা পেরেছিল। তারা কিন্তু ততোদিনে পুরোপুরি বাঙ্গালী বনে গিয়েছে, আর ঢাকার বনিকেরা হতে পারে নি। এটা একসাথে অনেক মানুষ গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে বাস করার জন্যই হোক আর ব্যাবসায়ীক স্বার্থের কারনেই হোক। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা জানেন যে বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষ এসেছিল অন্যদের মতো পশ্চিম থেকে, মানে ইরান বা আফগানিস্তান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য। সেই অবাঙ্গালী অরিজিনের একজন মানুষ বাংলার ত্রাতা হয়ে গেলেন, আর ঢাকার আদিবাসীরা দেশটাকে আপনই করতে পারলো না কয়েকশ' বছর ধরে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে যারা সরাসরি সরকারকে সমর্থন করেনি, তারা নিষ্কৃয় হয়ে বসেছিল। ঢাকার সর্দারদের দলে টানার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কাছে দূত পাঠিয়ে বোঝাতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেবার জন্য। ঢাকারাদিবাসীরা উর্দুতে কথা বলে, আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষাও উর্দু, আর তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাঙ্গালীদের আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিল, তার ওপর পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালীদের ভাষা বাংলা কেড়ে নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চেয়েছিল, এই সব মিলিয়ে উর্দু ভাষাটা বাঙ্গালী চেতনার এতোটাই বিরোধী হয়ে গিয়েছে যে স্বাধীনতার ইতিহাস ও ৭১ এর শোকের ওপর উর্দু এখন লবনের কাজ করে। উর্দু এখনো আমাদের জ্বালায়। জ্বালাবে না কেন! পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের ক্ষত তো এখনো শুকোয় নি। অন্যদিকে কোলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে উর্দু তাদের আর দশটা ভাষার মতোই, তাদের তো ৭১ এর ক্ষত নেই, তাই ঊর্দুতে জ্বলনও নেই, যেটা আমাদের পুরো মাত্রায় আছে।