শশুরবাড়ি গিয়ে মেয়েদের খাপ খাওয়ানোর ভীতিটা বেশির ভাগই শহর কেন্দ্রিক। যার কারনে একান্নবর্তী পরিবার দূরের কথা ছোট খাটো যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। আলাদা হয়ে যাচ্ছে সবাই। মেয়েরা বিয়ের আগেই আলাদা হবার চিন্তা করে, প্ল্যান করে। তারা যৌথ পরিবারে থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না। তারা স্বাধিন একটা রাজ্য চায়।
এ ট্রেন্ড বেশিদিনের নয়। স্যাটেলাইট টিভির কল্যানে সিরিয়াল নাটকের মাধ্যমে নারীরা অনেক কিছুই শিখে নিচ্ছে যা না শিখলেও তাদের চলে। তারা শিখছে কিভাবে শশুর বাড়ি গিয়ে মারপ্যাঁচ খেলতে হয়, এই ইস্যুতে সবার আগে আসে শাশুড়ির সাথে প্রতিদ্বন্দিতা। মায়ের কথা ছেলে শুনবে নাকি বৌয়ের কথা মতো চলবে এই একটা ব্যাপার দুই নারীর মাঝে দূরত্ব তৈরি করে। সংসারের অনেক খুটিনাটি ব্যাপার নিয়ে তখন তৈরি হয় সমস্যা। আর ছেলের আয় যদি একটু বেশি হয় তো ছেলের বউ মহারানী। তিনিই সংসারের কর্তী হয়ে ওঠেন। এই সমস্যাগুলো বেশির ভাগই শিক্ষিত নারীর ক্ষেত্রে বিরাজমান। যাদের স্বাধিন জীবন যাপনের সুযোগ বেশি, সামর্থ্য বেশি।
যার ফলশ্রুতিতে এই ঢাকা শহরেই প্রতি বছর ৬০০০ এরও বেশি নারী তাদের স্বামীদের ডিভোর্স দেয়!! সংখ্যাটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে পরকিয়ার ব্যাপারটা মুখ্য হলেও সাংসারিক টানাপোড়নও এর প্রধান কারণগুলোর একটি।
বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে এখনো এই ট্রেন্ড যায় নাই। মেয়েরা কোন রকম চিন্তা ছাড়াই সংসারে আগ্রহী। যদিও প্রযুক্তির ছোঁয়া বা স্বাবলম্বী হবার ট্রেন্ডটা সেখানেও চলে গেছে। তাই, আলাদা করে গ্রাম, শহর বলার মতো শব্দটাও একদিন চলে যাবে!
বিয়ের পর মেয়েদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জই থাকে এই প্রতিকূল পরিবেশটাকে অনুকূল করা। ননদ, ননশ, দেবর এদের সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। সাধারণত: স্বামী যদি কোন পরিবারে অপাক্তেয় টাইপ হয়, তখন তার বউ যতই লক্ষি হোক না কেন তার প্রেসারটা বউয়ের উপরেও এসে পড়ে। আর স্বামী যদি একটু মোটা মানিব্যাগওয়ালা, জনপ্রিয় হয় তো তার বউ যতই গিরিঙ্গিবাজ হোক না কেন সে একটু বাড়তি সুবিধা নিয়ে নেয়।
তাই, আজকাল মেয়েরা যৌথ পরিবারে সংসার করতে চায় না। বেশির ভাগ শিক্ষিত নারীই চায় তারা যেন আলাদা করে নতুন সংসার শুরু করে। যে সংসারে তার মতামতই উপরে থাকবে। আর সেই নারীটি যদি চাকুরীজীবি হয় তো কথাই নাই। তার কাছে প্রতিটি দিনই একটি করে নতুন সংসার, নতুন মানুষ, নতুন জীবন।
যৌথ পরিবার আজকাল দেখতে পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক পরিবারের মুরব্বীরাও তাদের সন্তানদের আলাদা থাকার পক্ষে রায় দেন। তারা জানেন এখনকার ছেলে বা ছেলে বউরা অন্যরকম। তাদের সেকেলে চিন্তাধারার তুলনায় সন্তানদের চিন্তাধারা অনেক পার্থক্য। এই ধরনের আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবারের কর্তা/কর্তী নিয়ম করে তাদের সন্তানদের আত্মীয়ে বাড়ি, দাদার বাড়িমুখী করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টা তেমন সফল হয় না। শহরে এমন অনেক কিছুই আছে যা আধুনিক সন্তানদের ব্যস্ত রাখতে সহায়তা করে। তাই, দিন দিন আত্মীয়দের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা যায় বছরে একবারও হয়তো তারা দাদা বাড়ি বেড়াতে যায়নি! কিন্তু ঠিকই নানা বাড়ি যায়! যাদের যে বিষয়ে সম্পর্কে ধারনা জন্মায় না তারা সে বিষয় সম্পর্কে একটা অজানা ভীতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠবে সেটাই স্বাভাবিক।
যৌথ পরিবারে যারা বড় হয়েছে তারা ভালোভাবে জানে যৌথ পরিবারের কি মানে। কি শিক্ষা পাওয়া যায়। কিভাবে কি আদর্শে বেড়ে উঠা যায়। একক পরিবারে সে সুবিধা নাই। বাবা মা চাকুরীজীবি হবার সুবাধে তারা বেড়ে ওঠে কোন চাইল্ড কেয়ার হোমে কিংবা কাজের বুয়ার তত্ত্বাবধানে। বদ্ধ ঘরে। আত্মকেন্দ্রিক জগতে। তাদের সব আবদারই তাদের বাবা/মা পুরণ করে কিন্তু মনেরও যে একটা সুষ্ঠু জগত আছে, একটা সুন্দর বাড়ি আছে, একটা সুন্দর জানালা আছে... সেই মনের বাড়ি/জানালা/জগত সম্পর্কে কী আধুনিক বাবা মা সচেতন? তারা তাদের এভাবে বেড়ে ওঠা সন্তানদের কাছ থেকে কতটুকু কি প্রত্যাশা করতে পারে? তাদের ভেতরে কি মানবতার বিকাশ ঘটে নাকি মানবতা শূণ্যতায় বদলে যায়?
একক পরিবারের বেশির ভাগ পুরুষই স্ত্রীর মতামতকে মেনে নেয়। অনেক কারনেই। অর্থনৈতিক ব্যাপার আছে, স্ট্যাটাসের ব্যাপার আছে, ইন্দ্রীয়ের সামর্থ্যের ব্যাপার আছে! তবে, ছাড় দিতে দিতে একদিন সে নিজেই তার স্ত্রীর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে যায়! এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। কিন্তু সেটা এতটাই সীমিত যে কোন উদাহরনে তা রাখা যায় না।
বিশেষ করে ঢাকা শহরের একক পরিবারগুলো খুব একটা সুখে নেই। অনেকেই মাঝে মাঝে ভোল পাল্টে গ্রামে চলে যাবার প্ল্যান করে। কিন্তু সেটা এক বা কয়েকটি বেদনাময় রাতের আকাঙ্খা। দিনের আলোয় তারা আবার শহরপ্রেমি।