কেকা ফেরদৌসী একজন জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী; তার আন্টিসুলভ টোনে, বাচ্চা বাচ্চা তথা অপাপবিদ্ধ কন্ঠের রেসিপি বর্ণনা সবার মনেই তার সম্পর্কে একটি ধনাত্মক উপলব্ধি সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ করেই দর্শকরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল, তিনি যেন বাংলার যাবতীয় খাদ্যে নডুলসের ব্যবহারকে অপরিহার্য করে তুলছেন। তার স্থূলকায় গাল, হাত ও শরীর এড়িয়ে একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দর্শকের নজরে পড়ল- ’ডেকো নুডলসের রকমারী রেসিপি: তারকা রান্না’। আর যায় কোথায়! বাঙ্গালিকে এত বোকা ভাবা কি ঠিক? সে ঠিকই দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে নিল।
সাথে সাথে বাঙ্গালির মর্দাঙ্গি দেখানোর একমাত্র ক্ষেত্র ফেসবুকে যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্রল করতে। এদিকে কিছু সুশীল শ্রেণীর সদস্যকে কেকা ফেরদৌসীর বাংলাদেশের রান্নায় অবদান, আন্তর্জাতিকায়ন, ফিউশন- ইত্যকার নানা অযুহাত তুলে তাকে সুরক্ষা দিতেও দেখা গেল।
আমি বরাবরই গরম গরম বিষয়গুলো নিয়ে তাওয়া গরম থাকা অবস্থায় মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকি। বরং বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি নিয়ে ঘটনার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণে আমার আগ্রহ বেশি। কেকা ফেরদৌসীর রেসিপি নিয়ে নিন্দা-মন্দ একটু থিতিয়ে আসতেই আমার হাতে এসে পড়ল, Michael Moss-এর পুলিৎজার পুরষ্কার পাওয়া একটি বই- Salt Sugar Fat: How the Food Giants Hooked Us। এর কিছু অংশ পড়ে আমেরিকার পনির উৎপাদন ও বিপণনের এক চেপে যাওয়া ইতিহাসের সাথে কেকা ফেরদৌসীর নডুলস জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের কিছু আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পেলাম। পাঠকের সাথে সেটি ভাগাভাগি করতেই এ লেখার অবতারণা।
চীজ তথা পনির বিশ্বের প্রায় সব এলাকার মানুষের কাছে সুপরিচিত ও বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। ইউরোপের বেশ কিছু দেশে খাবারটি কেবল সকালের নাস্তা বা প্রাতঃরাশের সাথেই খাওয়া চলতো শত শত বছর ধরে। আমেরিকাতেও এটি খাওয়া হতো প্রধাণতঃ বাড়িতে মেহমান আসলে, মূল খাবারের (মধ্যাহ্ণভোজ অথবা নৈশভোজ) আগে ক্ষুধাউদ্রেককারক হিসেবেই। আর পনিরের উৎপাদন হতো গ্রামের খামারবাড়িগুলোতে গরুর দুধের উপজাত হিসেবে। ১৯১২ সালে জেমস লুইস ক্র্যাফট (যার বদৌলতে আজকের জনপ্রিয় পনিরের ব্র্যান্ড Kraft Cheese এর নামটি এসেছে) প্রথমবারের মতো শিকাগো শহরে বাণিজ্যিকভাবে পনির উৎপাদন ও বিক্রয় শুরু করেন। ১৯৭০ সালে পনির উৎপাদনের এনজাইমটি পৃথক করে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হলে ক্র্যাফটের ভাগ্য হঠাৎ করেই খুলে যায়, পনিরের উৎপাদন এক লাফে ৭০% বৃদ্ধি পায়।
ক্র্যাফটের ভাগ্য খুলে গেলেও অন্যদিকে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব হয়। অতি অল্প সময়ে এত বেশি পরিমাণে পনির উৎপাদিত হতে থাকায় টনের পর টন পনির ও আরও নানা দুগ্ধজাত পণ্যে সয়লাব হয়ে যায় গুদামগুলো। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, সরকারের পক্ষে এত উদ্বৃত্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য গুদামজাত রাখতেই খরচ হয়ে যেতে থাকে বছরে ৪ বিলিন ডলার! জায়গার অভাবে ক্যানসাসের এক পরিত্যক্ত চুনাপাথরের খনিতে উদ্বৃত্ত দুগ্ধজাত সামগ্রী মজুদ করে রাখতে বাধ্য হয় আমেরিকান সরকার। এ দুগ্ধজাত খাবার, বিশেষ করে পনির কীভাবে মানুষের ভোগে লাগানো যায়- তা নিয়ে সরকার ও পনির উৎপাদকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় ক্র্যাফট কোম্পানি এক অভিনব ফন্দি বের করে। তারা ঠিক করে, মানুষ যে প্রক্রিয়ায় পনির খায়, সে পদ্ধতিতে খেতে থাকলে এত পনির কোন দিনও বিক্রি করে শেষ করা যাবেনা। কাজেই পরিবর্তন করতে হবে মানুষের খাদ্যাভ্যাস। কী করে তা করা হবে? তারা সিদ্ধান্ত নিল, শুধু খাবার হিসেবে নয়, পনিরকে পরিচিত করে তুলতে হবে খাবারের ইনগ্রেডিয়েন্ট বা খাদ্যপ্রস্তুতকরণ উপাদান হিসেবে। এটি করা গেলে মানুষ তখন সব কিছুর সাথে কম বেশি পনির মিশিয়ে খাওয়া শুরু করবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত দ্রুত কী করে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এমন আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব? বিপণন প্রতিভাগণ তখন এটিরও সমাধান নিয়ে এগিয়ে এলো। তারা এমন উদ্ভট খাদ্যকে জনপ্রিয় করতে টেলিভিশনে চালু করল রান্নার অনুষ্ঠান- যার শ্লোগান ঠিক করা হলো-'রিয়েল ওম্যান'। ক্র্যাফটের অর্থায়নে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকা হিসেবে হাজির করা হলো জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী 'পলা ডীন'কে। অনুষ্ঠানটির নাম হলো- 'পলা'স হোম কুকিং'। স্পনসরের অঙ্গুলিহেলনে পলা দিনে দিনে জনপ্রিয় করে তুলল এমন সব খাবার, যা ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটে পরিপূর্ণ। নানা হাস্যকর রেসিপিতে সয়লাব হতে লাগল তার একেকটি এপিসোড। তার নিজের অনুষ্ঠানের বাইরেও ক্র্যাফটের গোপন অর্থায়নে নির্মিত নানা টক শো, কুইজ শো, গেম শো ইত্যাদিতেও ঘন ঘন দেখা যেতে লাগল পলা ডীনকে।
বলাই বাহুল্য, পনিরের ব্যবহার গেল ঘরে ঘরে বেড়ে, আর ক্র্যাফটের এ্যাকাউন্টও উঠল ফুলে ফেঁপে। পলা ডীনকে নিয়ে সে সময় আমেরিকায় আমাদের কেকা ফেরদৌসীর মতো হাসি ঠাট্টা হয়েছিল কিনা জানিনা, তবে হলে হয়ত সেটা তার জন্যই ভালো হতো। কারণ, প্রায় এক দশক অনুষ্ঠান চালানোর পর এক টক শোতে সে স্বীকার করলো, প্রায় তিন বছর আগে থেকে সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা জানালেন, পলা যে খাবারগুলো আমেরিকার ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তুলেছে, সে খাবারগুলোই ডায়াবেটিস রোগের অব্যর্থ সদর দরজা।
আমি জানিনা আমাদের কেকা ফেরদৌসীও এমন কোন বিপণন 'প্রতিভা'র পাল্লায় পড়ে নডুলসের মতো একটি নাস্তার আইটেমকে দৈনন্দিন খাবারের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বানিয়ে তোলার মিশনে নেমেছেন কিনা। তবে তার কর্মকান্ডের সাথে পলা ডীনের রান্নার অনুষ্ঠানের মিলটিকে অন্তত আমি অগ্রাহ্য করতে পারছিনা। আর যাই হোক, এই জনপ্রিয়, আন্টিসুলভ, বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠের রন্ধনশিল্পীটির কোন মরণব্যাধি কিংবা অকালমৃত্যু- কোনটিই আমি প্রত্যাশা করিনা। আমি আশা করবো জনসাধারণ হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কোন খাবার বিনা প্রশ্নে ভক্ষণ করা শুরু করে দেবেনা; আর কেকা ফেরদৌসীরা হবেনা কোন মার্কেটিং জিনিয়াসের উর্বর মস্তিষ্কজাত উদ্ভট মার্কেটিং হাইপের গণধিকৃত ক্রীড়নক।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ৯:৪৩