বিখ্যাত আমেরিকান পন্ডিত নোয়াম চমস্কি, ১৯৬৭ সালে The New Review of Books এর বিশেষ সংখ্যায় The Responsibility of Intellectuals নামে বহুল আলোচিত একটি নিবন্ধ লেখেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাইকেল এ্যালবার্ট এই নিবন্ধটির উপর ভিত্তি করে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ধারণ করেন। সাক্ষাৎকারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে আবর্তীত হলেও এর মূলসুর আমাদের দেশের পাঠকদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। তাই সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশের অনুবাদ প্রকাশ করলাম।
মা:এ্যা: বেশ ক’বছর আগে ‘বুদ্ধিজীবিদের দায়িত্ব’ (The Responsibility of Intellectuals) শিরোনামে আপনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। আমরা সেখান থেকেই শুরু করবো এবং তার সাথে অন্যান্য বিষয়েও আলাপ করবো। লেখাটির শিরোনাম আপনি দিয়েছিলেন ‘বুদ্ধিজীবিদের দায়িত্ব’। তো বুদ্ধিজীবি কী?
নো:চ: এই শব্দবন্ধটি আমি খুব একটা ব্যবহার করিনা, কিন্তু এর দ্বারা সেসব ব্যক্তিদেরকে বোঝায় যাদের মধ্যে গণমানুষের সামষ্টিক স্বার্থ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারার মতো যথেষ্ট জ্ঞান ও সুযোগ আছে এবং যারা সেই কাজটি করে থাকে একটি মর্যাদা কর্তৃত্বের ভিত্তিতে, যা (মর্যাদা ও কর্তৃত্ব) তাদের উপর আরোপিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এদেরকেই বুদ্ধিজীবি বলে। যেমন গবেষণাগারে কার্যরত একজন পদার্থবিদকে বুদ্ধিজীবি বলা যাবেনা, কিন্তু যদি তিনি পারমাণবিক বিস্তার বিষয়ে কথা বলেন, তখন আবার তিনিই বুদ্ধিজীবি বলে গণ্য হবেন। ঊনবিংশ শতকের ইংরেজি কবিতা নিয়ে কোন সাহিত্য সমালোচক লিখলে তাঁকে বুদ্ধিজীবি বলা যাবেনা, কিন্তু তিনি যদি বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি করেন, তখন আবার তাঁকেই বলা হবে বুদ্ধিজীবি। আবার একজন মুচির যদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ও মানব সম্পর্ক বিষয়ে যথেষ্ট অন্তর্দৃষ্টিও থাকে, তাকে সাধারণত বুদ্ধিজীবি বলা হবেনা। তাই এটি খুব একটা অর্থপূর্ণ শব্দবন্ধ নয়।
মা:এ্যা: আপনার নিবন্ধ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবির দায়িত্ব কী?
নো:চ: আমরা এ অনুসিদ্ধান্ত দিয়ে শুরু করি যে, যাদেরকে বু্দ্ধিজীবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তারা সমাজের একটি বিশেষ সুবিধা-প্রাপ্ত গোষ্ঠী, কারণ, তা নাহলে তারা বুদ্ধিজীবির তকমায় অভিষিক্ত হতেই পারতেন না। তাদের কিছু মাত্রার কর্তৃত্ব ও মর্যাদা রয়েছে, তা যথার্থ হোক বা না হোক। তো এ বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতে তাদের উপর কিছু দায়-দায়িত্বও বর্তায়। এগুলো তাদের ব্যাপারে মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্ম দেয়। যার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা যত বেশি, তার দায়-দায়িত্বও তত বেশি।
মা:এ্যা: কিন্তু এই দায়-দায়িত্বের প্রকৃতি কী? ধরুন, আমরা যখন বলি একজন বুদ্ধিজীবি তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন আমরা আসলে কী বোঝাই?
নো:চ: কিছু মৌলিক নৈতিক সূত্র দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি, যা যেকোন ভদ্রস্থ মানুষের কাছে স্বভাবতই গ্রহণযোগ্য হবে, বা অন্তত তারা মুখে মুখে হলেও স্বীকার করবে যে এগুলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। যেমন একটি মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ হলো, অন্যের বেলায় আমরা যে মানদন্ড প্রয়োগ করি, নিজের বেলায় তার চেয়ে বেশি না হোক অন্তত একই মানদন্ড আমাদেরকে প্রয়োগ করতে হবে। সত্যি বলতে, নিজের বেলায় বরং আরো কঠোর মানদন্ডই প্রয়োগ করা উচিত।
বুদ্ধিজীবিদের একটি দায়িত্ব হলো অতীত ও সাম্প্রতিক সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রকৃত সত্যকে জানা, আমাদের শত্রুদের কার্যকলাপ এবং আমরা তাদের সাথে কী করেছি তা জানা, আমাদের নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখা যে আমরা নিজেদের সাথেই বা কী করেছি। এসব অনুধাবন করে নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করা দরকার যে আমরা নিজেরা কি সেই মৌলিক নৈতিক মানদন্ডগুলো নিজেদের উপর যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছি?
এ প্রশ্নগুলো প্রতিনিয়তই উত্থাপিত হয়। যেমন ইংল্যান্ডে প্রশ্ন উঠেছে টনি ব্লেয়ার, জ্যাক স্ট্র এবং অন্যান্যরা ইরাক দখলের সময় যে পটভূমিকায় তা করেছিল, তা সঠিক ছিল কিনা। দুঃখের বিষয় আমেরিকায় এ ধরণের প্রশ্ন উঠতে দেখিনা। আমেরিকার ক্ষমতা ও সুবিধা-প্রাপ্ত গোষ্ঠীকে যেন তাদের কার্যকলাপের সাপেক্ষে যে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটা যেন নব্য-সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতার অংশীদারিত্বের সুবাদে প্রাপ্ত এক বিশেষ অধিকার। কিন্তু ইংল্যান্ডে এখনো কিছু জবাবদিহিতার সংস্কৃতি রয়ে গিয়েছে।
এটি মৌলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে টনি ব্লেয়ার ইরাক আগ্রাসনে জড়িত ছিলেন। আইনজীবিরা এই উপসংহার থেকে তাকে বের করে আনার চেষ্টা করছে, যেটা তাদের পেশাগত কর্তব্য। কিন্তু আইনে যা-ই রায় হোক, কিছু মৌলিক অনুসিদ্ধান্ত তো রয়েছেই। যেমন আগ্রাসনের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা আছে, যেমন, নুরেমবার্গ কার্যবিবরণী কিম্বা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এগুলো আলোচিত হয়েছে। সেই সংজ্ঞায়নে ইরাক দখল ছিল আগ্রাসনের একটি পাঠ্যপুস্তক উদাহরণ।
এসব আগ্রাসনকে উদ্দেশ করার উদাহরণও আছে; বিশেষ করে যখন আমাদের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে এমন আগ্রাসন সংঘটিত করেছে। যেমন নুরেমবার্গ ট্রায়ালকে আগ্রাসন উদ্দেশ করার স্বর্ণমান হিসেবে বিবেচনা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ সেই সময়কার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপের কথা বলা যেতে পারে যাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল অগ্রধারণাজাত (preemptive) যুদ্ধ পরিচালনা করে নরওয়ে দখল করে নেওয়া। সে যেহেতু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিল, অবশ্যই এই আগ্রাসনে সেও জড়িত ছিল। কিন্তু জার্মানরা নরওয়ে দখর করেছিল কারণ তারা জানত, বাস্তবিক এটা গোপনীয় কোন বিষয়ও ছিলনা, যে, ইংল্যান্ড নরওয়েকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে জার্মানিতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। সেটিকে নস্যাৎ করার জন্য আগেই জার্মানরা নরওয়ে দখল করেছিল, যাকে প্রিএম্পটিভ ওয়ার বলা হয়। এটা করা হয় যাতে ভবিষ্যতে নিজের উপর ঘটতে যাওয়া আক্রমণ আগে থেকেই ঠেকানো যায়। ঠিক আছে, তারপরও তো রিবেনট্রপকে ঝোলানো হয়েছিল। একই কথা তো এখন টনি ব্লেয়ারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
মা:এ্যা: এমন বুদ্ধিজীবি কি আছেন যারা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন, সেটা আমেরিকাতে বা বাইরেও হতে পারে। তাদের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
নো:চ: হাওয়ার্ড যিন, যিনি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন; অথবা ইকবাল আহমেদ যিনি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন; এডওয়ার্ড সাঈদ, যিনি ইকবালের কিছু আগে মারা গিয়েছেন। এরা সবাই পুরনো ব্যক্তিগত বন্ধু। ইকবাল ও এডওয়ার্ড ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। এডওয়ার্ড ও হাওয়ার্ডও ভাল বন্ধু ছিলেন ও পরস্পর প্রচুর মিথষ্ক্রিয়া করেছেন। এরা সবাই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি, পন্ডিত ও সক্রীয়তাবাদী (activist), যাদের কাজ ও জীবনের বড় অংশ তাঁরা মৌলিক নৈতিক সূত্রগুলো উদঘাটনে ব্যয় করেছিলেন। এটাই দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবির কাজ।
মা:এ্যা: কিন্তু অনেকেই তো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থও হয়েছেন। এদের মর্যাদা ছিল, অভিগম্যতা ছিল, আপনার বর্ণিত বুদ্ধিজীবির বৈশিষ্টাবলী সবই তাদের ছিল, অথচ বুদ্ধিজীবির দায়িত্ব তারা পালন করতে পারেননি, নিয়মিতভাবে বিচ্যুত হয়েছেন।
নো:চ: [হাসতে হাসতে] এদের নাম বলা শুরু করলে তো সারাদিন চলে যাবে; বস্তুত এই তালিকায় সবাই পড়ে যাবেন।
মা:এ্যা: তারপরও যদি উদাহরণ সহ কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যাক্তি ও তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বলেন।
নো:চ: ধরা যাক, কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক টাইমস ’নিক্সন টেপস’ বলে কিছু রেকর্ড প্রকাশ করলো। হেনরি কিসিঞ্জার চাচ্ছিলনা এগুলো প্রকাশিত হোক। শেষপর্যন্ত সেগুলো প্রকাশিত হয়। আপনি যদি টেপগুলো শোনেন দেখবেন যে সেখানে অনেকরকম কথা আছে যা মূলতঃ গালগল্প, নিক্সন কার সম্পর্কে কী নোংরা কথা বলেছেন, ইত্যাদি। কিন্তু প্রকাশিত নিবন্ধে একটি বিশেষ বাক্য উল্লেখ করা হয়েছে, যার ব্যাপারে আমার মতো দু’য়েকজন ছাড়া আর কারও কাছ থেকেই কোন মন্তব্য আসলোনা।
কথাটি ছিল কম্বেডিয়ার বম্বিং নিয়ে। নিক্সন, তার অনুগত ভৃত্য কিসিঞ্জারকে কম্বোডিয়ার বম্বিং বিষয়ে পেন্টাগনকে অবহিত করতে বললো। কিসিঞ্জারও আনুগত্যের সাথে নির্দেশ পালন করলো। তার বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম, ”উড্ডয়নশীল যা কিছু, সঞ্চরণশীল যে কোন কিছুর বিরুদ্ধে” (Anything that flies against anything that moves)। আর্কাইভাল রেকর্ডের সাথে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি ছিল গণহত্যার সুস্পষ্ট নির্দেশনা। আর এটি কথামাত্র ছিলনা, কারণ, এটি বাস্তবে ঘটেওছিল।
কয়েক বছর আগে কম্বোডিয়া বিষয়ক দু’জন শীর্ষ পন্ডিত টেইলর ওয়েন এবং বেন কীরনান কানাডায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তারা প্রকাশিত সেই নথিগুলোতে কম্বোডিয়ার বম্বিং নিয়ে যা আছে তা নিয়ে আলোচনা করেন। তা থেকে বোঝা যায় সেই বম্বিং ছিল অতিমাত্রায় তীব্র। সেসময় যা প্রকাশ করা হয়েছিল, বাস্তবে এর তীব্রতা ছিল তার অন্তত পাঁচগুণ বেশি। কম্বোডিয়ার গ্রামাঞ্চলে যে বোম্বিং করা হয়েছিল, তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির নিক্ষিপ্ত সম্মিলিত বোমার থেকেও বেশি। এর ফলাফল হলো, তৎকালীন খেমাররুজের মতো একটি সাধারণ মানের গেরিলা বাহিনীর ক্রুদ্ধ কৃষকদের দুর্ধর্ষ এক বাহিনীতে রূপান্তর। কারণ তারা সেই দানবীয় নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। এর পরবর্তীকালে কী হয়েছিল তা সবারই জানা।
তো এই ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? এটি খুব সহজেই পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েন ও কীরনানের নিবন্ধ আমার জানামতে মাত্র একবারই খুব সীমিত পরিসরে আমেরিকায় দেখা গিয়েছিল, আর কোথাও এ বিষয়ে আমি আর কোন আলোচনা দেখিনি। যতদুর আমি জানি, ইংল্যান্ডেও এটি প্রচারিত হয়নি। আমার সন্দেহ হয় এটি আর অন্য কোথাও কখনো প্রকাশিত হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমি বুদ্ধিজীবিদের কোন মন্তব্য দেখিনি। কিসিঞ্জারের এ বক্তব্যের চেয়ে নানা গসিপ, গালগল্প, সস্তা আলোচনাই মিডিয়ার মূল উপজীব্য হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের রয়েল ইন্সটিটিউট অব ফিলোসফি, যারা নৈতিকতার দর্শন নিয়ে আলোচনা করে; আমেরিকাতে এর তুলনীয় যে গ্রুপগুলো রয়েছে; কম্বোডিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ; জার্নালসমূহ- যারা খেমাররুজদের নৃশংস অপরাধসমূহ শতমুখে প্রচার করে; কেউই এ বিষয়ে (কিসিঞ্জারের মন্তব্য) টু শব্দটিও করলোনা। কিসিঞ্জারের মন্তব্যটি এমনই একটি সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মিলোসেভিচের বিচার চলছিল। চিন্তা করুনতো, তারা (ট্রাইবুনাল) যদি মিলোসেভিচের পক্ষ থেকে এমন কোনো বক্তব্যের প্রমান পেত (উড্ডয়নশীল যা কিছু সঞ্চরণশীল যে কোন কিছুর বিরুদ্ধে) তা হলে বিশ্বব্যাপী কী প্রতিক্রিয়াটি হতো?
গোটা পশ্চিমা বিশ্ব এটি নিয়ে পড়তো- মিলোসেভিচকে এই মুহূর্তে শাস্তি দিতে হবে, পশ্চিমা বিশ্ব কতটা মানবিক, এসব আলোচনায় সর্বত্র মুখরিত হতো। আমি এখানে একশভাগ বুদ্ধিজীবিদের কথা বলছি।
মা:এ্যা: তার মানে, অত্যন্ত অল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবিই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। তারা তাদের যাবতীয় বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রতিপত্তি, উপকরণ সবকিছু নিয়ে, তাদের জন্য যা সুবিধাজনক সেই অবস্থানের সপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিলম্ব করেনা। অথচ একই রকম পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক বিষয়গুলো নিয়ে তারা টু শব্দটিও করেনা। কিন্তু এ ধরণের আচরণের পেছনে ব্যাখ্যা কী? কেন তারা এমনটি করে? এটি কী করে সম্ভব যে তাদের সত্য দেখার মানসিক সক্ষমতা পুরোমাত্রায় থাকা সত্ত্বেও তারা সত্যটিকে দেখতে পায়না? তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত আসলেই সত্যকে অনুধাবন করতে পারেনা; কিন্তু তাদের সংখ্যা নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়; বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবিই সব বুঝতে পারে। এই প্রপঞ্চটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
নো:চ: একে আমরা বলি ’দ্বিমুখী চিন্তা’ (double think)। ’দ্বিমুখী চিন্তা’ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে কেউ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দু’টি চিন্তা একই সাথে মস্তিষ্কে ধারণ করে, এবং দু’টিতেই বিশ্বাস রাখে। এটি কার্যতঃ বুদ্ধিজীবিতার ইতিহাসের চরিত্রগত সংজ্ঞা (defining characteristic of intellectual history)। আমি এখানে শুধুমাত্র আমেরিকার বুদ্ধিজীবিদের কথা বলছিনা। আমি যতদুর জানি, বুদ্ধিজীবিদের এ বৈশিষ্ট্য, বলতে গেলে, ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বজনীন। আমি খুব কমই এর ব্যতিক্রম দেখেছি।
আপনাদের সবারই হয়ত এমন ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বড়ভাই তার ছোটভাইয়েরে খেলনা কেড়ে নিয়েছে। ছোটভাইয়ের কান্না শুনে মা ছুটে আসলে বড়ভাই সাধারণতঃ কিভাবে নিজের কাজের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করে? সে কি বলে যে “আমি খেলনা কেড়ে নিয়েছি কারণ এটা আমি চেয়েছি; আর সে তো আমার চেয়ে ছোট”। নাকি সে বলে, “দেখো, সে আসলে খেলনাটা চাচ্ছেইনা, তাছাড়া খেলনাটা আসলে আমারই, সে-ই আসলে আমার কাছ থেকে এটা আগে নিয়েছিল, কাজেই আমার কোন দোষ নেই”।
কাজেই আমরা আপনার প্রশ্নের উত্তরটি জানি। সবকিছুকেই যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করার উপায় রয়েছে। আর এসব না করলে আপনি কখনোই বুদ্ধিজীবি হিসেবে যথেষ্ট সম্মানিত হবেননা। এটি শুধু কিসিঞ্জারের যে ঘটনা বললাম সে সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, অনেক ক্ষেত্রেই এটি দেখা গিয়েছে। আর তারা (বুদ্ধিজীবি) পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে নিজেরাও একাত্ম হয়ে যায়। ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক।
ইতিহাসে এমন কিছু মানুষের, খুব অল্প সংখ্যায় হলেও, দেখা মেলে যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করেননি। তারা কি প্রশংসিত হয়েছেন? তারা কি সম্মানিত হয়েছেন? সাধারণতঃ তাদেরকে অত্যন্ত খারাপ ভাবে মূল্যায়ণ করা হয়েছে।
তারা কিভাবে মূল্যায়ীত হবে তা নির্ভর করে সেই সমাজের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের উপর। তারা চাকরিচ্যুত হতে পারে, এমনকি আমাদের মতো একটি সভ্য সমাজেও এটি ঘটতে পারে। তাদের নামে কুৎসা রটিয়ে দেওয়া হতে পারে। মার্কিন প্রভাবিত এল সালভাদরে তাদেরকে বন্দী করা হয়েছে। স্ট্যালিনের সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নে তাদেরকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে, কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালের নভেম্বরে, বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনার উপর ব্যাপক আলোকপাত করা হয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গা হয়। তার কিছু পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নেরও পতন ঘটে। এগুলো ছিল বিশ্ব ইতিহাসের প্রধান কিছু ঘটনা। এর স্মরণে ২০ বছর পূর্তিতে ব্যাপক আয়োজন করা হয়। এ সম্পর্কে বুদ্ধিজীবিরা যা বিবৃতি দেন তা ছিল অত্যন্ত নির্ভূল, অত্যন্ত উদ্দীপক। এ ঘটনাকে ভালোবাসা ও অহিংসার মাধ্যমে দাবি আদায়ের মোক্ষম উদাহরণ হিসেবে তারা তুলে ধরেন। নভেম্বর ১৯৮৯ থেকে আমরা অহিংসার এ শিক্ষা পাই।
অন্যদিকে বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গার এক সপ্তাহের মাথায় পৃথিবীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এল সালভাদরের একদল শীর্ষ সেনাদল ফোর্ট ব্র্যাগের জন এফ কেনেডি স্পেশাল ওয়ারফেয়ার সেন্টার থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের দেশে ফেরে। তার দুই দিন পরেই তারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে এল সালভাদরের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় জেসুইট বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করে। তাদের বাড়ির কাজের মানুষ ও কন্যাকেও হত্যা করা হয়। ২০০৯ সালের নভেম্বরে এ ঘটনা নিয়েও একটি লেখা প্রকাশিত হয় স্প্যানিশ একটি পত্রিকায়, যা প্রায় কারও কাছেই পৌঁছায়নি। সেই নিবন্ধে একটি নথি প্রকাশ করা হয় যা থেকে বোঝা যায় এ ঘটনাটি এল সালভাদরের সেনা প্রধানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল। তারা পেন্টাগন ও মার্কিন এম্বেসির মদদপুষ্ট ছিল। অবশ্যই এ খবর আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়নি।
কাজেই নভেম্বর ২০০৯ শুধু একটি অহিংস আন্দোনের সফলতার বিশ বছর পূর্তিমাত্রই ছিলনা, এটি ছিল এমন এক হত্যাযজ্ঞেরও বিশ বছর পূর্তি যার ফলশ্রুতিতে ঐ অঞ্চলে প্রায় সত্তর হাজার মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল। এ হানাহানি আরো অনেকগুলো দেশে ছড়িয়েছিল। আর এই সবের পেছনেই আমেরিকার মদদ ছিল। এই ঘটনা মোটেও সামান্য কোন ঘটনা ছিলনা; এ ঘটনার প্রভাব ছিল ভয়ঙ্কর ও দীর্ঘমেয়াদী। এখন তাকিয়ে দেখুন এ বিষয়ে কতটুকু ভাষ্য বা আলোচনা আপনি পান বুদ্ধিজীবিদের তরফ থেকে।
মা:এ্যা: প্রায় শূন্য।
নো:চ: আমি মাত্র একটি আলোচনার খবর জানি; সেটি হয়েছিল বস্টন জেসুইট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই হত্যাকান্ড থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একজন জেসুইট, ইয়ন সব্রিনো সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু এসব নিয়ে বুদ্ধিজীবিদের কোন মন্তব্য কি আপনার চোখে পড়েছে?
অবশ্য একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। পূর্ব ইউরোপের অন্য এক জেসুইট নায়ক ভাসলাভ হাভেল আমেরিকায় এসেছিলেন ঐ ঘটনার (ছয় জেসুইট হত্যাকান্ড) কয়দিন পরেই। মার্কিন কংগ্রেসে তিনি একটি বক্তব্য দেন। এবং সেই বক্তব্যের সুবাদে তিনি জোরালো প্রশংসার সাথে সাথে স্ট্যান্ডিং ওভেশনও লাভ করেন; কেন জানেন? আমেরিকাকে তিনি ‘স্বাধীনতার রক্ষক’ আখ্যা দেওয়ার কারণে। প্রেস, বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়, এমনকি বামপন্থীরা পর্যন্ত আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিবৃতি দিয়ে বসে। ওয়াশিংটন পোস্ট সম্পাদকীয় কলামে সপ্রশংস উক্তি করে, ”আমাদের দেশে কেন এমন মহানুভব বুদ্ধিজীবির আবির্ভাব হয়না যারা বড় গলায় বলতে পারে আমরাই হলাম স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক?” অথচ তিনি (ভাসলাভ হাভেল) বিলকুল ভুলে যান নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া তারই পরিপূরক ল্যাটিন আমেরিকান জেসুইটদের কথা।
মা:এ্যা: তাহলে, সারাংশ করলে দাঁড়ায়, বুদ্ধিজীবিরা, যারা মানুষের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস পেয়ে এসেছে, তারা নিজেদের পেশাগত অগ্রগতির জন্য, ক্ষমতাশীলদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য, প্রশংসিত হওয়ার জন্য, অভ্যাসগত ভাবে, অনেকটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার মতোই (reflexively) একটি মতাদর্শকে অন্ধ অনুসরণ করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রবন্ধটি শিল্প সাহিত্য ও সমাজ রাজনীতির পত্রিকা ‘সৃজন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে কিছু পরিমার্জন করে প্রকাশ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ৯:৩৫