পটভূমি
সভায়, সেমিনারে, বক্তৃতায়, বিতর্কে, চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবির জ্ঞানগর্ভ আলোচনায়- সব খানে দেদারসে উচ্চারিত একটি শব্দ-‘সংস্কৃতি’। কি এই সংস্কৃতি? সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, আইন, রীতি এবং অন্যান্য যোগ্যতা এবং অভ্যাস-এই সব কিছুর সমষ্টিই হলো ‘সংস্কৃতি’। না, কথাটি আমার নয়, বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী Edward Taylor বলেছেন। কিন্তু এই শব্দটি নিয়ে এত বিতন্ডার হেতু কি? সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ (Cultural Relativism) বলে একটি কথা আছে। প্রত্যেক সংস্কৃতিকেই ঠিক সেই সংস্কৃতির মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং অন্য কোন সংস্কৃতির মানদন্ডে তাকে বিচারের কাঠগরায় দাড় করানো যাবেনা। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের মূল কথাই হলো- কোন সংস্কৃতিই অন্য সংস্কৃতি থেকে শ্রেষ্ঠতর নয়। এই আপ্তবাক্যটি ভুলে যাই বলেই আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই অন্যের ওপর। কিন্তু এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি? মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি মানুষ সবার আগে দায়বদ্ধ তার নিজের কাছে। তাই এই ‘প্রত্যেকটি’ মানুষ যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে পরমত সহিষ্ণুতার বীজ মন্ত্রে, এই ‘প্রত্যেকটি’ মানুষ যদি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি- তাহলেই হয়ত আর দুশ্চিন্তা করতে হবেনা এর অবস্থিতির সর্বস্বতা সম্পর্কে। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজের সংস্কৃতিকে চিনতে চেষ্টা করা। এরকমই এক ছোট্ট প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম আমরা- আমি এবং আমার মার্কিন সহপাঠী- Alicia Cooper. আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম অদ্ভুত ব্যতিক্রমী এক বিষয়- আমাদের গ্রামের মানুষদের ‘মৃত্যু’ সংক্রান্ত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং তাদের স্বাস্থের ওপর এর প্রভাব। তাদের গল্পই বলছি- তাদেরি ভাষায়।
মৃত্যুর মানে
৫৪ বছর বয়স্ক রফিকুদ্দীন বলেছিলেন:
“মৃত্যু তো মৃত্যুই…..যখনই রূহ বাইর হইয়া যায়, মানুষও মইরা যায়”
এর চেয়ে সহজ ভাষায় বোধহয় আর কেউই মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করতে পারতনা- একজন অর্ধ শিক্ষিত গ্রাম্য বৃদ্ধ যা পেরেছেন। আমাদের আত্মবিশ্বাস গেল বেড়ে, ঘর থেকে ঘরে আমরা ছুটে গেলাম যুগ যুগ ধরে লালিত এক অনুদঘাটিত রহস্যের লোকায়ত শুলুক সন্ধানে।
শরীর ও আত্মার দ্বৈততা
তোমাদের কাছে আশ্চর্যের মনে না হলেও আমার মার্কিন বান্ধবীর বিস্ময়ের সীমা ছিলনা যখন সে দেখল এই আধুনিক সভ্যতার যুগেও প্রত্যেকটি মানুষই বিশ্বাস করছে শরীর নামক ‘খাচার ভেতর’ রূহ বা আত্মা নামক ‘অচিন পাখি’র বসবাস। একজন বৃদ্ধ তো এ বিষয়ে প্রশ্ন করাটাই আমাদের মূর্খতার পরিচায়ক হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। অনেকের মতেই আত্মা শরীরে একটাই, তবে এর পাঁচটি ভাগ রয়েছে- সেখান থেকেই ‘পঞ্চ আত্মা’ শব্দের উৎপত্তি- অকাট্য যুক্তি। বিভিন্ন আত্মাই মানুষের বিভিন্নমুখী কর্মকান্ডের নির্ণায়ক।
কোথায় তার বাস
কেউ বলে হৃদয়ে, কেউ বলে মস্তিষ্কে আর কারো বা মতে খাঁচার ভেতর অচিন পাখির মতোই এর বসবাস-পুরোটা খাঁচা জুড়েই। কন্যাদায়গ্রস্থ সুরুজ আলি বললেন:
“বুকের মধ্যেই থাকে, এই জন্যই তো শুধু ধড়ফড়ায়, যখন চুপ কইরা থাকি, সে চুপ করেনা, যখন ঘুমাইয়া থাকি তখনো সে চলে- আপনেই কন্ আত্মা বুকে না থাকলে এমন তড়পায় ক্যান”
সরল মানুষ গুলোর সহজাত যুক্তিবোধ আমাদের বিমোহিত করে।
কিভাবে আসে
আমরা ভেবেছিলাম এ প্রশ্নের তারা উত্তর দিতে পারবেনা। আমাদেরকে প্রবল বিস্ময়ে হতবিহ্বল করে তারা কেবল আত্মার সুনির্দিষ্ট প্রবেশপথই বাতলে দিলনা বরং এর বের হবার রাস্তটিও দেখিয়ে দিল। রফিকুদ্দীন জানালেন যেহেতু শিশু মাতৃ জঠরেই খাদ্য গ্রহণ করে, বড় হয়- কাজেই আত্মা মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই শিশুর দেহে প্রবেশ করে:
“তা না হইলে বাচ্চা খায় ক্যামনে?”
রচনা বাড়ৈ এ বিষয়টি বেশ ভালো ভাবেই জানেন:
“ঠিক যেই দিন বাচ্চার চোখ ফুটে ঠিক তখন থেইকা বাচ্চা আর মায়ের প্যাটে খাকবার পারেনা। ঠিক এই সময়ই পাঁচ আত্মা মিল্যা হৃদপিন্ডের মইধ্যে একটা আত্মায় মিল্যা যায়, আর তখনই বাচ্চার জন্ম হয়”
রচনা বাড়ৈ বেশ পটুত্বের সাথে আত্মার প্রবেশ, সংগঠন এবং নির্গমন প্রক্রিয়া আমাদেরকে এঁকে দেখিয়েছিলেন। আমরা আরো পরে এ বিষয়ে আরেকটু আলোকপাত করব।
কিভাবে যায়
এ বিষয়ে দেখলাম নানা মুনীর নানা মত। তা হলেও মোটামুটি ভাবে তারা যে কয়টি নির্গমন পথের কথা বলল তার মধ্যে মুখ, মাথার তালু এবং পায়ু পথই উল্লেখযোগ্য। অশীতিপর বৃদ্ধ চান মিয়া জানালেন:
“আত্মা মাথার তালু দিয়া শরীরে আসে আবার মাথার তালু দিয়াই বাইর হইয়া যায়, সবাই এটারে দেখবার পারেনা, তয় জ্ঞানীরা পারে”
সেই জ্ঞানীদের দলে চান মিয়া পড়েন কিনা তা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে রচনা বাড়ৈ বললেন অন্য কথা:
“দুনিয়ার কেউই আত্মারে দেখেনাই, কারণ এইটা অদৃশ্য। কিন্তু যখন এইটা বাইর হইয়া যায় তখন ঠিকই বোঝন যায়, কারণ তখন একখান খিচুনি দ্যায় আর মুখ দিয়া আত্মাটা বাইর হয়। যাতে সহজে আত্মাটা পিছলাইয়া বাইর হইতে পারে এই জন্যই তো মরণের কালে মুখে পানি দেয়া হয়। তয় আগে গঙ্গাজল অথবা মহাপ্রসাদ দেয়া হইত, এখন কি আর এইসব পাওয়া যায়!”
‘ভাল’ মৃত্যু ‘মন্দ’ মৃত্যু
এ বিষয়ে আমার শিক্ষক, Amsterdam University’র চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান (Medical Anthropology) বিভাগের অধ্যাপক Sjaak van der Geest এর বিখ্যাত গবেষণা আছে। হাজার হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার ঘানা রাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে করা তাঁর গবেষণায় তিনি ‘অপঘাতে’ মৃত্যু সম্পর্কে যা উদঘাটন করেছিলেন তার সাথে আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল কাকতালীয় ভাবেই বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। গলায় ফাঁস দেয়া, বিষক্রিয়া, ডুবে মরা, খুন এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যু মন্দ মৃত্যু বা অপঘাত হিসেবে চিহ্নিত। কারণ এ সব মৃত্যু ঈশ্বর কখনো মানুষের ললাটে লেখেননা, বরং মানুষই তার কর্মদোষে এসব মৃত্যুকে আমন্ত্রন করে।পক্ষান্তরে ভাল মৃত্যু হল শান্তিপূর্ণ ভাবে, পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে স্বল্প কষ্ট ভোগে মৃত্যু। একজন মানুষের মৃত্যু কিভাবে হবে তা তার কাজের ওপর নির্ভরশীল। ‘তাহলে অনেক ভাল মানুষ অপঘাতে আর অনেক মন্দলোক শান্তিতে মারা যায় কিভাবে’- প্রশ্নটি করে ভেবেছিলাম রচনা বাড়ৈকে বেশ বেকায়দায় ফেলা গেল। কিন্তু আমাদের আপাত বিজয়ের জ্ঞনদর্পী হাসিকে মুহূর্তে বিলীন করে দিয়ে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই বললেন:
“অনেক সময় এইটা পূর্বজন্মের উপর নির্ভর করে; মনে করেন পূর্বজন্মে আপনে ভাল লোক ছিলেন, তাই অনেক খারাপ কাজের পরেও এই জন্মে আপনার ভাল মৃত্যু হইতে পারে”
আমরা বিস্মিত হলাম এই গ্রাম্য মহিলাটির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বপূর্ণ উত্তরে। আরো বিস্মিত হয়েছিলাম অনেক মুসলমান বৃদ্ধের মুখেও একই বক্তব্যের ধর্মনিরপেক্ষ অনুরণনে।
শরীরে আত্মার বিচরণপথ
প্রতিটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের, যাদেরকে আমরা ‘অকাট মূর্খ’ বলে বিবেচনা করে নিজেদেরকেই পক্ষান্তরে মূর্খ হিসেবে প্রমাণ দিই, রয়েছে নিজ নিজ পরিপার্শ্ব ও ঘটনাবলী বিষয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সঞ্জাত সহজাত উত্তর বা ব্যাখ্যা। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এ ব্যাখ্যাকেই বলে Explanatory Model. আমরাও এরকম এক Explanatory Model এর সন্ধান পেয়েছিলাম যা আমাদের সংস্কৃতির শিকড়কে বুঝতে সাহায্য করবে:
ভ্রুণের ৫ মাস বয়সে ঈশ্বর পঞ্চ আত্মাকে যথাক্রমে ডান হাত, বাম হাত, ডান পা, বাম পা এবং মাথা এ পাঁচটি অঙ্গে প্রেরণ করেন। যখন ভ্রুণ পরিপূর্ণতা পায় তখন তার চোখ ফোটে তখন পঞ্চ আত্মা একত্রিত হয়ে হৃদপিন্ডের মাঝে পরম আত্মা হিসেবে পুন:স্থাপিত হয়। ঠিক এ সময়ই শিশু ভূমিষ্ট হয়। পরম আত্মার মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই পাঁচটি আত্মাই প্রকৃতপক্ষে জীব আত্মা যা মানুষকে ভাল বা মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। তার এ কর্মই তার মৃত্যুর ধরণ এবং মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের ভবিতব্যকে নির্মাণ করে। মৃত্যুর সময় মুখ, মাথার তালু কিম্বা পায়ুপথে আত্মা বের হয়ে যায়। যদি তার কর্ম হয়ে থাকে ভাল তবে সে স্বর্গ বা বেহেশতে স্থায়ী হয়। আর কর্ম যদি হয় মন্দ তাহলে তার মন্দ কাজের ধরণ অনুযায়ী সে পুনর্জন্ম পায় হয় একজন মানুষ রূপে নয়ত কোন জন্তুর রূপ ধরে। এ বিষয়টিই চিত্রের সাহায্যে দেখান হল:
উপসংহার
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি চিন্তাকে অবহেলা করে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের করাল থাবাকে প্রতিহত করার খায়েশ এক ইউটোপিয় কল্পবিলাস। আমরা নাহয় কথা বললাম মৃত্যু নিয়ে, কিন্তু এর মাঝেই আমাদের মাটি কামড়ানো গ্রাম্য মানুষগুলোর গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় ফুটে ওঠে। আমাদের তথাকথিক আধুনিক জ্ঞান যেখানে থমকে দাঁড়ায় এই প্রান্তিক subaltern জনতা সেখান থেকেই শুরু করে তাদের সনাতন জ্ঞানের রূপ-রস-মাধুর্য। আর ওখানেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সর্বব্যাপী বিজয় গৌরব।এ গৌরব আপনার, এ গৌরব আমার, এ গৌরব আমাদের সবার- কেবল পরম মমতায় বনফুলের মাধুরীকে বুকে টেনে নেবার অপেক্ষা মাত্র।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ গবেষণাটি প্রখ্যাত Journal of Cross Cultral Gerontology-তে প্রকাশিত হয়েছে। ডাউনলোডে আগ্রহী হলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:৫০