(১)
স্কুল জীবনের মাঝামাঝি থেকেই বিতর্কের ভূত মাথায় ঢোকে। ক্লাস টেনে ওঠার পর সেই ভূত এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে মাথার ভেতরে তার আর ঠাঁই হয়নি, তাকে পুরোটা সময় কাঁধে চড়েই দিন গুজরান করতে দেখা যেত্। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় বিতর্ক উৎসব নিয়ে মেতে উঠলাম পড়াশুনা মাথায় তুলে।
তখন স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা চলছে নাকি এসএসসি পরীক্ষা চলছে ঠিক মনে নেই। অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। অঙ্ক পরীক্ষার একদিন আগে আমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তার কারণ বিতর্ক উৎসবের শেষ দিনে ব্যাপক আনন্দ ফূর্তির আয়োজন থাকে; অঙ্ক পরীক্ষার চাইতে তার আবেদন আলবত বেশি। বিরূদার রম্য বিতর্কের বিমোহিত ভাব কাটতে না কাটতেই শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আনিলা আপু স্টেজ আলো করে গান গাচ্ছে (উনি তখনো সেলিব্রেটি হননি, তবে ডিবেট সার্কেলে অতিপরিচিত মুখ), তুষার ভাই গিটার বাজাচ্ছে। এর পরই শুরু হল কনসার্ট। তৌফিক জোয়ার্দার কিছু পারেনা, সে নাচছে।
সে কি উদ্দাম নৃত্য! উদ্বেলিত নৃত্যের ফাঁকে হঠাৎ উপলব্ধি করলাম আমার মাথা কান সমেত একদিকে সরে যাচ্ছে। একবার অগ্রাহ্য করে আবার নাচানাচিতে মন দিতেই দেখি টানটা আরো তীব্র হয়েছে। হিড় হিড় করে কান ধরে আব্বু শাহবাগের স্টেজ থেকে নিয়ে হাজির করল পুরানা পল্টনের পড়ার টেবিলে।
অঙ্ক পরীক্ষার আগে সন্ধ্যায় বাসায় আমাকে না পেয়ে আব্বু আমার রুমে গিয়েছিল কোথায় পালিয়েছি তার ক্লু খুঁজতে। যথারীতি পড়ার টেবিলের ওপর ক্লু পেয়েও গেল: জাতীয় বিতর্ক উৎসবের স্মরণিকার কপি, যার ওপরে বড় বড় করে উৎসবের ভেন্যু লেখা। তাই বেশি জায়গায় আব্বুকে খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি।
(২)
এসএসসি পরীক্ষার সিট পড়েছিল আজিমপুর গার্লস স্কুলে। প্রথম পরীক্ষার দিনই ঘটল অকাণ্ডটা। আমাকে রিকশায় করে পরীক্ষার হলে নিয়ে যেত আব্বু। তাঁর যত কাজই থাকুক, পরীক্ষার হলে নিয়ে যাওয়ার কাজটি নিষ্ঠার সাথে পালনে কোনদিন তাঁর ব্যত্যয় হয়নি। এসএসসির প্রথম পরীক্ষার দিনটি এমনই একটি দিন। সকাল সকাল চোখ কচলাতে কচলাতে রেডি হয়েছি। আগের থেকে কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখিনি বলে আবহমান কাল থেকে শুনে আসা মুখস্ত ঝাড়ি খেয়েছি (এখনো খাই )। আম্মুর দোয়া পড়া ফুঁ মেখে বের হয়েছি। দরদাম করে রিকশায় উঠেছি। রিকশাও চলেছে পুরানা পল্টন থেকে আজিমপুরের দিকে (সে সময় ভিআইপি রোড খুব একটা ছিলনা; প্রায় সব রাস্তায় রিকশাই ছিল মূল বাহন)। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
আব্বুর সবসময় ধারণা আমি কোন কাজ ঠিক মতো করিনা; কোথাও না কোথাও ঘাপলা একটা আছেই। পরীক্ষার দিন সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক চলাতে আব্বু খুব সম্ভবত মনে মনে বিচলিত হয়ে পড়ছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ঘাপলা আছে, উনি সেটা ধরতে পারছেননা। এমনি সময় আব্বুর গার্ডিয়ান এঞ্জেল হিসেবে কালো পাখনা (গার্ডিয়ান এঞ্জেলের পাখা সাদা হবার কথা; তবু পাখা তো) মেলে উড়ে এলো একটি কালো কাক। ডানে নয়, বামে নয়, রিকশার হুডে নয়, চালকের লুঙ্গিতে নয়- সোজা তাক করে হাগু করে দিল আমার স্কুলের পরিপাটি সাদা শার্টে।
ঘটনার চমকে আমি কিছুটা বিহ্বল হলেও আব্বু মনে হয় কিছুটা পরিতৃপ্ত হল। আমার ঠিক মনে নেই কাকের হাগু করার পেছনেও আব্বু আমার কি অপরাধ আর কাপট্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, কিন্তু বকতে বকতে বাসায় নিয়ে এলেন। শার্ট বদলিয়ে, রিকশা ঘুরিয়ে আবার রওনা হলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, দ্বিতীয়বার যাত্রার সময় আব্বুর মুখ আগের বারের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে প্রসন্ন ছিল।
(৩)
এসএসসি পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। পরীক্ষার আগে যখন পড়াশুনার স্টিম রোলার চলছিল তখনই পড়ার বইগুলোর প্রতি অকৃত্রিম ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে বইগুলো জীবনের তাবৎ দু:খ যাতনার মূল, সেগুলোকে পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই পুড়িয়ে খাক করে ফেলব। ঘৃণা চরিতার্থ করার এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কী হতে পারে?
পরীক্ষা কোন মতে পার করলাম, আর পায় কে? পরীক্ষা শেষ হয়েছে এই আনন্দে প্রথমেই নেমে পড়লাম প্রতিজ্ঞাপূরণের সংকল্প নিয়ে। সবার আগে পাড়ার মোড়ের মুদি দোকান থেকে কিনে আনলাম কেরোসিন তেল। একটি একটি করে বই টেনেটুনে নামালাম গ্যারেজের খোলা জায়গাটাতে। আম্মু বাসার কাজে ব্যস্ত থাকত, পরীক্ষার পরে বই নিয়ে কি করছি না করছি তা নিয়ে মাথা ঘামানোর তাঁর কোন কারণ ছিলনা। কিন্তু পর্দার অন্তরালে আরেক কুশীলব যে তখন মঞ্চে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তা কে জানত?
আমার পরীক্ষা শেষ এই আনন্দে আমি বাসায়। আব্বুও সেই আনন্দে যে সেদিন আগে আগে বাসায় ফিরবে সেটা প্রত্যাশা করিনি। বইগুলো স্তূপীকৃত করে, কেরোসিনের বোতলের ঢাকনা খুলেছি মাত্র, এমন সময় গেট দিয়ে আব্বুর আগমন। অস্বাভাবিক আয়োজন দেখে আব্বু বজ্রনির্ঘোষে জানতে চাইল- “বাবু, এসব কি হচ্ছে?”
আমিও সহজাত গোয়ার্তুমি ভরা ঋজুতায় কাঁধ টান টান করে জবাব দিলাম- “এগুলোকে পোড়াব”।
আর যায় কোথায়! আমার উচ্চারিত শেষ শব্দের শেষ অক্ষরটি মাটিতে পড়ার আগেই গালের ওপর ঠাস ঠাস করে অতি পরিচিত হাতের কর্কশ চড় পড়তে লাগল। “হতচ্ছাড়া পাঁজি, বদমাইশ; পাশ করবে কিনা তার নেই ঠিক এখনি এসেছে বই পোড়াতে। একে দিয়ে জীবনে পড়াশুনা হবেনা।…..” আমি চড়ের ঝাপটায় ঝিঁঝিঁ পোকার মত শব্দ শুনতে লাগলাম, আব্বু আর কি বলেছিল তা আর শোনা যায়নি। কিছুক্ষণ পরে কাজের মেয়েকে দেখলাম দাঁত বের করে বইগুলো গ্যারেজ থেকে কুড়িয়ে আমার বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখতে। বইগুলো আজও আছে।
(৪)
আমার বাপের বয়স হয়েছে; সেই জাঁদরেলপনা এখন আর নেই। এখন বরং আমার কথার খোঁচার ভয়েই ম্রিয়মান থাকতে দেখি। প্রায়ই আম্মুকে বলতে শুনি- “ছেলেকে বিতর্ক শিখিয়ে মনে হয় ভুলই করেছি; কথায় কথায় আমার ভুল ধরে আর তর্ক করে”। আমার স্ত্রী আবার তার শ্বশুরের মহাভক্ত। আব্বু যে আগে এতটা কড়া ছিল সেটা তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারিনা। বিশেষ করে শুদ্ধভাষী আব্বুর মুখ থেকে যে কটুবাক্য কিম্বা কড়া কোন সম্বোধন বের হতে পারে এটা সে মানতেই চায়না।
সেদিন আমার এক বাল্যবন্ধু সজিব এসেছিল। আমার বাবা আমাকে ছোটবেলায় কিভাবে শাসন করত তা বেশ কায়দা করে অভিনয় করে করে দেখাল। দৃশ্যপট অনেকটা এরকম: আমাদের ডাইনিং টেবিলের একপ্রান্তের একটি চেয়ারে আব্বু বসা। টেবিলের ওপর তাঁর হাতের নাগালের মধ্যেই একটি চিকন বেত। চেয়ারের গা ঘেঁষে অপরাধীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছি আমি।
আব্বু বেশ গম্ভীর গলায় বিশুদ্ধ বাংলায় বলছেন: বাবু, তুমি যে অপরাধ করেছো, তা গুরুতর। এ অপরাধের শাস্তি স্বরূপ আমি তোমাকে এই বেতটি দিয়ে তোমার পাছায় মারব। তোমার কি কোন বক্তব্য আছে?.....ইত্যাদি
সজিবের নিপূণ অভিনয়ে আমার বউ মনে হয় কিছুটা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারল যে বিশুদ্ধ বাংলাতেও বেয়াড়া ছেলেকে শাসন করা যায়, আর আমার বাবা সেটি আমার ওপর সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন।
আব্বুর কথা মনে পড়ছে। আমার স্ত্রীর এক্সপেক্টেড ডেট অফ ডেলিভারি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। দূর পরবাসে নাতিকে দেখতে আসতে না পারার ব্যাকুলতায় বেচারা ছটফট করবে জানি। এখনি উনি প্রবল উৎসাহে লেগে পড়েছেন বাসার প্রতিবন্ধক দেয়ালগুলো ভাঙ্গতে; তার দাদুভাই নাকি দৌঁড়াতে গিয়ে ব্যথা পাবে। বাপকে সারজীবন যে পেইন দিয়েছি; আমার ছেলে হয়ত আমাকে তা নিষ্ঠার সাথে ফিরিয়ে দেবে। এভাবেই প্রজন্মান্তরে চলবে অপত্য স্নেহ আর শাসনের মায়াময় স্থানান্তর।
আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:১৬