ভূমিকা:
আম্মু বলল আমাদের একজন পরিচিত ডাক্তার নতুন বাড়িতে উঠছেন, মিলাদ দিয়েছেন। ওখানে দোয়া খায়েরে শরীক হতে হবে। আমি বললাম, খাবার দাবার দেবে তো?
যে ব্যক্তিটি মিলাদ পড়াচ্ছেন তিনি বেশ সুদর্শন, সুকন্ঠী (পুরুষদের ক্ষেত্রে 'সুকন্ঠী' শব্দটি ব্যবহার হয় কিনা নিশ্চিত নই, আবার বিকল্প শব্দও মনে করতে পারছিনা), এবং কিঞ্চিৎ সুরেলা ('বালাগাল ঊলা বি কামালিহি' পাঠন থেকে বুঝেছি)। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে; দেখে অনেকটা হিজবুত তাহরিরের ছেলেদের কথা মনে পড়ে (টিভিতে দেখেছি)। দিনটি জুম্মাবার, দুপুরে খুতবায় শোনা কিছু কথা, এবং বিকেলে তরুণ হুজুরটির কথা বেশকিছু চিন্তার বুদ্বুদ মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারে অশ্বস্তি উষ্কে দিয়েছে। আমাদের ধর্মীয় মাহফিলগুলোতে কখনো উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর, জিজ্ঞাসা, বা বিতর্ককে উৎসাহিত করা হয়না। বরং বেশকিছু মজমায় দেখেছি, কৌতূহলী প্রশ্নোত্থাপনকারীকে বেয়াদব এবং ক্ষেত্রবিশেষে 'শয়তান' দ্বারা প্ররোচিত আখ্যা দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মাথায় যখন প্রশ্ন আসে তখন দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশত মস্তিষ্ককে বিরাম দেয়না। ব্লগের শরণাপন্ন হওয়া তাই স্বাভাবিক পরিণতি হয়ে উঠল।
বয়ান এক:
কেয়ামতের সময় বাসাবাড়ি তার অধিবাসীদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে- তারা ভাল কাজ করেছে, না মন্দ পথে চলেছে। তারা আল্লাহর ইবাদত করেছে কিনা। প্রশ্ন উঠতে পারে বাসাবাড়ি তো জড় বস্তু, সে সাক্ষ্য কি করে দেবে। আল্লাহর ইচ্ছায় জড় বস্তুও সাক্ষ্য দেবার মত ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। যেমন আগে মনে করা হত গাছপালা জড় বস্তু। আল্লাহর রসুল (সা: ) ১৪০০ বছর আগেই বলে গিয়েছেন গাছেরাও আল্লাহর ইবাদত করে। হাজার বছর পরে বাঙ্গালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছেন গাছেরও প্রাণ আছে। তবে উদ্ভিদের প্রাণ এবং প্রাণীর প্রাণের মধ্যে পার্থক্য আছে। একইভাবে একসময় হয়ত আবিষ্কার হবে জড় বস্তুরও প্রাণ আছে । হয়ত জীবের প্রাণ এবং জড়ের প্রাণের মধ্যে পার্থক্য থাকবে।
কমেন্ট:
নো কমেন্টস। [আমার জীববিজ্ঞানের সুদীর্ঘ পড়াশুনা সব তালগোল পাকিয়ে গেল ।]
বয়ান দুই:
ডাক্তার সাহেবরা রোগী দেখেন, পয়সা নেন। কিন্তু তাদের নিয়ত যদি এমন হয় যে আমি রোগী দেখছি মানুষের সেবার জন্য, আল্লাহর মাখলুকের মঙ্গলের জন্য- তাহলে এই নিয়তের জন্যই টাকা পয়সার সাথে সাথে অনেক সোয়াবও অর্জিত হয়ে যাবে। আর মানব সেবার আদর্শ নিয়ে কাজ করতে গেলে অর্থ উপার্জন একটু কমবেশি হতে পারে, কিন্তু এর দরুণ যে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় তার মূল্য অসীম।
কমেন্ট:
ভাল লেগেছে। কথাটি যদিও বহুল চর্চিত, কিন্তু এর অন্তর্নিহীত সত্যটি ফেলনা নয়। কথাটির খুব সুন্দর সেক্যুলার ইন্টারপ্রিটেশনও হতে পারে। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান মানুষের কোন না কোন প্রয়োজন মেটানোর জন্য সৃষ্টি হয়েছে। সেটিই প্রতিষ্ঠানটির মৌল লক্ষ্য বা অবজেক্টিভ হওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি যে সেবা কিম্বা পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজন মেটাল- সেটি তার প্রোডাক্ট। আর প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে গিয়ে যে অর্থ উপার্জন করল সেটি তার বাইপ্রোডাক্ট। এ অর্থ প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সাসটেইনিবিলিটি অর্জন করতেই কেবল কাজে লাগবে। কিন্তু তার কাজের কাজটি মোটেও অর্থ উপার্জন নয়, সেবা প্রদান। যেমন ধরুন: মিডিয়া। এর কাজ নির্মোহ ভাবে তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করা; এটিই তার প্রাতিষ্ঠানিক ম্যান্ডেট। আইডিয়ালি তার নিয়ত হতে হবে মানুষের কাছে তথ্য সেবা পৌঁছে দেয়া। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যদি অর্থ উপার্জনকে কিম্বা ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনকে তার লক্ষ্য বানিয়ে তোলে তাহলে প্রতিষ্ঠানটি যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে সেই মৌল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়ে পড়বে। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়, চিকিৎসা সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান (হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি, কিম্বা ব্যক্তি চিকিৎসক), যার মৌল উদ্দেশ্য মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়তা দেয়া। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যদি অর্থ উপার্জনকে তার মৌল লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে তখন সে মানুষকে অযথা ডায়াগনস্টিক টেস্ট দেবে, অপ্রয়োজনীয় অষুধ কিম্বা সার্জারি প্রেসক্রাইব করবে ইত্যাদি। এভাবে রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে যে কোন পেশাদার সংগঠনের কথাই চিন্তা করা যায়। আমাদের হুজুরটি তার কথার মাধ্যমে পক্ষান্তরে এই বার্তাটিই দিয়েছেন যে ঈশ্বরের সৃষ্টির সেবা করার নিয়ত নিয়ে প্রত্যেকের কাজ করা উচিত, আর তা করলেই প্রকৃত মোক্ষলাভ হবে। সে মোক্ষ অদৃষ্টবাদীদের কাছে পারলৌকিক মোক্ষ প্রতিপন্ন হতে পারে, আর সেকুলার ব্যক্তির কাছে তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টেগ্রিটি নিশ্চিত করার মোক্ষ। যেভাবেই দেখিনা কেন- পরামর্শটি সৎ ও যুগোপযোগী।
বয়ান তিন:
বাসাবাড়িতে 'অপ্রয়োজনীয়' কুকুর পালন, মনুষ্য প্রতিকৃতি ইত্যাদি রাখলে রহমতের ফেরেশতা আসবেনা। হুজুর 'প্রয়োজনীয়' কুকুরের উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন পাহাড়া দেয়ার জন্য, শিকারের জন্য, প্রতিবন্ধীর সহায়তায় ইত্যাদি প্রয়োজনে যে কুকুর ঘরে রাখা হয়। কিন্তু কেবল বিলাসিতা করে কিম্বা শখ করে যে কুকুর পালন করা হয় তা অনুচিত।
কমেন্ট:
কুকুর আমার অন্যতম প্রিয় একটি প্রাণী (দ্বিতীয় প্রিয়, হাতির পরে )। কিন্তু এর লালন পালনের ঝামেলার কথা চিন্তা করে এবং আম্মুর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে প্রাণীটিকে গৃহে অভ্যর্থনা করার কথা কখনো ভাবিনি। 'রহমতের ফেরেশতা' সম্পর্কেও আমার ধারণা স্বচ্ছ নয়। তবে ইসলামের নানা অনুশাসনে ভোগবাদী আচরণের বিপক্ষে এর সুস্পষ্ট এবং অনমনীয় অবস্থান আমার ভাল লাগে। পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় বাহণ আমার কাছে মনে হয় মানুষের ভোগবাদিতা। মানুষ ভোগ করতে চা্ইলেই, কিম্বা অন্য ভাবে বলতে গেলে মানুষের ভেতরে ভোগের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পারলেই সে নিত্য নতুন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনধারণের জন্য অপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে লালায়ীত হবে। মানুষ যত পণ্য কিনবে পণ্যের উৎপাদনও বাড়বে, পুঁজির বিকাশ ঘটবে, পুঁজিপতির পকেট ভারী থেকে আরো ভারী হবে। পুঁজির এই দুষ্টচক্রে পড়ে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি, সামাজিক ন্যয়বিচার ব্যহত হওয়া সহ যে বিভিষীকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে সোশ্যালিস্টরাই শুধু নয়, আজকালকার লিবারেল এনভাইরনমেন্টালিস্টরাও সোচ্চার হয়েছেন।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে একটি গড়পরতা মার্কিন পরিবারে প্রতি মাসে যে পরিমাণ এনার্জি ব্যয় হয় তা ১১৪০ পাউন্ড বা ৫১৭ কিলোগ্রাম কয়লার সমতূল্য।
আপনি যখন টিভির সামনে বসে রিমোট টিপছেন, ভেবে দেখুন আপনি আপনার পেছনে নিজের অজান্তেই জমা করে তুলছেন পরিবেশবিনাশী কয়লার স্তূপ । এভাবে প্রতিটি ভোগের উপকরণই আমাদের এবং আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। আমি নিশ্চিত আমাদের তরুণ হুজুর এতকিছু ভেবে কুকুর পুষতে নিষেধ করছেন না। কিম্বা কুকুর পোষার সাথে ভোগবাদের সম্পর্ক কি এমন প্রশ্নও উঠতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন ইসলামে যে কোন ভোগবাদী এ্যাপ্রোচকেই নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোথাও পড়েছিলাম বাড়িতে চাকচিক্যময় পর্দা (প্রাণীর ছবি সম্বলিত) বা সরঞ্জামের উপস্থিতি (হযরত আয়েশাকে এজাতীয় পর্দার কাপড় ব্যবহারের জন্য মোহাম্মদ (সা: ) ভর্ৎসনা করেছিলেন), শুধু শখ পুরণের জন্য কুকুর পালন পক্ষান্তরে ভোগবাদেরই সাক্ষ্য দেয়- যার বিরুদ্ধে ইসলামের এই প্রতীকি অবস্থান। আমার সেকুলার ব্যাখ্যা অন্তত তাই বলে।
বয়ান চার:
তরুণ হুজুর থেকে এবার আমার পাড়ার মসজিদের খুতবায় যাই (জুম্মার নামাযের আগে আরবিতে যা পাঠ করা হয় তাকে খুতবা বলে জানি, কিন্তু তার আগে বাংলায় যে বক্তব্য ইমাম সাহেব দেন তাকে কি বলে নিশ্চিত নই। এখানে খুতবা বলতে বাংলা বক্তব্যটিকেই বোঝানো হচ্ছে)। এ খুতবাটি আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে চলি, কারণ এমন কিছু কথা শুনতে হয় যে নামাযে ভক্তির বদলে বিরক্তিই প্রকট হয়ে ওঠে। মনে পড়ে হারিকেন ক্যাটরিনার পরপর এক ইমাম একে ইহুদি নাসারাদের ওপর আল্লাহর গযব বলে উল্লেখ করছিলেন। এর কিছুদিন পর বাংলাদেশে যখন ঘূর্ণীঝড় হল, একই ইমাম একে আখ্যায়ীত করলেন বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঈমানের পরীক্ষা হিসেবে । মসজিদে ওই সময় না গেলেও আমার বাসা থেকে মসজিদ কাছে হওয়ায় খুতবা বাসা থেকেই শোনা যায়। তো ইমাম বলছেন বাবা আদম এবং বিবি হাওয়ার কথা। প্রসঙ্গটি সম্ভবত এসেছে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক নারীদের কাজকর্ম ও মুক্তবিচরণের বিরুদ্ধে আনিত প্রস্তাব এবং তার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের উষ্মা ও অসম্মতির আলোচনা থেকে। আদম (আ: ) কে শয়তান নানা প্ররোচনাতেও যখন গন্দম ফল খাওয়াতে পারলনা, তখনই সে প্রয়োগ করল তার মোক্ষম অস্ত্র। সে বিবি হাওয়া তথা একজন নারীর প্ররোচনায় ঠিকই আদম (আ: ) কে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করাতে সক্ষম হল। কাজে কাজেই সৃষ্টির আদি থেকেই নারীরা হল মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার অব্যর্থ মাধ্যম। তাই নারীর সাথে পরামর্শ করে কখনোই রাষ্ট্র চলতে পারেনা, আর চালাতে গেলে সেখানে অনর্থ ঘটতে বাধ্য। তিনি আরো জানালেন, নারীদের সৎপথে পরিচালিত করণে অক্ষমতার কারণেই যুগে যুগে এত পথপ্রদর্শক নবি-রসুল এসেছেন, যাঁদের মাঝে একজনও নারী নন ।
কমেন্ট:
ইউ কমেন্ট। [আমার কমেন্ট লেখার মানসিকতাই নষ্ট হয়ে গেল]
উপসংহার:
আমি আগেই বলেছি আমি তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং মুক্ত ও তুমুল তর্ক বিতর্কে বিশ্বাসী। আমাদের ধর্মীয় মজলিসে এ সংস্কৃতিটি শুধু অনুপস্থিতই নয়, পরিত্যাজ্য এবং নিন্দনীয় হিসেবেও গন্য। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মৌলবাদকে অপছন্দ করি। আমার মতে আমরা যখন একটি বিষয়ের নানা দিক দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি, এবং যে কোন একটি পক্ষের কাছে নিজের আত্মাকে বন্ধক রাখি- তখনই আমরা মৌলবাদী। আমরা মৌলবাদ শব্দটি কেবল ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের ওপরই প্রযুক্ত হতে দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু আমার সংজ্ঞায়নে যে কেউই মৌলবাদী হয়ে উঠতে পারে যদি সে ধর্ম কিম্বা অধর্মের ভাল-মন্দ নানা দিক নিয়ে তর্ক বিতর্ক না করে নিজের আঁকড়ে ধরা মতটিকেই সকল বিতর্কের উর্ধ্বে জ্ঞান করে।
লেখাটি পড়ে, কিম্বা অর্ধেকটা পড়ে যাদের মধ্যে "ব্যাটা ছলছুতায় ইসলামের সবক দিতে চায়, আসলে একটা....." অথবা "এহ্; আইছে আল্লাহর দীন নিয়া তর্ক বিতর্ক বাঁধাইতে, ভিতরে ভিতরে একটা....." এ জাতীয় প্রতিক্রিয়ার বুদ্বুদ ফেনিয়ে উঠছে, এ লেখাটি সেসব প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য নয়। যারা এরকম ভালমন্দ নানা কথা শুনেছেন ধর্মীয় জলসায়, যাদের মনে প্রশ্ন বা ভাবের উদয় হয়েছে সেসব দেখে বা শুনে, নিচের মন্তব্যের ঘরটি তাদের রিফ্লেকশন জানার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৫১