somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাল-সবুজের বাংলাদেশ রক্ত দিয়ে কেনা

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৫:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আমরা বিজয় পতাকা উড়িয়েছি। তার আগে ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীন পতাকার পতপত শব্দে সারাদেশের মানুষ স্বাধীনতার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। অবশেষে ২৬ মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার থেকে ভেসে আসে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ। উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের লৌহ কারাগারে অন্তরীণ থাকলেও জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর। প্রত্যেকটি সেক্টরে যোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলে মুক্তিসংগ্রাম। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো অনেক সাহসী প্রাণের গর্জনে কেঁপে ওঠে পাকবাহিনীর অন্তর। জেলে চাষি মুটে মাঝি থেকে শুরু করে দেশের অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরাও নেমে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মুক্তির লাল সূর্য, স্বপ্নের স্বাধীনতা, আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার আন্দোলন কিন্তু শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ব্যবসায়ের নাম করে আমাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছিল অনেক বেনিয়া। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, দিনেমার এবং ইংরেজসহ অনেক ধান্দাবাজ গ্রুপ। এদের মধ্যে পর্তুগিজদের হাতে আমাদের অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। আরাকানের মগদের সাথে মিলিত হয়ে তারা আমাদের দেশকে লুট করে নিতো। হাজার হাজার যুবক যুবতীকে অপহরণ করে বহু দূরে নিয়ে দাস-দাসী হিসেবে বিক্রি করতো। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটির প্রচলন হয়ে এসেছে। তবে ওরা অনেক চেষ্টা করেও এদেশের শাসনক্ষমতা হাতে নিতে পারেনি। আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল ইংরেজ কোম্পানি। এদের হাত ধরেই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে ব্রিটিশ শাসন। একশো নব্বই বছর ধরে ওরা আমাদের শোষণ-বঞ্চনার শিকলে বেঁধে রেখেছিল।
ব্রিটিশরা ছিল খুব কৌশলী। ওরা নিজেরা কোন দোষ ঘাড়ে নিতো না। মুসলিম শাসনামলে আমাদের দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাথে মিল ছিল। হিন্দু-মুসলমানদের কোন ধরনের রেষারেষি, বিভেদ কিংবা কোন রকম গণ্ডগোল ছিল না। সবাই মিলে মিশে থাকতো। যার যার ধর্ম সবাই স্বাধীনভাবে পালন করতো। সুখ দুঃখে সবাই এক হয়ে থাকতো। সুলতান, সম্রাট, কিংবা নবাবগণ দেশ পরিচালনা করলেও সাধারণ জনগণ রাজনীতির ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করতো না। তারা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে নিজেদের জীবন-জীবিকা পরিচালনা করতো। কিন্তু সুকৌশলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে দেয় ব্রিটিশরা। হিন্দুদেরকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ার নামে তাদেরকে মুসলিমবিদ্বেষী করে তোলে। অন্য দিকে মুসলমানদের ক্ষমতাই শুধু কেড়ে নেয়নি, চাকরি-বাকরি ও লেখাপড়ার সুযোগসুবিধা থেকে শুরু করে সব ধরনের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত করে। সেইসাথে পিছিয়ে পড়া অসহায় মুসলমান জাতির ওপর চাপিয়ে দেয় নানা ধরনের খাজনা, ট্যাক্স এবং সেলামি। তখন দাড়ি রাখলে কিংবা টুপি পরলে কিংবা মসজিদে আজান দিতেও খাজনা দিতে হতো। মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করাও কষ্টকর ছিল। ফলে প্রায় সকল মসজিদেই পাঁচওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে শুধুমাত্র জুমার দিনেই নামাজ আদায় করা হতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে জুমার নামাজও আদায় করা হতো ট্যাক্স দিয়ে। ফলে মসজিদগুলো নামাজশূন্য হয়ে পড়ে। আর শুধুমাত্র জুমার নামাজ আদায় করা হতো বলে মসজিদকে জুমাঘর বলে আখ্যায়িত করা হতো। এখনও উত্তর বাংলার বিভিন্ন জনপদে মসজিদকে জুমাঘর নামেই ডাকা হয়। মুসলমান ঘরে সন্তানদের আকিকা দিয়ে মুসলমানি নাম রাখতেও খাজনা দিতে হতো। খাজনা না দিলে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-শাদিও দেয়ার অনুমতি ছিল না। এভাবে স্বাধীনতা শব্দটি মুসলমানদের জীবন থেকে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে যায়। অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে গর্জে ওঠেন অনেকেই। মীর নেসার আলী তিতুমীর গড়ে তোলেন ‘বাঁশের কেল্লা’। দলবলসহ শহীদ হয়ে তিনি প্রমাণ করে গেলেন ‘জীবনের চেয়ে স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি’। এ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, ফকির মজনু শাহ, সৈয়দ আহমদ বেরলভিসহ বালাকোর্টের হাজারো শহীদ এবং গাজী। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত হয় ‘সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। তবুও স্বাধীনতার সূর্যের দেখা পাইনি আমরা। অবশেষে হাজী মুহাম্মদ মহসিন ও মুন্নুজানের মতো বেশকিছু দানবীরের শিক্ষা বিস্তার প্রয়াস এবং বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের মতো বিদুষী নারীদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলীর মতো কিছু চিন্তাশীল মানুষের ঐকান্তিক সাধনায় আমরা আরো একধাপ এগিয়ে যাই স্বাধীনতার পথে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত বাংলা বিভক্তিকরণের মধ্য দিয়ে ঢাকা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। আবারো জেগে ওঠে মুসলমানরা। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে নিজেদের অবস্থান ফিরে আনার চেষ্টা চলে প্রাণপণে। পশ্চিম বঙ্গের মানুষের নানামুখী আন্দোলনে ১৯১১ সালেই তা রদ করা হলেও মাত্র ছয় বছরেই বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্নকে দৃঢ় করতে পেরেছে। মুসলিম লীগসহ নানা ধরনের রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বপ্নের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বাংলার অনেক নেতা গর্জে ওঠেন স্বাধীনতা আদায়ের জন্য। অবশেষে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত মানুষ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সূর্যের দেখা পায়। প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিজেদের বোধ-বিশ্বাস ও সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ ঘটে। কিন্তু অচিরেই পাকিস্তানি শাসকরাও বৈরী আচরণ শুরু করে আমাদের সাথে। প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের মাতৃভাষার ওপর। আমরা অবশ্য এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম শুরু থেকেই। তাইতো পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথেই বাংলাভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পাকিস্তান তমুদ্দন মজলিস’। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক আবদুল গফুরসহ অসংখ্য গুণীবুদ্ধিজীবী এ মজলিসে শরিক হন। কবি ফররুখ আহমদসহ সাহিত্যিক মহলে এবং তৎকালীন ছাত্রনেতা গোলাম আযমসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাষার দাবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অচিরেই দানা বেঁধে ওঠে ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, রফিকউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। স্বাধীন পাকিস্তানে বসবাস করেও আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা পূর্ববাংলায় একচ্ছত্র বিজয়সহ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তারা আমাদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। আমরাও ছিলাম দৃঢ়প্রত্যয়ী। তাইতো আবারো আমাদের গর্জে ওঠা স্বাধীনতার জন্য। অবশেষে আমাদের রাজনীতি আর ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। পরিণত হয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। ডিসেম্বরে বিজয়ের উল্লাস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে আমাদের যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের এ ঋণ স্বীকার করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই তারা বাংলাদেশের শান্তি বিঘিœত করার প্রয়াসে স্বাধীন শিশুরাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে পানির অভাবে শুকিয়ে এবং অপ্রয়োজনীয় সময়ে পানিতে ডুবিয়ে মারার জন্য সর্বনাশা ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলসহ বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা এবং মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দেশপ্রেমিক কিছু নিঃস্বার্থ মানুষ সেই লুটপাট ও শোষণ এবং ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলেন। সেদিন বন্ধুত্বের কৃতজ্ঞতায় শাসকশ্রেণী এর ভয়াবহতা নিয়ে হৈ হুল্লোড় না করে বরং অনেকাংশে নীরব থেকেছিল বলেই আজ দেশ যেমন অর্থনীতিতে অন্তরসারশূন্য তেমনি পদ্মানদীর তীরবর্তী দীর্ঘ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত। পানির হিসসা নিয়ে হাজারো চুক্তি ও চেঁচামেচি করলেও তা পদ্মার বালির পাহাড় অতিক্রম করে না। আজ স্বাধীনতার পাঁচদশক পূর্তিলগ্নে সেই প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রটি মেঘনার উজানে ফারাক্কার মতো টিপাই মুখে বাঁধ নির্মাণের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশকে মরুভূমি করার আর কোন আয়োজনই বাকি থাকছে না।
আমাদের বাংলাদেশ মহান বিজয়ের সাড়ে চার দশক পার করে পাঁচদশক পূর্ণ করতে যাচ্ছে। এ সময় একেবারে কম সময় নয়। কিন্তু আজো আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। সামাজিক-রাজনৈতিক, শিক্ষা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনজনিত গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিও অত্যন্ত নাজুক। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের শপথও ছিল তার মধ্যে। ‘অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা’ এসব ক্ষেত্রে এতো বছরেও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ কেন রাজনৈতিক জটে আটকে থাকবে এ জিজ্ঞাসাও অযৌক্তিক নয়। বিদেশ থেকে যারাই এ দেশে বেড়াতে আসেন, প্রত্যেকেই এ দেশ দেখে মুগ্ধ হন। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের মন হরণ করা ব্যবহার, অতিথিপরায়ণতা এবং আহার-বিহার সবই নজরকাড়া। সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ এ বাংলা। বাংলার সম্পদ, এর সবুজ-শ্যামলী, নদ-নদী, পাহাড়-হ্রদ-জলপ্রপাত, সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন সবই সৃষ্টিকর্তার অশেষ দান। এমন একটি দেশ এগিয়ে যাবে না এ কথা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হয়।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ, এ কথা বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছে। এই সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা পাবে বা বাস্তবায়ন ঘটবে তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রচেষ্টা, নারীর অধিকার সংরক্ষণ, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ এবং দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলাসহ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার মধ্য দিয়ে। দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সে জন্য প্রয়োজন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন দেশে রাজনৈতিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনা। আর এটা পারবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই। মালয়েশিয়া ঘুরে দাঁড়াল, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম ২৫ বছর যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল, জাপান আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়াল, আমরা পারব না কেন? আমাদেরও পারতে হবে। গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কেবল তাহলেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
গণমাধ্যম যেমন দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার নিয়ামক শক্তি, তেমনি দেশকে শীর্ষসন্ত্রাসী কিংরা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিত করেও তুলতে পারে। এমনকি খবরদারির এ আধুনিকবিশ্বে পাকিস্তান, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিতেও বিদেশী শক্তির আগমনের পথ সুগম করতে গণমাধ্যম দুঃখজনক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আমাদের সচেতন ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা এতো বড় সর্বনাশ হবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না। তবুও কথা থেকে যায়; কেননা এটা অস্বাভাবিক নয় এজন্য যে, এক সিরাজের পার্শ্বে থাকে হাজারো মীরজাফর। ফলে স্বপ্নের পলাশী হয়ে পড়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল এবং নীরবে কেঁদে বেড়ায় মূল্যবোধের সজীব আত্মা। এ চাওয়া পাওয়ার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য চাই মনুষ্যত্ব অর্জন; আর এর জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধ ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরির জ্ঞান। সরকার যদি আন্তরিক হন, নেতা-নেত্রীরা যদি সত্যিকার রাজনীতি করেন তাহলে দেশের পরিবেশও সুন্দর থাকবে। এ জন্য প্রয়োজন সকলের সচেতনতা এবং সহনশীল মানসিকতা। বর্তমান দেশের পরিস্থিতি জাতিকে শুধু ভাবিয়েই তোলেনি বরং ব্যাপকভাবে হতাশও করেছে। আমরা নতুন করে কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীর নামে নতুন কোন ওসমান, শতকী কিংবা হাজারী দেখতে চাই না; দেখতে চাই দেশ গড়ার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। ইতঃপূর্বে দেশবাসী দেখেছে কিভাবে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নাচানাচি করা হয়েছে। কিভাবে বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিভাবে বিরোধী দলের সকল কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করা হচ্ছে তা জাতির কাছে স্পষ্ট। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনসহ দেশের জনপ্রিয় কয়েকটি গণমাধ্যমকে কিভাবে বিনা অপরাধে কোন ধরনের আইনি নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই শুধুমাত্র গায়ের জোরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমই উৎকৃষ্টতম মাধ্যম। তাদের দিকনির্দেশনায় সরকার ও বিরোধীদলসহ সকল জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগ্রত করার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম মৌলিক ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে- এমন প্রত্যাশা সকলের।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দিকে তাকালে আমাদের বিজয় দিবসের উল্লাস ম্লান হয়ে আসে। বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্য আমাদের স্বদেশজুড়ে। টিভি খুললেই ভিনদেশী চ্যানেলের আধিপত্য। বিনোদন মানেই ভিন্ন ভাষার গান-নাটক-সিনেমা। সংস্কৃতি মানেই অবিশ্বাসী ঘরানার মডেল। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে যে ভাষাগত-সাংস্কৃতিক কালোথাবা আমাদের ওপর পড়েছে তা উদ্ধারের কোন বিকল্প নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এ থাবায় অনেকাংশেই পঙ্গু হয়ে গেছে। সেখানকার শিশুরা এখন আর বাংলাভাষা বলতেই পারে না বলা চলে। অফিসার থেকে শুরু করে মুদিদোকানদারা পর্যন্ত সে জালেই বন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের মুখে হয়তো হিন্দি নতুবা ইংরেজি। বাংলাভাষার জন্য এখন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করতে পারে একমাত্র বাংলাদেশই। সে বাংলাদেশে যেভাবে ডোরেমন, মটুপাতলুর আগ্রাসন চলছে তাতে শিশুরা যেমন বাংলার চেয়ে হিন্দিতেই বেশি পারদর্শী হয়ে পড়েছে তেমনি হিন্দি গান ও সিনেমার কবলে বাংলাদেশের যুবসমাজও আটকে গেছে বলা চলে। হিন্দি ও পশ্চিম বাংলার সিরিয়ালে নারীদের মনমস্তিষ্ক আটকে যাবার কারণে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের কাছে ঐতিহ্যের কোন শিক্ষা পাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নিরাশার কালো অধ্যায়। আজো আমরা তাকাতে পারিনি আমাদের বুকের দিকে। আজো আমাদের শেকড়ের প্রতি আস্থাবান হতে পারিনি। বাংলাদেশে অভিজাত পল্লীতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর দৌরাত্ম্যে বাংলাভাষা এখন কোণঠাসা হতে শুরু করেছে। নিজেদের তাহজিব-তমদ্দুন ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি এখনো আমাদের অবহেলা বিদ্যমান।
পরিশেষে বলা যায়, বিজয়ের দীর্ঘ পদযাত্রায় অনেক অর্জনের মাঝেও নিরাশার কালো মেঘ মাঝে মধ্যেই দানা বাঁধে মনের আকাশে। এখনো হতাশাগ্রস্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক সিপাহসালার। এখনো আমরা মাথা উঁচু করে ন্যায়সঙ্গত অধিকারের কথা বলতে ব্যর্থ হচ্ছি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে না পারলে কিসের স্বাধীনতা- কিসের গণতন্ত্র! স্বাধীনতা মানেইতো ন্যায়সঙ্গত অধিকার ফিরে পাওয়া। স্বাধীনতা মানেই তো দেশের কল্যাণে নিজের কল্যাণ খোঁজা। স্বাধীনতা মানেই নিরাপত্তার গ্যারান্টি। স্বাধীনতা মানেই বিশ্বাসের পতাকা হাতে নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে সামনে এগিয়ে চলা। স্বাধীনতা মানেই তো আমার স্বদেশ আমার জীবন। স্বাধীনতা মানেই আমার সবুজ স্বপ্নের বিনির্মাণ। ছেলেহারা মায়ের মতো আজো আমরা দৃপ্ত শপথে সে পথেই চেয়ে আছি। তবে এ জন্য চাই মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা; নিজেদের স্বকীয়তা এবং প্রকৃতভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৫:৫৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×