আজ পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকান সভ্যতা ও ইউরোপিয়ান সভ্যতা। দু’টি সভ্যতা আলাদা নামে প্রকাশ হলেও মূলমন্ত্র একই। রাজনীতিতে গণতন্ত্র, অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ, আর বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনাই এই সভ্যতার মূলভিত্তি। আর ধর্ম এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, শুধু ব্যক্তিগতভাবেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। এই সভ্যতায় শ্রেণিবৈষম্য এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে ধনীরা আরও ধনী হতে থেকেছে আর দরিদ্ররা আরও দরিদ্র। নারীরা এখানে শুধু ভোগের পণ্য, তারা হারিয়েছে স্ত্রীর অধিকার আর মায়ের মর্যাদা। লোপ পেয়েছে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ আর মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা। আর তাই সন্তান জন্ম নিলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বেবি কেয়ার সেন্টারে, আর মাতা-পিতা বৃদ্ধ হলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মা-বাবার জন্য সময় এতই কম যে বছরে একদিন মা দিবস, বাবা দিবসের মাধ্যমে তাদের কথা স্মরণ করানোর চেষ্টা করা হয়। যৌন সম্ভোগকেই তারা জীবনের সব কিছু মনে করে নিয়েছে। আর তাই আমেরিকায় বিপরীত লিঙ্গের সাথে দৈহিক মিলনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ করে নিয়েছে সমকামিতাকেও। অর্থাৎ একই লিঙ্গের দু’জনের মাঝে বিয়ে ও মিলনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া আইনিভাবে বৈধতা না পেলেও এর ব্যাপক চর্চা রয়েছে ইউরোপের প্রায় সব কয়টি দেশেই। তবে এর মাধ্যমে এই সভ্যতা তার পতনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করেছে। কারণ সভ্যতা গড়ে ওঠে মানুষের সমন্বয়ে, যদি মানুষের ক্রমাগত বংশবৃদ্ধিই না হয়, তবে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ হবে কাদের নিয়ে?
আর সমকামিতার মাধ্যমে মানবসন্তান বংশ বিস্তারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ করেছে তারা। ইতিহাস সাক্ষী এই অপরাধের কারণেই গজবপ্রাপ্ত হয়েছিল হযরত লূত (আ)-এর জাতি।
তবে এই বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, সভ্যতা গঠনের প্রাথমিক একক হচ্ছে পরিবার। এমনকি সভ্যতা ক্রমবিকাশের একক বলাও চলে। কারণ পরিবারগুলোই মানবসভ্যতার প্রজনন কেন্দ্র। আর এই পরিবার গঠিত হয় একজন পুরুষ এবং একজন নারীর বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে, যাকে বিয়ে (Marriage) বলা হয়। এই বিয়ের প্রক্রিয়া মানুষকে কে শিক্ষা দিয়েছে? উত্তরে বলতে হবে ‘ধর্ম’। কারণ ধর্মই একজন পুরুষ ও একজন নারীর মাঝে বৈধ সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সকল ধর্মে বিবাহের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যদি ধর্ম এই কাজটি না করতো তবে পৃথিবীর মানবসভ্যতা গঠনতো দূরের কথা মানুষের অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেত। শুধু তাই নয়, ধর্মের মাধ্যমেই মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
সন্তান তার জন্মদাত্রীকে মা আর জন্মদাতাকে বাবা বলে ডাকে এবং তার জন্মদাতার পিতাকে দাদা আর মাতাকে দাদী বলে ডাকে। মা-বাবার সাথে যেভাবে আদবের সাথে কথা বলে, আচার-আচরণ করে ভাই-বোনের সাথে তা কিছুটা ভিন্ন। আবার বন্ধু/ক্লাসমেটের সাথে সম্পর্কের ধরনটা একেবারেই ভিন্ন। এই বিষয়গুলো মানুষকে ধর্মই শিক্ষা দিয়েছে। পৃথিবীর একটি রাষ্ট্রও কি এমন আছে যেখানে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান একজন সংখ্যালঘু? উত্তরে বলতে হবে নেই। কোন রাষ্ট্র বা সরকার কেন পৃথিবীতে কয়টা উপজেলা আছে যার চেয়ারম্যান একজন সংখ্যালঘু অথবা কয়টা ইউনিয়ন/ওয়ার্ড আছে যেখানে চেয়ারম্যান/ মেম্বার একজন সংখ্যালঘু। হ্যাঁ কিছু হয়তো আছে, তবে তার শতকরা হার কি ১% হবে? না হবে না। বরং দেখা যায় যে দেশে যে ধর্মের অনুসারী বেশি সেই ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকেই একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান হয়ে থাকেন, সেটা ঐ দেশে যেকোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু থাকুক না কেন। আমেরিকা খ্রিস্টান প্রধান দেশ, তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট একজন খ্রিস্টান। চীন বৌদ্ধ প্রধান দেশ, চীনের প্রেসিডেন্ট একজন বৌদ্ধ। ইন্ডিয়া হিন্দুপ্রধান দেশ আর তাই ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী একজন হিন্দু। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ এ দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন মুসলিম। এমনটাই হয়ে আসছে পৃথিবীতে। তা হলে এমনটি কেন হয়? নিঃসন্দেহে ‘ধর্মীয় শক্তির’ প্রভাবেই এমন হয়। তবে পৃথিবীর কোথাও এমনকি দেখা গেছে যে সংখ্যালঘুরা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে? উত্তরে বলতে হবে না। বরং যেখানেই যারা সংখ্যালঘু সেখানে তারা একসাথে বসবাস করে। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু আর তাই হিন্দুদের সমন্বয়ে হিন্দুপাড়া, খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে খ্রিস্টানপাড়া আর বৌদ্ধদের সমন্বয়ে বৌদ্ধপাড়া গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। তারা যেখানে যে কয়জন আছে একসাথে বসবাস করতে পছন্দ করে। আবার নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে ঠিক একইভাবে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানেও একই চিত্র দেখা যায়। তাহলে কোন শক্তি তাদের একসাথে বসবাস করতে বাধ্য করছে? নিঃসন্দেহে ‘ধর্মীয় শক্তি’।
একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে একজন মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি তার স্বধর্মেরই হয়ে থাকে, তার বিয়ে-শাদি, ব্যবসায়িক লেনদেন, মোয়ামেলাতসহ সামগ্রিক জীবনাচরণ ধর্মের বলয়েই আবর্তিত হয়। যদি পরিবার গঠন হয় ধর্মীয় নিয়মে, ব্যক্তি ও সমাজজীবন পরিচালিত হয় ধর্মীয় বলয়ে আর দেশের শাসক নির্বাচিত হয় ধর্মীয় প্রভাবে, তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে জীবনব্যবস্থা/ শাসনব্যবস্থা হিসেবে ধর্ম কেন নয়? আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিইবা কোথায়?
ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার অন্যতম গুরু ‘ফিদেল ক্যাস্ট্রো’ জীবনের শেষ দিকে এসে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘ধর্মের কাছেই ফিরে আসতে হবে’।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১:৪৭